কেরালার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার শৈল শহর হিসেবে পরিচিত মুন্নার এক জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে শুধু চা বাগানই নয় জলপ্রপাত, নদী, অরণ্য আর নান্দনিক পার্ক- সব মিলে শহরটি অসাধারণ সুন্দর। শান্ত, নির্মল ও নিরালা এই শহরের রাস্তাগুলোও দেখার মতো। মুথিরাপুরা, নল্লাথান্নি ও কুন্ডালা এই তিনটি পার্বত্য নদীর মিলনস্থলে শহরটি গড়ে উঠেছে।
চারদিকে শুধু সবুজ চা বাগানের সারি। কখনো কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাবারের গাছ। সারা রাস্তা জুড়ে মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি। ইংরেজ আমলে দক্ষিণ ভারতের ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারা তাদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য মুন্নার শহরটিকে নতুন রূপে গড়ে তোলেন। তখন থেকে শহরটি জনপ্রিয় রিসোর্ট টাউন হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।
এর আবহাওয়াও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভোরে তীব্র ঠাণ্ডা, আবার দুপুরে কখনো রোদ, কখনো মেঘ। বিকেলে আবার হঠাৎই বৃষ্টি। আবার বৃষ্টি থামতেই মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় চাঁদের মায়াবী আলো। স্থানীয়দের মতে, বর্ষাকালে মুন্নারের প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দর। দর্শনীয় সব জলপ্রপাত, সুউচ্চ পর্বতমালা, শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে গড়ে উঠা লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেকোনো পর্যটকের মনকে মোহিত করবে। মুন্নার শহরের কয়েকটি জনপ্রিয় স্থান থেকে চলুন ঘুরে আসি।
টাটা টি মিউজিয়াম
মুন্নারে সারিবদ্ধ ওক গাছের রূপালি সাজ আর বর্ষণস্নাত চা বাগান যে একবার দেখেছে সে-ই বুঝতে পারবে এর মহিমা। টাটা টি মিউজিয়াম এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় টি ভ্যালি ট্যুর। পাহাড়ের পর পাহাড়ে কার্পেটের মতো বিছিয়ে রয়েছে চা বাগান। কীভাবে চা তোলা হয়, কীভাবে প্রসেস করা হয় সবকিছুর সাক্ষী হওয়ার জন্য দর্শকরা এই টাটা টি মিউজিয়ামে দেখতে আসেন।
টাটা গোষ্ঠী কীভাবে এখানে চায়ের বিপ্লব এনেছে তা ডকুমেন্টারি আকারে দেখানো হয়। ডকুমেন্টারি দেখানোর পর টি ফ্যাক্টরিটা ঘুরে দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। চা আবাদের উৎস ও বিবর্তনের ইতিহাসে দেখা যায় চা শিল্পে মুন্নারের নিজস্ব উত্তরাধিকার রয়েছে। মুন্নার কীভাবে ধীরে ধীরে চায়ের জনপ্রিয় সেন্টার হিসেবে গড়ে উঠেছে তা এখানে জানা যাবে।
টপ স্টেশন ভিউ পয়েন্ট
স্থানটি মুন্নারের সর্বোচ্চ ভিউ পয়েন্ট। মুন্নার থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে মুন্নার কোদাইকানাল রোডে এই ভিউ পয়েন্ট। চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। এখান থেকে কিছুটা পথ হেঁটে, বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে যেতে হয় ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে নিচের থেনি শহরকে মনে হয় লিলিপুটদের রাজ্য।
৬,১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভিউ পয়েন্ট থেকে কুয়াশা আর মেঘের লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে প্রতিনিয়ত। টপ স্টেশন থেকে মুন্নারের প্রকৃতির এক অন্য রূপ পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। চারদিকে শুধু সবুজের প্রদর্শনী। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি ভেঙেই যেতে হয় ভিউ পয়েন্ট। ভিউ পয়েন্টের এক দিকে পশ্চিমাঘাট পর্বতমালা, অন্যদিকে তামিলনাড়ুর থেনি জেলার উপত্যকার নান্দনিক দৃশ্য দেখার মতো।
