সাধারণত গুহার কথা শুনলে আমাদের মনের মাঝে এক ভৌতিক দৃশ্যপট ফুটে ওঠে; গা ছমছমে পরিবেশ; চারিদিকে মাটি-পাথর বেষ্টিত গুমোট অন্ধকার। কথিত আছে, প্রাচীনকালে মানুষ গুহায় বসবাস করতো; আধুনিককালে এর অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও পাওয়া গেছে। কখনো কখনো মানুষ তার নিজ প্রয়োজনে কৃত্রিম গুহা তৈরি করেছে সত্য, কিন্তু অধিকাংশ গুহা ছিল প্রকৃতি প্রদত্ত। অনেক সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয় নতুন নতুন গুহার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক গুহার সন্ধান পাওয়া যায়।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্বের অনেক গুহা হারিয়ে গেছে। অনেক গুহা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, আবার অনেক গুহার প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা আমাদের কাছে ইতিহাসের অতীত বলে গণ্য হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানপ্রিয় মানুষ প্রতিনিয়ত হারিয়া যাওয়া সেসব গুহা পুনরাবিষ্কারের চেষ্টা করছেন।
গত কয়েক দশকে ভিয়েতনামে অনেকগুলো প্রাচীন গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ‘হাং সন ডং’ (যার অর্থ পাহাড়ি নদীর গুহা) বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সম্প্রতি এক অনুসন্ধানের পর জানা গেছে, গুহাটিকে যত বড় ভাবা হয়েছিল, বাস্তবে সেটি এর থেকে আরও অনেক বড়।
গত মাসে তিনজন দুঃসাহসী ব্রিটিশ ডুবুরি এই গুহার আরও একটি সংযুক্ত অংশ আবিষ্কার করেছেন। এর প্রবেশদ্বার দেশটির ক্যুয়ান বিনহ প্রদেশের ফং নাহ-কে ব্যাং জাতীয় উদ্যানে জঙ্গলবেষ্টিত এক মাঠে অবস্থিত। মূলত পানিপথে অভিযান চালিয়ে গুহার সংযুক্ত এই অংশটি আবিস্কার করা হয়। অভিযানের সময় ডুবুরিরা পানির নিচে একটি সুড়ঙ্গের সন্ধান পান। এই সুড়ঙ্গটি সন ডং গুহাকে আরেকটি বৃহৎ গুহার সাথে সংযুক্ত করেছে, যার নাম ‘হাং থুং’।
এর ফলে সন ডং গুহাটির মোট আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩৮.৫ মিলিয়ন ঘন মিটারে। আনুষ্ঠানিকভাবে হাং থুং গুহাকে সন ডং গুহার অংশ ঘোষণা করায় এর আয়তন বেড়েছে ১.৬ মিলিয়ন ঘন মিটার। এই অভিযানে ডুবুরিদের সামগ্রিক সহায়তা দিয়েছেন বিশিষ্ট গুহা বিশেষজ্ঞ ও ক্যুয়ান বিনহভিত্তিক পর্যটন প্রতিষ্ঠান ‘অক্সালিস ভেঞ্চার’-এর কারিগরী উপদেষ্টা হাওয়ার্ড লিম্বার্ট। তিনি বলেন,
উভয় দুর্গের সংযুক্তির ফলে সন ডং এর আয়তন এত বড় হয়েছে যে, বিশ্বের যেকোনো গুহাকে এর অভ্যন্তরে খুব সহজে ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে! এর আয়তন অবিশ্বাস্য রকমের বড়।
নতুন অংশের আবিষ্কার
অক্সালিস সন ডং দুর্গের একমাত্র লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান, যারা সেখানে পর্যটকদের আনা-নেয়া করতে পারেন। এই প্রতিষ্ঠানটিই গুহার নতুন আবিষ্কৃত সুড়ঙ্গটি অনুসন্ধানের জন্য তিনজন ব্রিটিশ ডুবুরি- জেসন ম্যালিনসন, রিক স্ট্যান্টন এবং ক্রিস জুয়েলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই তিন অভিজ্ঞ ডুবুরি থাইল্যান্ডে গুহা ধসে আটকে পড়া শিশুদের উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এজন্যই তাদের বাছাই করে অক্সালিস। এ বিষয়ে হাওয়ার্ড লিম্বার্ট বলেন,
