নিয়ম যেমন সুবিধা তৈরি করে দেয়, তেমনি নিয়ে আসে কিছু বাড়তি সমস্যাও। দীর্ঘ ২০ বছর পর রাশিয়া, কাজাখস্থান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান ও ইরানের মধ্যে হওয়া কাস্পিয়ান চুক্তিও ঠিক তেমন একটি ব্যাপার। কাস্পিয়ান সাগরের সম্পদ বন্টন এবং আইনী সমস্যা নিয়ে চলা ঝামেলাগুলোর একটি সুরাহা করবে এই চুক্তি- এমনটাই মনে করছেন সবাই। তবে, বাস্তবে কি সেটা হচ্ছে? হলেও তার পরিমাণ কতটা? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, কাস্পিয়ান সাগর নিয়ে কেন এত কাড়াকাড়ি। কী নেই এই সমুদ্রে? খনিজ সম্পদ হিসেবে গ্যাস আর তেল তো আছেই, একইসাথে কাস্পিয়ান সাগরে আছে প্রচুর পরিমাণ মাছ। স্টাজান মাছ তার মধ্যে সবচাইতে বেশি মূল্যবান, যার ব্ল্যাক ক্যাভিয়ার রাশিয়ার কালোবাজারে বিক্রি হয় কেজি প্রতি ৩৮০ ডলারে। তবে এই চুক্তির ফলে মৎস্যজীবীদের কতটা লাভ হচ্ছে?
হিসাব করলে ফলাফলটা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। কাস্পিয়ান চুক্তিটি হয়েছে ৫টি দেশের মধ্যকার সমস্যা দূর করতে। এই চুক্তি অনুসারে, কাস্পিয়ানকে একইসাথে সমুদ্র ও হ্রদ বলে মনে করা হবে। হ্রদ হিসেবে এর পানি ভাগ হবে পাঁচটি দেশের মধ্যে। আর সমুদ্র হিসেবে পাঁচটি দেশ পাবে নির্দিষ্ট তটরেখা। পানির উপরিভাগ ও নিম্নভাগের বাটোয়ারা আলাদাভাবে হবে।
কাস্পিয়ান সাগরের মূল দখল প্রাথমিকভাবে ছিল ইরানের হাতে। পূর্বে এর নাম ছিল প্যারাটিথে সাগর। পরবর্তীতে ১৮২০ সালে ইরান সাগরের উত্তর অংশের উপরে দখল হারায়। যুদ্ধে জিতে রাশিয়া নিজেদের অধিকারে আনে অংশটি। এরপর থেকে কাস্পিয়ান সাগর নিয়ে নানারকম জটিলতায় লিপ্ত ছিল পার্শ্ববর্তী ৫টি দেশ। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে কাস্পিয়ান সাগরের জীবসম্পদের ব্যাপারে রাশিয়া, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান এবং কাজাখস্থান একটি কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনই এখন পর্যন্ত কাস্পিয়ান সাগর ও এর সম্পদ নিয়ে কাজ করা একমাত্র সংগঠন।
২০০৯ সালে স্টাজান মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা প্রতিবছর নবায়ন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মাছের এই বিশেষ প্রজাতিকে রক্ষার জন্য নিষেধাজ্ঞার দরকার আছে বলে মনে করেন। তবে শুধু নিষেধাজ্ঞায় কাজ হয় না বলেই কড়াকড়ির প্রয়োজন পড়ে, এমনটাই জানান তারা। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত কাস্পিয়ান সাগর সংক্রান্ত প্রায় ৩,০০৯টি মামলা করা হয়েছে প্রশাসনিকভাবে। ৪৭টি ছিল অপরাধ সংক্রান্ত মামলা। অন্যদিকে, সীমান্তপ্রহরীরা এখন পর্যন্ত প্রায় ১,৩৫৮ কেজি স্টাজান মাছ জব্দ করেছেন জেলেদের কাছ থেকে।
একদিকে, ব্ল্যাক ক্যাভিয়ার কাস্পিয়ান সাগরের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ। রাশিয়ায় ক্যাভিয়ার চোরাচালান করা অবৈধ। তাই এই আইনের কড়াকড়ির কারণে মৎস্যজীবীদের আয়ের পথে অনেকটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আগেই। অন্যদিকে, কাস্পিয়ান চুক্তির কারণে আরো নতুন কিছু নিয়ম আরোপিত হয়েছে, যেগুলো তাদের জীবিকা উপার্জনকে অনেক বেশি কঠিন করে তুলছে।
কাস্পিয়ান সাগরের তীরেই অবস্থিত দাগেস্তান শহর। এই শহর থেকে ঘন্টাখানেক দূরে ক্রেনোভকা গ্রামের বাসিন্দারা জীবিকার জন্য সবসময় কাস্পিয়ান সাগরের উপরই নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে এই গ্রামের বাসিন্দার সংখ্যা মোট ২,৬৪৮ জন। ষাটের দশকে এই গ্রামে মানুষ কাস্পিয়ান সাগর থেকে মাছ ধরাকে নিজেদের পেশা বানিয়ে ফেলে। সেসময়, এখানে নির্মিত হয় মাছের কারখানা। দূর থেকে সবাই এই কারখানায় কাজ করতে আসতো তখন।
কেবল কারখানার কাজে নয়, ব্যক্তিগতভাবেও মানুষ মাছ ধরতো তখন এই গ্রামে। তেমনই একজন হলেন রুজলান আমিরভ। আরো অনেকের মতো জীবিকার তাগিদে বাবা-মায়ের সাথে এই গ্রামে চলে আসেন তিনি ৫-৬ বছর বয়সে। মাত্র ১১ বছর বয়স থেকেই সাগরে মাছ ধরতে শুরু করেন তিনি। নিজের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রুজলান বলেন,