দেবীকুলম
ফিরতি পথে ঘুরে আসা যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আরেক দর্শনীয় স্থান দেবীকুলম। দেবীকুলম চা বাগানের জন্য প্রসিদ্ধ। চারদিকে চা বাগান। কোথায় রাস্তা শেষ হয়েছে আর কোথায় চা বাগানের শুরু তার তফাৎ করা যায় না। সবুজের এতো রকম বৈচিত্র্য হতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর। কোথাও গাঢ়, কোথাও নীলচে, কোথাও আবার পান্না, মনে হয় কেউ যত্ন করে সবুজ আঁচড় কেটে রেখেছে ক্যানভাসে।
মাত্তুপেট্টি
শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে মাত্তুপেট্টি ড্যামটি অবস্থিত। কুণ্ডলা, মুদ্রাপূজা ও নাল্লাথনি নদীর সংযোগ এই লেক। মাত্তুপেট্টি ড্যাম ও লেক পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। পাহাড় ঘেরা হ্রদের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য লেকের শান্ত জলে নিরিবিলি পরিবেশে বোটিং করা পর্যটকদের কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। লাগোয়া অরণ্য থেকে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে আসে হাতির দল। মাত্তুপেট্টি ড্যামের কাছেই রয়েছে একটি ডেইরি ফার্ম। ইন্দো-সুইস লাইভ-স্টক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এই ডেইরি ফার্মটিও দেখার মতো।
আনাইরাঙ্গাল ড্যাম
মুন্নারের আরও একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান আনাইরাঙ্গাল ড্যাম। মুন্নার থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে এই ড্যাম অবস্থিত। এখানে যাওয়ার রাস্তাটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। সড়ক পথে যেতে দুপাশে চোখে পড়বে খাড়া পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে ছবির মতো সুন্দর কিছু গ্রাম। এই রাস্তা মাদুরাইয়ের দিকে চলে গেছে। এর মাঝে রয়েছে একটি ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকে পাহাড়ি বন আর দিগন্ত বিস্তৃত মেঘের আনাগোনার দৃশ্য সত্যিই অতুলনীয়।
একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে অতল খাদ। মাদুরাইয়ের থেকে একটু এগোলেই পড়বে আনাইরাঙ্গাল ড্যাম। ঘন জঙ্গল আর মাঝখানে এই ড্যাম এক অসম্ভব সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করে রেখেছে। কফি, চা, এলাচ বাগানে ঘেরা আনাইরাঙ্গাল একটি পিকনিক স্পটও। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট গ্রাম্য রেস্তোরাঁয় বসে চা-কফির স্বাদ একবার চেখে না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
ইরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক
মুন্নার থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে রাজামালাই অঞ্চলে অবস্থিত ইরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক। এখান থেকে দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় আনামুদি পিক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬৯৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই পিক। অনেকেই এই পাহাড়ে ট্রেকিং করার জন্য আসেন। ইরাভিকুলাম বন এবং বন্যপ্রাণী দপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে এই শৃঙ্গে উঠা যায়।
ইরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্কে ঘোরার জন্যে বাসের ব্যবস্থা আছে। এই পার্ক বিরল প্রজাতির প্রাণী নীলগিরি থরের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও হাতি, শম্বর, দুষ্প্রাপ্য প্রজাপতি এবং পাখীদের নিয়ে এখানে নিরাপদ অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। পাহাড় থেকে কুয়াশা ঘেরা চা বাগানগুলোকে ছবির মতো মনে হয়। আর আছে নীলকুরিঞ্জি ফুল। ১২ বছরে মাত্র একবার ফোটে এই ফুল। সাড়া পাহাড় তখন ঢেকে যায় বেগুনি রঙে। সে এক অপার্থিব দৃশ্য।
