Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তাব্রীজ: ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর

পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশ, ইরান। এখানে সুবিশাল আগ্নেয় পর্বত সাহান্দের সুউচ্চ চূড়ার পাদদেশে অবস্থিত, আয়নালি পর্বতমালা বেষ্টিত তাব্রীজ শহরটি ইরানের ঐতিহাসিক ও প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৩৫০ ফুট উঁচু এই শহরটি মূলত কুরু নদী সংলগ্ন উপত্যকায় অবস্থিত।

আকাশ থেকে তাব্রীজ; Image Source: Hikers Bay

উপত্যকাটি একটি সমভূমিতে মিলিত হয়েছে, যেটি আলতোভাবে নেমে গেছে লেক উর্মিয়ার পূর্ব তীরে।

লেক উর্মিয়া; Image Source: financial tribune

আজি চে নদী বয়ে গেছে শহরের ঠিক মাঝখান দিয়ে। তাব্রীজ শহরটি ইরানের উত্তর আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী। তাব্রীজকে আসলে অনেকভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। এটি প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। বর্তমান ইরানের প্রাদেশিক রাজধানী। ইরানের পঞ্চম বৃহত্তম শহর। তেহরান, মাশহাদ এবং ইস্পাহানের পর এটি ইরানের চতুর্থ জনবহুল শহর। তবে তাব্রীজকে পৃথিবী চেনে মূলত ঐতিহ্যের শহর হিসেবে। প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো তাব্রীজ জুড়ে। তাব্রীজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং নানা ঐতিহ্যের সাথেই পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে এই লেখাটিতে।

তাব্রীজে আর্দ্র মহাদেশীয় জলবায়ু লক্ষ্য করা যায়। তাব্রীজে গরমকালে প্রচুর গরম পড়ে আর শীতকালে অনুভূত হয় তীব্র শীত। রীতিমতো তুষারপাত হয়। গরম আবহাওয়ার কারণে তাব্রীজ ‘সামার রিসোর্ট’ নামেও পরিচিত।

ইতিহাসে তাব্রীজ

ইতিহাসে তাব্রীজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিস্টের জন্মেরও সহস্র বছর আগে। তাব্রীজের পৃথিবীখ্যাত ঐতিহ্য ‘ব্লু মস্ক’ এর ধারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রথম সহস্রাব্দের একটি কবর খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই ৭১৪ অব্দের আসিরিয়ান রাজা সার্গন দ্বিতীয় এর শাসনামলের একটি এপিগ্রাফেও তাব্রীজের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় শাস্ত্রের পন্ডিত ডেভিড রলের দাবি, কিংবদন্তীর ‘গার্ডেন অব ইডেন’ তাব্রীজের কাছাকাছি কোথাও ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক এরিক এইচ ক্লাইন অবশ্য তার এই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।

তাব্রীজের প্রথম যুগের ইতিহাসেও এটি বেশ কিছু শাসকের রাজধানী ছিল। অবশ্য ধারণা করা হয়, বর্তমান তাব্রীজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল তৃতীয় বা চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে অথবা সপ্তম খ্রিস্টাব্দে, সাসানী সম্রাটদের শাসনামলে। মুসলমানরা তাব্রীজ জয় করার পর ইয়েমেনেের ‘আজদ’ গোত্র এখানে বসবাস করতে শুরু করে। বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর ৭৯১ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা হারুন-আর-রশীদ এর স্ত্রী জুবাইদা এটি পুনর্নির্মাণ করেন এবং তাব্রীজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন। পারস্যে মঙ্গোলদের আক্রমণের পর এটি তাদের অধীনে চলে যায় এবং মঙ্গোল শাসকদের রাজধানীর মর্যাদা পায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যেসব পশ্চিমা অভিযাত্রী প্রাচ্যভ্রমণ করেছেন, তারা তাব্রীজের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, বড় বড় ভবনের স্থাপত্যশৈলী এবং প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। মার্কোর পোলোর পদচিহ্নও পড়েছিল তাব্রীজে। ১২৭৫ সালে সিল্করোড ভ্রমণের সময় তিনি তাব্রীজ দর্শন করেন। এ শহর সম্পর্কে তিনি বলেন, “সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর বাগানে ঘেরা বড় একটি শহর।”