আগে এমন মাছের অভাব ছিলো না সমুদ্রে। তখন মাছও ধরা হতো প্রচুর। সামান্য জাল দিয়ে মাছ ধরতেন তারা সমুদ্রের তীরে।গোড়ালি পানিতে ডোবে, সমুদ্রের এমন জায়গায় জাল বিছিয়ে দিলেই কিছু না কিছু পাওয়া যেতো।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন তিনি। তবে এখন সময় বদলে গিয়েছে। স্টাজান মাছ বিক্রি ও চাষ না করার উপরে কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ হওয়ায় আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে মৎস্যজীবীদের। আমিরোভ নিজের মাকে নিয়ে একটি ছোট্ট ঘরে বাস করেন। মা মাছের কারখানায় কাজ করতেন। সেখান থেকেই এই ঘর পেয়েছেন তিনি। দোতলা দালানটির অর্ধেক এখন খালি। শুধু আমিরোভদের দালানই নয়, গ্রামের আর অনেক দালান এভাবে খালি পড়ে আছে। কারণ সকলের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যে সাগর ছিল গ্রামের মানুষদের আয়ের একমাত্র উৎস, সেটি দিন দিন ফাঁকা হয়ে পড়ায় মানুষও নিজেদের বসবাসের জায়গা বদলাতে শুরু করেছে।
২০১৪ সালের অলিম্পিকের সময় সোচি গিয়ে বাড়তি কাজ করে বেশ কিছু টাকা আয় করেন আমিরোভ। শুধু তিনি একা নন, এভাবে গ্রামের আরো অনেকেই বাইরে গিয়ে কাজ করছে। কিছু টাকা জমলে আবার ফিরে আসছে গ্রামে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? যদি গ্রামের কাছেই অন্য কোনো পেশা খুঁজে পাওয়া যেতো, তাহলে হয়তো এই মৎস্যজীবীরা সেই পেশার উপরেই নির্ভর করতো জীবিকার জন্য।
কিন্তু কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে তৈরি হওয়া গ্রামগুলোর পেশা কাস্পিয়ান সাগরের উপরেই নির্ভরশীল। একটু একটু করে ধার-দেনা করে তাদের সংসার বর্তমানে চলছে। মাছ ধরতে গেলে এবং ঠিকঠাকভাবে ফিরতে পারলে এই ধার মিটিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। তবে বেশিরভাগ জেলেই মাছ ধরতে গিয়ে আটক হচ্ছেন আইনরক্ষাকারী কর্মীদের কাছে। কেউ ডুবে যাচ্ছেন। মাছ পাওয়ার জন্য যেতে হয় গভীর সমুদ্রে। কিন্তু নতুন সব আইন স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা দিচ্ছে তাদের। কাস্পিয়ান চুক্তি এই পুরো ব্যাপারটিকে আরো কঠিন করে দিচ্ছে তাদের জন্য।
বর্তমানে মাছ ধরার ক্ষেত্রে একটি ভার্চুয়াল সীমানা মেনে চলতে হচ্ছে জেলেদের। এর বাইরে গেলেই জরিমানা গুণতে হচ্ছে। কখনো ব্যাপারটি প্রাণনাশকও হয়ে পড়ে তাদের জন্য। নিয়মানুসারে, সূর্যাস্তের আগে বা পরপর, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে জেলেদের তীরে ফিরতে হবে। নয়তো আইনের আওতায় আনা হবে তাদেরকে। এক্ষেত্রে জেলেদের মাছ ধরা ব্যহত হচ্ছে। কিছু মাছ, যেমন- মুগিল মাছ সন্ধ্যার পর ধরাটা বেশি সহজ। শুধু মুগিল নয়, আরো অনেক মাছ ধরতে পারছে না জেলে সম্প্রদায় দেশগুলোর চুক্তি, নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞার কারণে।
তবে রাশিয়ান বৈদেশিক মন্ত্রণালয় এবং ফেডারেল এজেন্সি অব ফিশারির মতে, ২০২৭ সালে এই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। ততদিনে স্টাজান মাছের পরিমাণ অনেক বেশি বাড়বে। তবে এই সময় পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দারা কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী স্থানে থাকতে আগ্রহী হবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ইতিমধ্যেই, জেলেদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজের বাবা-দাদাদের পেশায় কাজ করতে চাইছে না।
কাস্পিয়ান চুক্তির ফলাফল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তেহরান কাস্পিয়ানে যুক্তরাষ্ট্র বা বাইরের কারো উপস্থিতি চায়নি। সেই ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। তবে এজন্য কাস্পিয়ান সাগরে নিজেদের দখল নিয়ে যে জেদ ইরান এতদিন পর্যন্ত ধরেছিল, সেটা ছাড়তে হয়েছে। কে লাভবান হলো এই চুক্তি থেকে? ইরান, রাশিয়া, নাকি অন্য দেশ? আর যে-ই হোক না কেন, জেলেরা যে কাস্পিয়ান চুক্তির ফলে লাভবান হয়নি সেটা পরিষ্কার।
This is a Bengali article. The article is about Caspian Sea Deal, 2018. All the sources are hyperlinked inside the article.
Feature image: theduran.com