এই উদ্যানের মধ্যেই আছে ইরাভিকুলাম জলপ্রপাত। এ ঝর্ণা পাহাড় বেয়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে নেমে আসছে। বৃষ্টি না পড়লে দেখতে পাবেন পশ্চিম ঘাটের পর্বতমালা। আর বৃষ্টি পড়লে তো কথাই নেই, সে এক অন্যরকম রূপ। আকাশের দিক থেকে চোখ সরাতে মন চাইবে না।
ইকো পয়েন্ট
মুন্নার থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইকো পয়েন্ট। এখানকার নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে। লেকে বোটিং করা, বুনো ফুলের মন মাতানো গন্ধ চারপাশের পরিবেশকে মোহময় করে তোলে। ইকো পয়েন্টের কয়েকটি স্থানে বিভিন্ন রকম মশলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের জিনিসপত্রের বেচাকেনার হাট বসে। আত্মীয় পরিজনদের উপহার দেওয়ার জন্য অনেকেই এখান থেকে নানা উপহার সামগ্রী কিনে থাকেন।
পল্লিভাসল
মুন্নার শুধু পাহাড়ই নয় ছোট-বড় অসংখ্য জলপ্রপাতের জন্যও বিখ্যাত। এমনই এক জলপ্রপাত পল্লিভাসল। এখানেই কেরালার প্রথম জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প অবস্থিত। মুন্নার থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে পল্লিভাসল পর্যটকদের পছন্দের এক দ্রষ্টব্য স্থান।
ব্লুজম পার্ক
মুন্নারের পথে পথে পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করে আছে নানা রকমের চমক। এমন এক চমক জাগানিয়া স্থান ব্লুজম পার্ক। প্রায় ১৬ একর জায়গা জুড়ে পার্কটি বিস্তৃত। মুন্নার থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ আর অর্কিডের সমারোহ চোখে পড়ার মতো। নানা ফুলের সমারোহে উদ্যানটি সবসময় যেন বর্ণিল হয়ে থাকে। এমন কোনো রঙ নেই যার দেখা ব্লুজম পার্কে পাওয়া যাবে না। পার্কে পর্যটকদের জন্য নৌকা ভ্রমণ, সাইকেল চালানো, রোলার স্কেটিং ইত্যাদির নানা বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
কলারিপাট্টু
মুন্নার ভ্রমণে এসেছেন আর এখানকার ঐতিহ্যবাহী কলারিপাট্টু ও কথাকলি শো দেখবেন না তা কি হয়? কলারিপাট্টু কেরলের জনপ্রিয় মার্শাল আর্ট। কেরালার বাসিন্দারা মনে করেন, মার্শাল আর্টের জন্মস্থান এই কেরালাতেই। সারাদিন ধরে মুন্নারের বিভিন্ন জায়গার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার পর সন্ধ্যা বেলায় কিছুটা অবকাশ যাপনের সুযোগে দেখে নিতে পারেন কথাকলি ও মার্শাল আর্টের শো।
মুন্নারে দেখার আছে আরো অনেক কিছু। হাতে সময় থাকলে চিন্নাকনাল, আত্তুকাল ও লাক্কোম জলপ্রপাত, ছায়া নিবিড় জঙ্গলে ঘেরা কুণ্ডলা লেক, চিন্নারে অবস্থিত বন্যপ্রাণীদের অভয়াশ্রম, কোল্লাকুমালাই টি এস্টেট , বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপের গাছ দিয়ে সাজানো রোজ গার্ডেন কিংবা ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এখানকার সবচেয়ে পুরনো সি.এস.আই খ্রিস্ট চার্চে একবার ঘুরে আসায় যায়।
This article is in Bengali language. This is a story about Munnar, the best tourist destination in India. Munar is called the 'Kashmir of South India'. Munnar in the Idukki district is acclaimed as one of the most desirable hill stations in God’s Own Country. Captivating hills and mountains, evergreen plantation areas, lush greeneries, an array of things to do and places to visit in Munnar, makes this hill station an ideal holiday destination. All the sources are hyperlinked inside the article.
Featured Image: thrillophilia.com