এই তিন ডুবুরি থাইল্যান্ডে গুহায় আটকে পড়া শিশুদের উদ্ধার কাজে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। এজন্যই আমরা তাদের সন ডং-এ আমন্ত্রণ জানাই। তাদের দুর্দান্ত প্রচেষ্টা ও সফলতার জন্য আমরা তাদেরকে অভিনন্দন জানাই।
তিনি আরও বলেন,
তারা এই অভিযানের মাধ্যমে আমাদের দারুণ কিছু উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এজন্যই আমরা একত্রে কাজ শুরু করেছিলাম। তারা সন ডং-এর এমন একটি অংশ আবিষ্কার করেছেন, যেখানে আগে কেউ কোনোদিন যেতে পারেনি।
হাওয়ার্ড লিম্বার্ট জানান, অক্সালিস টিম আগেই জানতো যে, সন ডং গুহার সাথে থুং গুহার জলপথে যোগাযোগ রয়েছে। ডে-টেস্টিং পদ্ধতিতে আগেই তারা এ তথ্য জানতে পেরেছিল। কিন্তু ভূগর্ভস্থ এই নদীতে কোনো মানুষের এটিই প্রথম অভিযান।
এবারের অভিযানে ডুবুরিরা সুড়ঙ্গের ৭৮ মিটার গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সময় তাদের আরও সামনে অগ্রসর হওয়ার মতো বাতাস (অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন) ফুরিয়ে যায়। এজন্য তারা সেখান থেকে ফিরে আসেন। লিম্বার্ট জানান,
ডুবুরিরা যখন ৭৮ মিটার গভীরে পৌঁছান, তখন তারা একটি ভারী দস্তা পিণ্ডকে দড়ির সাথে বেঁধে লম্বালম্বিভাবে সুড়ঙ্গের গভীরতা পরিমাপ করেন। তাদের বিশ্বাস, মোট ১২০ মিটার পথ অতিক্রম করলে এই সুড়ঙ্গের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং প্রায় ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ভূগর্ভস্থ নদীর সন্ধান মিলবে।
অভিযানে বের হওয়ার সময় ডুবুরি দল ধারণা করতে পারেনি সুড়ঙ্গটির গভীরতা এত বেশি হবে, কেননা অত্র অঞ্চলের অন্যান্য গুহাগুলোর গভীরতা তুলনামূলক কম।
আগামী বছরের এপ্রিল মাস নাগাদ ডুবুরিরা পুনরায় এই গুহায় অভিযান চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এপ্রিল মাস অভিযানের জন্য আদর্শ সময়, কেননা এ সময় পানির স্তর তুলনামূলক নিচুতে থাকে এবং অন্যান্য সময়ের তুলনায় পানির স্বচ্ছতা বেশি থাকে। এ বিষয়ে লিম্বার্ট বলেন।
আমি কল্পনা করছি, সামনের অভিযানটি আমাদের কাছে আরও বেশি অবিশ্বাস্য হবে। কেননা, বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুর্গের অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা রয়ে গেছে। এটি আমাদের বোঝাপড়াকে আরও স্পষ্ট করবে।
তিনি আরও বলেন,
২০০৯ সাল পর্যন্ত সন ডং এলাকায় কেউ পা পর্যন্ত ফেলতো না। এখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। সর্বশেষ আবিষ্কার আমাদের জানান দিচ্ছে, পৃথিবীর অনেক কিছুই আমাদের জানার বাইরে রয়ে গেছে। এটি সত্যিকার অর্থেই এক রোমাঞ্চকর আবিষ্কার।
প্রথম যেভাবে আবিষ্কার হয়েছিল গুহাটি
হাং সন ডং গুহা প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয়েছিল ভিয়েতনামের স্থানীয় এক শিকারির মাধ্যমে। তার নাম ছিল হো খানহ। ১৯৯০ সালে তিনি এই গুহার সন্ধান দিয়েছিলেন।