১৩৭৫ থেকে ১৪৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কারা কনলু শাসকদের শাসনামলে তাব্রীজ আজারবাইজানের কারা কনলু রাজ্যের রাজধানী ছিল। এরপর তাব্রীজ চলে যায় শাফবীদের হাতে। তারপর অটোমান সুলতানরাও কিছুদিন তাব্রীজ শাসন করেছেন। এরপর আবারও পারস্যের সেনাবাহিনী তাব্রীজ পুনরুদ্ধার করে। কাজার রাজবংশের শাসনকালে তাদের ক্রাউন প্রিন্সের আবাস ছিল তাব্রীজ শহরে। ভূতাত্ত্বিক কারণে পশ্চিমের সাথে সহজ যোগাযোগ থাকার কারণে ইরানের সাংবিধানিক বিপ্লবের কেন্দ্র ছিল তাব্রীজ। এরপর ইরানের বহু বিপ্লব ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে তাব্রীজ। তাব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।

শিল্পের শহর তাব্রীজ

তাব্রীজ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র। আধুনিক যুগের শুরু থেকেই এটি ককেশীয়, পূর্ব আনাতোলিয়া এবং কেন্দ্রীয় ইরানের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তাব্রীজের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে শিল্প ও পর্যটন। তাব্রীজ অটোমোবাইল, নানা রকম যন্ত্রপাতি, শোধনাগার, পেট্রোক্যামিক্যাল এবং বস্ত্রশিল্পের মতো ভারী শিল্পের কেন্দ্রস্থল। তবে এটি বিশেষভাবে বিখ্যাত এর হস্তশিল্পের কল্যাণে।

তাব্রীজের কার্পেট ঘরের শোভা বাড়িয়েছে; Image Source: arearugdimensions.com

হাতে বোনা কম্বল ও গয়নার স্বর্গ তাব্রীজ। তাব্রীজ কার্পেটের জন্যও বিখ্যাত। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট কাউন্সিল একে ‘বিশ্ব কার্পেট বুনন নগরী’ ঘোষণা করে।

ভাষা ও সংস্কৃতি

তাব্রীজের জনসংখ্যার বেশিরভাগই আজারবাইজানি। তাই আজেরি ভাষাই এখানে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। অধিবাসীরা দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হিসেবে ফারসি ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তাব্রীজে আজেরি সংস্কৃতির ব্যাপক আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। এখানকার নিজস্ব অনেক খাবারদাবার রয়েছে। মিষ্টান্ন ও হাতে তৈরি এই খাবারগুলো এ স্থানের ঐতিহ্যের অংশ।

ঐতিহ্যের শহর

ইরানের দীর্ঘদিনের ইতিহাসের পালাবদলের প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপত্য রয়েছে তাব্রীজ জুড়ে। বেশিরভাগ স্থাপত্য ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং যুদ্ধের ফলে নষ্ট হয়ে গেছে। টিকে আছে শুধু মঙ্গোল, শাফবী এবং কাজার শাসনামলের স্থাপত্যগুলো। এখন থাকছে তাব্রীজের ঐতিহাসিক নিদশনগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

তাব্রীজ বাজার

তাব্রীজের ঐতিহাসিক বাজারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ঐতিহ্যবাহী এই বাজার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহত্তম বাজার।

তাব্রীজের ঐতিহ্যবাহী বাজার; Image Source: wikimedia commons

এটি বিখ্যাত সিল্করোডের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। নকশাখচিত ধনুকাকৃতির ছাদের নিচে নির্মিত হয়েছে বাজার ভবন। বাজারে দোকানগুলো আন্তঃসংযুক্ত। কার্পেট, মশলা, খাদ্রদ্রব্য- কী নেই এখানে!

