Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যাম্প বুকা: আইএসের জন্মের নেপথ্যে যে মার্কিন কারাগার!

জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট তথা আইএসের উৎপত্তি কীভাবে, সেটি নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক জল্পনা-কল্পনা আছে। আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির অতীত পরিচয় এবং তার তথাকথিত খিলাফত ঘোষণার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়েও গবেষকদের মধ্যে বিভিন্ন বিতর্ক আছে। বাগদাদির প্রকৃত নাম শিমন এলিয়ট, সে আসলে মোসাদ এজেন্ট, মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইনের সাথে তার গোপন বৈঠক হয়েছিল- এ জাতীয় বিভিন্ন তথ্যও ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইটে পাওয়া যায়। এ তথ্যগুলো অবশ্য সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং ভুয়া প্রচারণা; কিন্তু এগুলো মিথ্যা হলেও আইএসের সৃষ্টির পেছনে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রহস্যজনক ভূমিকা ছিল এবং বাগদাদির আইএসের নেতা হয়ে ওঠার পেছনেও যে আমেরিকার অবদান ছিল, সেটি মোটেও মিথ্যা নয়।

২০০৪ সালে বাগদাদি প্রায় ১০ মাস ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত কারাগার ক্যাম্প বুকায় বন্দী ছিলেন। শুধু বাগদাদি না, আইএসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অন্তত ৯ জন নেতাই (মতান্তরে ১৮ জন) কোনো না কোনো সময় এই কারাগারে বন্দী ছিল। অনেক গবেষকের মতে, আইএসের সৃষ্টির পেছনে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এই ক্যাম্প বুকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এক সময়ের ক্যাম্প বুকার বন্দী এবং পরবর্তীতে আইএসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আবু আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী,

“যদি ইরাকে কোনো মার্কিন কারাগার না থাকত, তাহলে এখন আইএসের কোনো অস্তিত্বই থাকত না। বুকা ছিল একটি কারখানা। এটি আমাদেরকে তৈরি করেছে। এটি আমাদের আদর্শ গড়ে তুলেছে।”

আইএসের প্রধান নেতারা, যারা ক্যাম্প বুকায় বন্দী ছিল; Source: Al Arabiya

বাগদাদির বেড়ে ওঠা থেকে বুকায় আগমন

বাগদাদির জন্ম ১৯৭১ সালে, ইরাকের সামারা শহরে। তার প্রকৃত নাম ছিল ইবরাহিম আওয়াদ ইবরাহিম আল-বাদরি আল-সামারি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের কুরআন তিলাওয়াতের শিক্ষক। বাগদাদির ভাই শামসির বক্তব্য অনুযায়ী, ছোটবেলা থেকেই বাগদাদি বেশ ধার্মিক ছিলেন। স্কুলের বাইরে বেশিরভাগ সময় তিনি স্থানীয় মসজিদে কাটাতেন এবং রাতে যখন ঘরে ফিরে আসতেন, তখন পরিবারের কাউকে কোনো অনৈসলামিক কাজ করতে দেখলে তাকে তিরস্কার করতেন।

কিন্তু বাগদাদি বেশিদিন শুধু ধার্মিক হিসেবে নিজের পরিচয় সীমিত রাখেননি। কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি ধীরে ধীরে উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সাদ্দাম ইউনিভার্সিটি ফর ইসলামিক স্টাডিজে কুরআন তিলাওয়াতের উপর মাস্টার্স করার সময় বাগদাদি তার চাচা ইসমাইল আল-বাদরির অনুরোধে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন। কিন্তু ইরাকের মধ্যপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড বাগদাদিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তিনি ব্রাদারহুডকে ‘শুধু কথায় বিশ্বাসী, কাজে নয়’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং তার বড় ভাই জুমা ও আশির দশকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করা মুহাম্মদ হারদান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্রাদারহুড ছেড়ে বেরিয়ে এসে অপেক্ষাকৃত উগ্রপন্থী সালাফি জিহাদীদের সাথে যোগ দেন।