একবার জঙ্গলে শিকার করতে গেলে হো খানহ মাটিতে একটি ছিদ্রের সন্ধান পান। ঐ ছিদ্রে তিনি কান পেতে অনুভব করেন, এর গভীরে প্রচুর বাতাস ও নদীর পানি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসার পর তিনি ঐ জায়গাটি হারিয়ে ফেলেন। জায়গাটি ঘন জঙ্গলে আবৃত থাকায়, তখন তিনি পুনরায় ঐ ছিদ্রটি আবিষ্কারে ব্যর্থ হন।
এরপর ছিদ্রটি পুনরায় আবিষ্কারের জন্য হো খানহ বহু বছর যাবত নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে ২০০৯ সালে তিনি পুনরায় ঐ ছিদ্রটি আবিষ্কারে সমর্থ হন এবং সেখানে হাওয়ার্ড লিম্বার্টসহ ব্রিটিশ কেইভ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিআরএ)-এর সদস্যদের নিয়ে যান। হো খানহ নিজেও তখন এই সংস্থার অন্যতম সদস্য ছিলেন। তারা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন, হো খানহ এর অনুমান সত্য এবং এখানে বড় ধরনের গুহার অস্তিত্ব রয়েছে।
এরপর বিসিআরএ সেখানে অভিযান চালায় এবং গুহার আয়তন নির্ণয় করে ২০১০ সালে তারা সন ডং গুহাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গুহা হিসেবে ঘোষণা করে। গুহাটি বড় বড় চুনাপাথরের খণ্ড দ্বারা গঠিত এবং এর অভ্যন্তরে বহুমাত্রিক আবহাওয়া পরিলক্ষিত হয়। গুহার ভেতরে দুটি জঙ্গলসহ নানা জাতের গাছপালা ও পত্রপল্লব রয়েছে। লিম্বার্ট জানান,
এখন পর্যন্ত আমরা ‘ফং নাহ-কে ব্যাং জাতীয় উদ্যানের’ মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গা অনুসন্ধান করে শেষ করতে পেরেছি। সুতরাং অনেক অজানা রহস্যই এখনো আমাদের কাছে অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
অর্থাৎ বিশ্বের সর্ববৃহৎ গুহাটি আরও বৃহৎ কি না তা-ও এখন আমরা চূড়ান্তভাবে বলতে পারছি না। তবে ধীরে ধীরে হয়তো সেসব রহস্য আমাদের সামনে আরও স্পষ্ট হবে। আপাতত আমাদের অপেক্ষার সময়সীমা আগামী বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত। সেই অপেক্ষা হয়তো আরও নতুন কিছু চমক নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হবে। আপাতত সেই অপেক্ষাতেই থাকতে হবে আমাদের।
প্রসঙ্গত, প্রতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে হাং সন ডং গুহায় ভ্রমণ করতে যাওয়া যায়। এতে জনপ্রতি খরচ পড়বে ২,৯৯০ মার্কিন ডলার। তবে একসাথে ১০ জনের বেশি পর্যটক সেখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া বছরে ১,০০০ জনের বেশি পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন না। প্রতি গ্রুপের সাথে ২৭ জনের একটি চৌকষ ও প্রশিক্ষিত সাহায্যকারী দল প্রেরণ করা হয়, যারা পর্যটকদের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ইত্যাদি ব্যাপারে সহায়তা প্রদান করে থাকেন। ২০১৩ সাল থেকে এই সুবিধা চালু করা হয়েছে। আর এসবের ব্যাবস্থাপনা করে থাকে একমাত্র লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান অক্সালিস।
This is a Bangla article about The Son Doong; World's biggest cave. All The Sources are hyperlinked in the article.
Feature Image: Jarryd Salem/CNN