তাব্রীজের বাজারে কার্পেট; Image Source: financial tribune

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শাফবী শাসনামলে এই বাজারটি সমৃদ্ধ ও প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে ইউনেস্কো সুদৃশ্য এই বাজারটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে।

নীল মসজিদ (ব্লু মস্ক)

নীল রঙের মোজাইকের জটিল কারুকার্যখচিত নান্দনিক ব্লু মস্ক তৈরি করা হয়েছিল শাসক জাহান শাহের আমলে, ১৪৬৫ সালে। সে সময়ে এটি ভুবনবিখ্যাত স্থাপত্য ছিল।

ব্লু মস্কের দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফি; Image Source: culture trip

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৭৭৩ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারপর ধীরস্থিরভাবে মসজিদটির পুনর্নির্মাণ সম্পন্ন হয়। মসজিদের মনোরম নীল কারুকার্য ও জটিল ক্যালিগ্রাফির কাজ সম্পন্ন করতে ২৫ বছর লেগে গিয়েছিল। মসজিদটি এর দৃষ্টিনন্দন ইটের কারুকাজ আর বিশালাকৃতির জন্যও বিখ্যাত। জাঁকজমকপূর্ণ এই স্থাপত্যটি দেখতে সারাবিশ্বের পর্যটকরা ভিড় জমান।

আজারবাইজান জাদুঘর

আজারবাইবান জাদুঘর ইরানের অন্যতম সেরা জাদুঘর। জাদুঘরটিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রবেশপথ পেরোনোর পরই পাবেন প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। এই বিভাগটিতে পঞ্চম শতাব্দী থেকে সাসানী শাসনামল পর্যন্ত আজারবাইজানের পূর্ণাঙ্গ চিত্রকে উপস্থাপন করে। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে আকিমেনিদ সময়কাল থেকে উনবিংশ শতাব্দীর ইরানের মুদ্রা, কার্পেট, কাঁচ নির্মিত দ্রব্য, মোমদানি ইত্যাদি। বেজমেন্টে রয়েছে রেস্তোরাঁ এবং শিল্পী আহাদ হেসাইনীর ব্রোঞ্জনির্মিত মূর্তি। রয়েছে অসংখ্য চিত্রকর্মও।

এল গলি পার্ক

এল গলি পার্ক ‘শাহ গলি’ নামেও পরিচিত। এই পার্কটি ‘এল গলি’ নামের কৃত্রিম লেককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
ধারণা করা হয়, কৃষিতে সেঁচকাজের সুবিধার জন্য এই লেকটি খনন করা হয়েছিল। কারা কুনলু রাজাদের শাসনামলে এটি তৈরি হলেও লেকটি বিস্তৃতি লাভ করেছিল শাফবীদের আমলে। ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর ইরানের সবকিছু থেকে ‘শাহ’ নামটি অপসারণ করা হয়। তারপর থেকেই এটি এল গলি নামে পরিচিত।

বিখ্যাত এল গলি পার্ক; Image Source: financialtribune

এল গলি লেকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সুদৃশ্য রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে লেকের শোভা উপভোগ করা যায়।

লেকের চারপাশে আছে পাহাড়। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা লেকের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। লেকের ঠিক মাঝখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি ভবন।

কবি স্মৃতিসৌধ

এই সুদৃশ্য স্থাপত্যটি মূলত ইরানের প্রাচীন ও আধুনিককালের কবিদের কবরস্থান।

কবিদের স্মরণে নির্মিত সৌধ; Image Source: must see persia

বিশেষ করে কবি ওস্তাদ শাহরিয়ারের স্মরণে এটি নির্মিত হয়। কবিরা ছাড়াও আরো অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির কবর রয়েছে আধুনিক এই স্থাপত্যটিতে। এর বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলী দেখে পর্যটকরা বরাবরই মুগ্ধ হন।

তারবিয়াত স্ট্রিট

এটি ইরানের সবচেয়ে পুরনো সড়কগুলোর একটি। এটি মূলত একটি ফুটপাথ, যা তাব্রীজ বাজারকে মিউনিসিপ্যালিটি ভবনের সাথে সংযুক্ত করেছে।

তারবিয়াত স্ট্রিট; Image Source: National Geographic your shots

একটি ফুটপাথের এত মাহাত্ম্য কেন? কারণ তারবিয়াত স্ট্রিট ঐতিহাসিক সিল্করোডের অংশ ছিল।

ইতিহাস, স্থাপত্যকলা আর ঐতিহ্য গোটা তাব্রীজ শহরকে করেছে ইরান ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণ। ওআইসি তাব্রীজকে ২০১৮ সালের ‘Exemplary tourism city’ ঘোষণা করেছে।

ফিচার ইমেজ- Financial tribune

Related Articles