ক্যাম্প বুকায় বাগদাদির রেকর্ড ফাইল; Source: Northern German Broadcasting

২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী যখন ইরাক আক্রমণ করে, সে সময় বাগদাদি বাগদাদের হাজি জাইদান মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে চাকরি করতেন এবং ছোটদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শেখাতেন। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর দখলদার মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইরাকের বিভিন্ন স্থানে যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছোট ছোট মিলিশিয়া গ্রুপ তৈরি হতে থাকে, সে সময় বাগদাদিও ‘জাইশ আল-সুন্নাহ ওয়াল-জামা’আ’ নামক একটি সংগঠন সৃষ্টির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে বাগদাদি ফাল্লুজাতে তার এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে মার্কিন বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। সে সময় মার্কিন বাহিনী কোনো অভিযোগ ছাড়া শুধুমাত্র চেহারা সন্দেহজনক মনে হলেই যেকোনো যুবককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেত। বাগদাদির ঐ বন্ধুটি মার্কিন বাহিনীর ওয়ান্টেড লিস্টে থাকলেও বাগদাদির বিরুদ্ধে তখনও পর্যন্ত কোনো অভিযোগ ছিল না। গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে ক্যাম্প বুকা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, তাকে ‘সিভিলিয়ান ডিটেইনি’ তথা বেসামরিক বন্দী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ কারাগারের নথি অনুযায়ী, বাগদাদি কোনো গ্রুপের সাথে যুক্ত ছিল কিনা, তা কারাগার কর্তৃপক্ষ জানত না।

কী এই ক্যাম্প বুকা?

ক্যাম্প বুকা ইরাকের উম্ম কাস্‌রে অবস্থিত একটি কারাগার, যা সম্পূর্ণ মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হতো। ২০০৪ সালে বাগদাদের আবু গারিব কারাগারে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক ইরাকি বন্দীদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের সংবাদ এবং ছবি ফাঁস হলে বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দা এবং সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। ফলে মার্কিন সেনাবাহিনী নড়েচড়ে বসে এবং তাদের ‘হারানো সুনাম’ পুনরুদ্ধার করার জন্য ক্যাম্প বুকাকে আদর্শ কারাগার হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

এখানে বন্দীদেরকে তাদের ভালো আচরণের পুরস্কার হিসেবে চা, সিগারেট খাওয়া, রেডিও শোনা বা টিভি দেখার সুযোগ দেওয়া হতো। বন্দীদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল। বন্দীরা নিজেরাই সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে শিখন-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে পারত। বন্দীদেরকে সময়ে সময়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হতো।  ২৬,০০০ বন্দী ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট কারাগারটি ২৬টি ক্যাম্পে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি ক্যাম্পে ছিল ১,০০০ বন্দী, যারা নিজেরা তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারতো। সেই নেতারা তাদের দেখাশোনা করত এবং ক্যাম্পের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখত।

ক্যাম্প বুকায় ইরাকি বন্দীরা; Source: Associated Press

২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট ছয় বছর ক্যাম্প বুকা চালু ছিল। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ইরাকি বিভিন্ন মেয়াদে এই কারাগারে বন্দী ছিল। এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই ছিল সত্যিকার চরমপন্থী, আবু মুসাব আল-জারকাওইর অধীনস্থ আল-কায়েদার ইরাকি শাখার সদস্য। একটা বড় অংশ ছিল আত্মীয়-স্বজনদেরকে নিহত, নির্যাতিত, ধর্ষিত হতে দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদেরকে সাহায্যকারী তৎকালীন শিয়া সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া বিক্ষুদ্ধ ইরাকি যোদ্ধা। আর বাকি অধিকাংশই ছিল নিরাপরাধ, যারা শুধুই সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার হয়েছিল।

কিন্তু ক্যাম্প বুকায় থাকাকালীন মার্কিনীদের চোখের সামনেই এই অল্পসংখ্যক আল-কায়েদা সদস্যের প্রভাবে সাধারণ বন্দীরাও ধীরে ধীরে তাদের তাদের চরমপন্থী মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়ে। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে বের হয়ে তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে। অনেকেই যোগ দেয় আল-কায়েদার ইরাকি শাখায়, যে সংগঠনটিই পরবর্তীতে ধাপে ধাপে আইএসে বিবর্তিত হয়। সাবেক মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু থম্পসন এবং গবেষক জেরেমি সুরির ভাষায়,

ক্যাম্প বুকা ছিল সন্ত্রাসবাদের বিশ্ববিদ্যালয়, কট্টর মৌলবাদিরা ছিল এর প্রফেসর, অন্যান্য বন্দীরা ছিল এর শিক্ষার্থী, আর কারারক্ষীরা ছিল এর অনুপস্থিত কর্তৃপক্ষ।

