Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২০১৭ সালের লড়াকু ৫ নারী

অর্থবিত্তের দিক থেকে কিংবা পেশাগত ক্ষেত্রে অবস্থানের ভিত্তিতে কারা এগিয়ে আছেন- এ নিয়ে দিনের পর দিন লেখা পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠছেন পাঠকরা। সফল এই মানুষগুলো ছাড়াও প্রতিদিন এই পৃথিবীর বুকে এমন অনেক মানুষ ঘুরে বেড়ান, যাদের অসাধারণ জীবনের গল্প চমকে দেবে আপনাকে। পত্রিকার শিরোনামে আসার মতো কোনো কাজ তারা করেন না, দেশের মাথা হওয়ার যোগ্যতাও হয়তো তাদের নেই, গল্প লিখে বা সিনেমায় অভিনয় করেও মানুষকে তাক লাগিয়ে দেননি তারা। তবে কীভাবে তারা পত্রিকার বক্স নিউজে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন? ২০১৭ সাল জুড়ে আলোচিত এমন পাঁচ নারীকে নিয়ে সাজানো হলো আমাদের আজকের আয়োজন।

লেটিজিয়া বাত্তাগলিয়া

মাফিয়াদের জীবনী নিয়ে বই, সিনেমা, সিরিয়াল যা-ই তৈরি করা হোক না কেন, সাধারণত সেগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রূপালী পর্দায় কল্পিত মাফিয়াদের দেখে যারা শিহরিত হয়ে ওঠেন, তাদের জন্য লেটিজিয়া রীতিমতো নায়কের পদে আসীন হওয়ার যোগ্য। ৮২ বছর বয়সী এই নারী সিসিলিয়ান মাফিয়াদের খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং ক্যামেরায় তাদের জীবন, ভিকটিমদের করুণ দশা সব ধারণ করেছেন।

লেটিজিয়া বাত্তাগলিয়া; Source: maxxi.art

১৯৭১ সালে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর, তিন মেয়ে নিয়ে তিনি ফটোসাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লেখার সাথে কিছু ছবি যোগ করতে পারলে পাঠকের কাছে তার চাহিদা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলা যাবে। সেই চিন্তা মাথায় রেখে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মিলানে কাজ করে তিনি পাড়ি জমান সিসিলির পথে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করে প্রায় ৬ লক্ষ ছবি তোলেন লেটিজিয়া! মাফিয়া ভিকটিমদের রক্তাক্ত সেসব ছবির নাম দেন তিনি ‘আর্কাইভ অফ ব্লাড’। একই দিনে তিন-চারটি খুনের সাক্ষীও হয়েছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে আর ছবি তোলার মতো কোনো অবস্থায় ছিলেন না তিনি। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৯৫ সালে সরাসরি যুক্ত হন রাজনীতিতে। নারী এবং পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক ইস্যুগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে তার তোলা উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। সিসিলিয়ান নির্মমতার সাক্ষী দুঃসাহসী লেটিজিয়া নারী সাংবাদিকদের জন্য এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবেন।

হেন্দা আয়ারি

হেন্দা আয়ারি, উত্তর আফ্রিকার সালাফি মুসলিম পিতামাতার ফরাসি নাগরিকত্ব পাওয়া কন্যা, একাধারে একজন লেখক, নারীবাদী এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কর্মী। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়া এক পরিবারে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে, যেখানে তিনি ১০ বছর সংসার করে তিন বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি এক মুহূর্তের জন্যও। কাজেই সেই নামমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নেন হেন্দা।

হেন্দা আয়ারি; Source: twitter.com

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সরব হয়ে ওঠে #MeToo ক্যাম্পেইনে। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ভুক্তভোগীদের দলে শামিল ছিলেন হেন্দা আয়ারিও। দীর্ঘদিন ধরে নিজের মধ্যে বয়ে বেড়ানো সেই অপমানের বহিঃপ্রকাশ তিনিও ঘটান এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে। তবে তার সেই প্রতিবাদ যে এত তীব্রভাবে সবাইকে নাড়া দিয়ে যাবে, ভাবতে পারেননি খোদ হেন্দাও। ২০১২ সালের বসন্তে, প্যারিসের এক হোটেলকক্ষে তাকে ধর্ষণ করার বিরুদ্ধে যার নামে অভিযোগ তোলেন হেন্দা, তিনি তারিক রামাদান। সুইস বংশীয় এই মুসলিম পণ্ডিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সমসাময়িক ইসলামী শিক্ষা বিষয়ে পাঠদান করেন। টেলিভিশনের খুব পরিচিত মুখ তারিক, ইসলাম আর পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ে প্রায়ই টক শো করেন।