ক্যাম্প বুকাতে বাগদাদির ভূমিকা

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ গুরুত্বপূর্ণ এক আইএস সদস্য আবু আহমেদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে, যিনি দীর্ঘদিন ক্যাম্প বুকায় বন্দী ছিলেন। তার বর্ণনায় ক্যাম্প বুকা এবং সেখানে অবস্থানকালীন বাগদাদির ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে।

আবু আহমেদ ছিলেন আল-কায়েদার সেই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে একজন, যারা পরবর্তীতে আইএস গঠন করে। ইরাকে মার্কিন বাহিনীর আক্রমণের পরপরই অন্য অনেকের মতো আবু আহমেদ অস্ত্র হাতে তুলে নেন এবং মার্কিন সেনা ও তাদের সহযোগী শিয়া মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ফলে তিনি সহজেই আইএসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু আইএসের ক্রমবর্ধমান নৃশংসতা ইসলামের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে থাকায় তিনি ধীরে ধীরে সংগঠনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। ফলে তিনি গার্ডিয়ানের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন।

গ্রেপ্তারের পর ক্যাম্প বুকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বন্দীদের; Source: Associated Press

আবু আহমেদের সাথে বাগদাদির প্রথম দেখা হয় ক্যাম্প বুকাতে। কিন্তু সে সময় বাগদাদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতা ছিলেন না। এমনকি তিনি সে সময় আল-কায়েদার সাথেও সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তবে আবু আহমেদের মতে, বাগদাদি তার ইসলামের উপর জ্ঞান, তার বংশমর্যাদা (দাবি করা হয় তিনি রাসূলের (সা:) উত্তরসূরী) প্রভৃতি ব্যবহার করে কারাগারের ভেতরে এবং পরবর্তীতে বাইরে নিজেকে অন্যদের চেয়ে পৃথক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

আবু আহমেদ বলেন,

“বাগদাদি বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতেন। তিনি ছিলেন সহজাত ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাকে দেখেই মনে হতো তিনি গুরুত্বপূর্ণ কেউ। কিন্তু কারাগারে তার চেয়েও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল। আমি কখনোই ভাবিনি যে তিনি এতদূর আসতে পারবেন।”

আবু ওমর নামে আরেকজন সাবেক বন্দী বলেন, সে সময়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দীদের তুলনায় বাগদাদি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলেন না। অন্যান্য বন্দী, যেমন আবু মোয়াজ বা আবু মোহাম্মদ আল-আদনানি (পরবর্তীতে আইএসের মুখপাত্র)– এরাই ছিলেন মূলত বড় নেতা।

তবে আবু আহমেদের মতে, মার্কিন কারারক্ষীদের সাথে বাগদাদির সুসম্পর্ক ছিল। মার্কিনীরা তাকে সম্মান করত। তারা তাকে বিভিন্ন পক্ষের বন্দীদের মধ্যকার বিবাদ এবং সংঘর্ষ সমাধানের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করত। তার বক্তব্য অনুযায়ী,

“যখনই কারাগারে কোনো সমস্যা তৈরি হতো, বাগদাদি থাকতেন তার কেন্দ্রে। তিনি চাচ্ছিলেন বন্দীদের নেতা হয়ে উঠতে। এখন যখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই, তখন বুঝতে পারি, তিনি আসলে বন্দীদের মধ্যে বিভাজন এবং মতবিভেদ সৃষ্টি করে এবং সেগুলোর সমাধান করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করছিলেন। এবং তার এই পদ্ধতি ভালোই কাজ করেছিল।”

নামাজ পড়ছে বন্দীরা; Source: Associated Press

বাগদাদির বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ না থাকায় এবং মার্কিন সেনাদের সুনজরে থাকায় তাকে বেশিদিন কারাগারে থাকতে হয়নি। মাত্র ১০ মাস পরে, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের ৮ তারিখে বাগদাদিকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে বাগদাদির সাথে কারাগারে অবস্থিত আল-কায়েদার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।

সে সময় ইরাকে মার্কিন বিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আবু মুসাব আল-জারকাওই, যিনি ওসামা বিন লাদেনের সমর্থন নিয়ে ইরাকে আল-কায়েদার শাখা, আল-কায়েদা ইন ইরাক তথা একিউআই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুরু থেকেই কট্টর শিয়া বিরোধী এবং নৃশংসতায় বিশ্বাসী হিসেবে গ্রুপটির পরিচিতি ছিল। আবু আহমেদের মতে, কারাগারে সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের অধিকাংশই ছিল জারকাওইর এই সহযোদ্ধারা। তারাই মূলত অন্য বন্দীদেরকে প্রশিক্ষণ দিত। তিনি ধারণা করেন, বাগদাদির সাথেও এই নেতাদের অনেকের পরিচয় হয়েছিল। কারণ, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই বাগদাদি আল-কায়েদা ইন ইরাকে যোগ দেন, যে দলটিই পরবর্তীতে ধাপে ধাপে আইএস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বাগদাদির হাত ধরে আইএসের সৃষ্টি

কারাগার থেকে বেরিয়েই বাগদাদি ক্যাম্প বুকায় পরিচয় হওয়া এক সহবন্দীর সাথে যোগাযোগ করে আল-কায়েদা ইন ইরাকে যোগদান করেন। তবে সে সময় তিনি ছিলেন একেবারেই নিচের দিকের একজন সদস্য। ২০০৬ সালে জর্ডানের গোয়েন্দা বাহিনীর সহযোগিতায় মার্কিন বিমান হামলায় দলটির নেতা আবু মুসাব আল-জারকাওই নিহত হলে নতুন নেতা হন আবু ওমর আল-ইরাকি। এ সময় দলটি নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক তথা আইএসআই নাম ধারণ করে।

মূলত এই সময়েই বাগদাদি ধীরে ধীরে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন। ততোদিনে কুরআন তিলাওয়াতের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করায় তাকে আইএসআই-এর ধর্ম বিষয়ক শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল তার। সেটি হচ্ছে আইএসআই-এর পক্ষ থেকে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন এবং তার ডেপুটি আইমান আল-জাওয়াহিরির সাথে যোগাযোগ করা। আবু আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, আইএসআই-এর মধ্যে বাগদাদিই ছিলেন বিন লাদেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ

ক্যাম্প বুকার প্রবেশ পথে মার্কিন সেনারা; Source: Getty Images

২০১০ সালে ইরাকি-মার্কিন যৌথ আক্রমণে আইএসআই প্রধান আবু ওমর আল-বাগদাদি এবং তার ডেপুটি আবু আইয়্যুব আল-মাসরি নিহত হলে আবু বকর আল-বাগদাদি দলটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবু আহমেদের মতে, যারা বিভিন্ন সময় ক্যাম্প বুকাতে বন্দী ছিল, তারা সবাই এই সময়ে বাগদাদির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাগদাদির ডেপুটি আবু মুসলিম আল-তুর্কমানি, সাবেক ডেপুটি আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি, আইএসের মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল-আদনানি, সিনিয়র মিলিটারি লিডার আবু আইমান আল-ইরাকি সহ আরো অনেকেই এ সময় বাগদাদির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, যারা সবাই এক সময় ক্যাম্প বুকায় বন্দী ছিল। এ সময় সাবেক বাথ পার্টির জেনারেলরা, যারা ক্যাম্প বুকাতে বন্দী ছিল, তারাও আইএসআইয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করে।

২০১১ সালে সিরিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে, আল-কায়েদা নেতা আইমান আল-জাওয়াহিরির পরামর্শে বাগদাদি তার ডেপুটি আবু মোহাম্মদ আল-জুলানিকে আল-নুসরা ফ্রন্টের দায়িত্ব দিয়ে সিরিয়াতে পাঠান। পরবর্তী ২০১৩ সালে বাগদাদি ইরাক এবং সিরিয়া নিয়ে ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া তথা আইসিস গঠনের ঘোষণা দিলে জুলানি তা মানতে অস্বীকার করেন, এবং আল-কায়েদা নেতা আইমান আল-জাওয়াহিরির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। তারই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে বাগদাদি বিশ্বব্যাপী খিলাফত ঘোষণা করেন এবং নিজেকে খলিফা দাবি করে বসেন।

আল-কায়েদার এই অংশটির খিলাফত ঘোষণার প্রচেষ্টা অবশ্য নতুন ছিল না। আবু মুসাব আল-জারকাওই শুরু থেকেই ইরাকে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে খিলাফত ঘোষণার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ওসামা বিন লাদেন তাকে বারবার নিবৃত্ত করেন এই বলে যে, এতে সামগ্রিকভাবে মুসলিম বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বিন লাদেনের মৃত্যু পরবর্তী আল-কায়েদা এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের জটিল বাস্তবতা জারকাওইর উত্তরসূরী বাগদাদীর সামনে সে সুযোগ এনে দেয়।