কাজেই সাধু হিসেবে পরিচিত তারিকের বিরুদ্ধে যখন ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে, স্বভাবতই তখন নড়েচড়ে বসে সচেতন সমাজ। তারিক অবশ্য এই অভিযোগ একেবারেই উড়িয়ে দিয়ে তার উকিলের হাতে পুরো ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়ে গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরতে থাকে। এদিকে পরিবার সহ চারপাশের চাপে পড়ে হেন্দা। তার বাবা-মা, প্রাক্তন স্বামী, এমনকি ১৮ বছর বয়সী বড় ছেলেও তার বিরুদ্ধে চলে যায়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হেন্দার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় তার সন্তানদের। এত কিছুর পরেও মুখ বুজে বসে থাকেননি হেন্দা, এখনো পর্যন্ত অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য লড়ে যাচ্ছেন তিনি। পোশাক-আশাকে নয়, বরং মন থেকে সবাইকে ধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

মার্গট ওয়ালস্ট্রম

আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে, সুইডেনের স্টকহোম শহরে এক লোক তার বান্ধবীর চুল টেনে ধরে ওয়ারড্রবের সাথে সজোরে মাথা ঠুকে দেয়। মেয়েটির রক্তাক্ত মাথা থেকে এক গুচ্ছ চুল উঠে আসে মানুষরূপী সেই পিশাচের হাতে। বিশের ঘরে পা রাখা মেয়েটি তখন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উঠতি কর্মী। ভয়ে সে পাশের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলে মুহূর্তের মধ্যে হাতে একটি ব্লেড নিয়ে সেখানে হাজির হয় তার নিষ্ঠুর ‘বয়ফ্রেন্ড’। ব্লেডের আঘাতের দাগটা এখনো চিবুকে বয়ে বেড়ানো সেদিনের সেই মেয়েটি আজকের ৬৩ বছর বয়সী মার্গট ওয়ালস্ট্রম, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দেশের অন্যতম তুখোড় রাজনীতিবিদ।

মার্গট ওয়ালস্ট্রম; Source: government.se

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একদল পুরুষের মধ্যে কর্তৃত্ব দেখিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি, মেয়েরাও সবই পারে। দেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ এলাকার কাঠমিস্ত্রীর কন্যা মার্গট, কখনো কলেজে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ২০১৪ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ পাওয়ার পর ‘ফেমিনিস্ট ফরেন পলিসি’ বা ‘নারীবাদী বৈদেশিক নীতি’ নামে একটি নতুন টার্ম চালু করেন তিনি। বহির্বিশ্বের সাথে সুইডেনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন মার্গট। এ বছর জাতিসংঘের ৭২ তম অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো বক্তব্য রাখেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা এবং সিরিয়াকে নিয়ে কঠোর মন্তব্য করেন তিনি। তার সেই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান মার্গট। তিনি বলেন, “ট্রাম্প ভুল সময়ে ভুল দর্শকদের সামনে ভুল বক্তব্য দিয়েছেন।”

জীবনের খুব অল্প সময়ে বাকি আছে বলে মনে করেন তিনি। তাই কোনো ককটেল পার্টিতে যোগ না দিয়ে সে সময়ে বরং কূটনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতেই পছন্দ করেন মার্গট। নারীদের ব্যাপারে সংবেদনশীল মার্গট সৌদি আরবের নারীবিদ্বেষী ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। গত ২০ বছরে নিজেকে তিনি যেভাবে পরিবর্তিত করে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন, তা যেন অন্যান্য নারীদেরও অনুপ্রাণিত করে, এটিই তার প্রত্যাশা।

আসলি এরদোগান

সন্দেহের বশে যদি আপনার প্রিয় লেখককে ১৩২ দিন জেলে কাটাতে হয়, কেমন লাগবে আপনার? আপনার কথা ছাড়ুন, ঐ লেখকের কী অবস্থা হবে, একবার তা চিন্তা করে দেখুন। তুরস্কে বিশাল এক পাঠকগোষ্ঠী থাকা জনপ্রিয় লেখক এরদোগানকে ভোগ করতে হয়েছিল চার মাসের কারাবাস। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ইস্তানবুল থেকে, অভিযোগ ছিল, তিনি নাকি কুর্দি বাহিনী পরিচালিত কোনো এক পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হলেও আটকে রাখা হয়েছে তার পাসপোর্ট, ‘সন্ত্রাসী’র তকমা থেকে এখনো অব্যাহতি দেওয়া হয়নি তাকে।