আইএস সৃষ্টিতে ক্যাম্প বুকার ভূমিকা

আইএসের তথাকথিত খিলাফত ঘোষণার অনেক আগে, ২০০৯ সালেই আল-জাজিরা ক্যাম্প বুকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনে ক্যাম্প বুকাকে ‘আল-কায়েদার স্কুল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আদেল জাসেম মোহাম্মদ নামে এক সাবেক বন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্দীদের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের যে সুবিধা ছিল, তার সুযোগে চরমপন্থী আল-কায়েদা সদস্যরা সাধারণ বন্দীদেরকে চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ করতো। এমনকি তারা ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে বোমা বানানো, বন্দুক চালানো, আত্মঘাতী হওয়ার পদ্ধতিও শিক্ষা দিত। আর এসবই ঘটত আমেরিকান কারারক্ষীদের সামনেই!

গার্ডিয়ানের সাথে সাক্ষাৎকারে আবু আহমেদও একই রকম বক্তব্য দেন। তার মতে, ক্যাম্প বুকার পরিবেশ তাদের জন্য চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেন,

“বাগদাদ বা অন্য কোথাও এভাবে একত্রিত হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেটা অসম্ভব বিপজ্জনক হতো। ক্যাম্প বুকায় আমরা যে শুধুমাত্র নিরাপদ ছিলাম তা-ই না, আমরা সমগ্র আল-কায়েদার নেতৃত্ব থেকে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরত্বের মধ্যে ছিলাম।”

নামাজের পর বিশ্রাম নিচ্ছে বন্দীরা; Source: Associated Press

আবু আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, কারাগারে বন্দীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, অর্থাৎ একিউআইর নেতারা নিয়মিত মিটিং করত। তিনি বলেন,

“আমাদের পরিকল্পনা করার মতো প্রচুর সময় ছিল। এটা ছিল একেবারে উপযুক্ত পরিবেশ। আমরা একমত হয়েছিলাম যে, কারাগার থেকে বেরিয়ে আমরা আবার একত্রিত হব।”

আবু আহমেদ এবং অন্য বন্দীরা নিজেদের মধ্যে ঠিকানা এবং ফোন নম্বর বিনিময় করেন। নিরাপদে ঠিকানা সংরক্ষণ করার অন্য কোনো উপায় না থাকায় তারা তাদের অন্তর্বাসের ইলাস্টিকের ফিতায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখেন। এরপর জেলখানা থেকে বের হওয়ার পরপরই তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করেন এবং পুনরায় আমেরিকা ও শিয়া মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তার ভাষায়, ক্যাম্প বুকার সেই অন্তর্বাসগুলোই তাদেরকে যুদ্ধে জয়লাভ করতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল!

ক্যাম্প বুকাতে বন্দী অনেকেই বন্দী হওয়ার আগে উগ্রপন্থী ছিল না। কিন্তু কারাগারের পরিবেশ, সেখানে অপেক্ষাকৃত চরমপন্থীদের সংস্পর্শ তাদের জীবনের পথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। অনেক মার্কিন গবেষকও এটা স্বীকার করেন। গবেষক জেরেমি সুরি বলেন,

“বাগদাদি গ্রেপ্তারের আগে থেকেই সহিংস জিহাদী ছিল, কিন্তু কারাগারে অবস্থান তার চরমপন্থাকে আরও বৃদ্ধি করেছে এবং তাকে সুযোগ দিয়েছে তার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার।”

বন্দীদের শরীর তল্লাশী করা হচ্ছে; Source: Associated Press

ক্যাম্প বুকার দায়িত্বে থাকা সাবেক প্রিজন কমান্ডার জেমস স্কাইলার জেরন্ড বলেন,

“ক্যাম্প বুকায় আমরা অনেকেই এ নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম যে, আমরা বন্দীদেরকে শুধুমাত্র আটক করে রাখার পরিবর্তে চরমপন্থার একটি প্রেশার কুকার তৈরি করে ফেলেছি।”

বন্দীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত চরমপন্থীদেরকে খুঁজে বের করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করত। ক্যাম্প বুকার একটি কম্পাউন্ডের দায়িত্বে থাকা রক্ষী গ্রেগ নিউইয়র্ক পোস্টের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একটি পদ্ধতি ছিল এরকম যে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা বন্দীদেরকে একটি কক্ষে আটকে রেখে তার উপর গোপনে নজর রাখা হতো। সেই কক্ষে আগে থেকেই অশ্লীল ছবি বিশিষ্ট ম্যাগাজিন রাখা থাকত। বন্দী যদি ম্যাগাজিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত, তাহলে তারা ভেবে নিত যে, সে হয়তো উগ্রপন্থী হতে পারে। ফলে তাকে একই জাতীয় অন্য বন্দীদের সাথে স্থান দেওয়া হতো।