আসলি এরদোগান; Source: kurdishdailynews.org

আটটি বই লিখেই কেবল তুরস্কে নয়, ইউরোপেও নিজের জায়গা করে নিয়েছেন আসলি। এরিখ মারিয়া রিমার্ক শান্তি পুরষ্কার থেকে শুরু করে ইস্তাম্বুলে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আরও অনেক পুরষ্কার গ্রহণ করেন তিনি। এ বছর সরকারের সাথে একপ্রকার লড়াই করে নিজের পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিয়ে জার্মানি চলে আসেন তিনি। যেখানে ‘ওজগার গান্ডেম’ নামক কুর্দি পত্রিকাটির সম্পাদক নিজেও তাদের সাথে আসলির সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন, সেখানে নিছক সন্দেহের বশে, হাতে কোনো যথাযথ প্রমাণ না রেখেও দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করা হয়েছে আসলির উপর। তবে সরকারের এই অন্যায় মেনে নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। খুব শীঘ্রই দেশে ফিরে এসে শুধু তার উপর নয়, সকল বুদ্ধিজীবীর উপর করা অন্যায়-অবিচারের বিচার করতে ভক্তদের সাহায্য চেয়েছেন তিনি।

মানাল আল শরীফ

১৪ বছর বয়সে মানাল আল শরীফকে মানতে হচ্ছিল, ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের গান শোনা যাবে না, ফ্যাশন ম্যাগাজিন কিংবা আগাথা ক্রিস্টিকেও বলতে হবে বিদায়। আর দশজন সৌদি নারীর মতো তাকেও মেনে চলতে হবে কড়া বিধিনিষেধ। শৈশবে দেখেছেন মায়ের উপর বাবার অত্যাচার, নিজেও শিকার হয়েছেন স্বামীর অত্যাচারের। তার মায়ের মৃত্যুর পর একদিন অনেক পুরনো এক পারিবারিক ছবিতে লাল পোশাকে নিজেকে দেখে বদলে যায় তার জীবনবোধ। তিনি বুঝতে পারেন, জীবনের মানে নিজেকে চার দেয়ালে বন্দী করে রাখা নয়। #IAmMyOwnGuardian লেখা একটি রিস্টব্যান্ড হাতে দিয়ে নেমে পড়েন সৌদি নারীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে।

বিজয়ীর ভঙ্গীতে মানাল আল শরীফ; Source: cnn.com

কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন তিনি, সে সময় নানা দেশের মানুষের সাথে পরিচিত হন, স্কিইং থেকে শুরু করে গাড়ি চালানো সবকিছুই রপ্ত করেন। ২০১১ সালে তিনি কাজ করতেন সৌদি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি ‘আরামকো’তে, তাদের নির্দিষ্ট কম্পাউন্ডেই তিনি থাকতেন, এর ভেতরে গাড়ি চালানোরও সুযোগ ছিল। একদিন তার মনে হলো, নিজের এলাকায় গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া উচিৎ। কাজেই এক বন্ধুকে পাশে বসিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়ালেন তারা দুজন। মানালের সেই ড্রাইভিংয়ের ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে আপলোড করেন বন্ধু। সৌদি এক নারী গাড়ি চালাচ্ছে, এই ভিডিও খুব দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়ে ইউটিউব সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। ভাগ্য খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিল না তার। গাড়ি চালানোর অপরাধে মানাল আল শরীফকে জেলে পাঠিয়ে দেয় সৌদি আরব সরকার। হিলারি ক্লিনটন তখন বলেছিলেন, সৌদি এই নারী যা করছে, তাতে তাকে সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত করা ছাড়া কোনো শাস্তি দেয়ার কথা ভাবাও উচিৎ না। জেল থেকে বেরিয়ে এসে কম্পিউটার বিজ্ঞানীর চাকরি ছেড়ে পুরোদমে নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নেমে পড়েন তিনি।

মানালের দুঃসাহসিক সেই পদক্ষেপে কিছুটা যেন হকচকিয়ে যায় সৌদি সরকার। তার চাপে পড়ে এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দিতে সম্মত হয় সরকার। ‘ডেয়ারিং টু ড্রাইভ: অ্যা সৌদি ওমেন’স অ্যাওয়েকেনিং’ নামক বইতে নিজের বিজয়ের অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরেছেন মানাল। তার ছেলেও বড় হয়ে মাকে বুঝবে, নারীদের ক্ষমতায়নে অংশ নেবে এমনটাই প্রত্যাশা তার।

ফিচার ইমেজ- themaven.net

Related Articles