তার মতে, পদ্ধতিটি সাময়িকভাবে কারাগারে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে কার্যকর হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ। সব উগ্রপন্থী যোদ্ধাকে একত্রে স্থান দিয়ে আমেরিকা মূলত সন্ত্রাসীদের মিলনমেলা সৃষ্টি করে দিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, ভেতরে অবস্থিত নেতাদের সংস্পর্শ পাওয়ার জন্য অনেক সাধারণ আল-কায়েদাও সদস্য স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে ক্যাম্প বুকায় বন্দীত্ব বরণ করত।

আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করছে বন্দীরা; Source: Associated Press

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুফান, আইএসের সৃষ্টির পেছনে ক্যাম্প বুকার ভূমিকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। তাদের মতে, ক্যাম্প বুকা পাশাপাশি বন্দী চরমপন্থী আল-কায়েদা সদস্য এবং সাদ্দামের বাথ পার্টির জেনারেলদের মধ্যে এক অদ্ভুত মৈত্রী গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করে দেয়। আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যধারী দুটো দল কাছাকাছি লক্ষ্য নিয়ে উভয়ের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে একত্রিত হয়। সুফানের মতে, চরমপন্থীদের মধ্যে বাথিস্ট জেনারেলরা খুঁজে পায় উদ্দেশ্য, আর বাথিস্ট জেনারেলদের মধ্যে চরমপন্থীরা খুঁজে পায় সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সামরিক প্রক্রিয়া। আল-জাজিরার ভাষায় যেটা ছিল আমেরিকা পরিচালিত ‘আল-কায়েদার স্কুল’, কালক্রমে সেটাই রূপ নেয় আইএস নামধারী বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নৃশংস জঙ্গী গোষ্ঠীতে।

সন্ত্রাসবাদকে অনেকভাবে উস্কে দেওয়া যায়। একটি পদ্ধতি হচ্ছে বিমান হামলা করে কোনো রাষ্ট্রকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া, এরপর সেখানকার নিরাপরাধ মানুষকে, নারী-শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা, কোনো প্রমাণ ছাড়াই সন্দেহ হওয়া মাত্র যেকোনো মানুষকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা, নারীদেরকে ধর্ষণ করা। এরকম চলতে থাকলে সেই দেশের জীবিত মানুষদের একটি অংশ, বিশেষত যারা আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছে, তারা স্বভাবতই সশস্ত্র প্রতিরোধের দিকে ঝুঁকে পড়বে। সেটাকে ন্যায় সঙ্গত সংগ্রাম বলা হবে, নাকি সন্ত্রাসবাদ বলা হবে, সেটা নির্ভর করবে কিছুটা তাদের কর্মকাণ্ডের উপর, আর বাকিটা গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গির উপর।

ক্যাম্পের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বন্দীরা; Source: Associated Press

আর দ্বিতীয় আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, যারা অস্ত্র হাতে নিয়েছে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, দাবি-দাওয়া পূরণের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ নিবৃত্ত করার চেষ্টা না করে, তাদের সাথে আলোচনায় না গিয়ে, অথবা তাদেরকে যথাযথভাবে আইনের আওতায় না এনে বরং তাদেরকে আরও উস্কে দেওয়া, তাদের অস্ত্রের প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে বিভিন্নভাবে সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়।

ক্যাম্প বুকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুই পদ্ধতির অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়েছে। তারা প্রথমে ইরাক ধ্বংস করে, মানুষকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করেছে। এরপর তাদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত চরমপন্থীদেরকে খুঁজে বের করে, গ্রেপ্তার করে, একত্রে রেখে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ঠিক ‘আইএস’ নামক সংগঠনটিকেই সৃষ্টি করেছে কিনা, সেটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা না গেলেও আইএসের মতো একটি উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেন সৃষ্টি হতে পারে, সেটা তারা নিশ্চিত করেছে। ব্যক্তি ‘বাগদাদি’ আমেরিকার এজেন্ট কিনা, সেটা এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত সত্য না হলেও অদূর ভবিষ্যতে যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে, একিউআই’র যে নেতারা বাগদাদি সহ অন্যান্য ভবিষ্যত আইএস নেতাদেরকে ক্যাম্প বুকায় চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আসলে মার্কিন এজেন্ট ছিল, তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

ফিচার ইমেজ- Associated Press

Related Articles