Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আধুনিক ভারত গঠনে অটল বিহারি বাজপেয়ীর অবদান

গত ১৬ আগস্ট ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) থেকে জয়ী প্রথম প্রধানমন্ত্রী তিনি। তিনি ছিলেন ভারতের ১০ম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার ১৩ দিন পর পদত্যাগ করেন। এরপর ১৯৯৮ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে পার্লামেন্টে ফিরে আসেন।

বলা যায়, তার সময়েই ভারতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ হয়েছিল, যা দেশটিকে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার দিকে ধাবিত করে। ভারতকে আজকের অবস্থানে তুলে আনার মূল কারিগর তিনিই। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন কিছু সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কতটা দূরদর্শী ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা করতেন তিনি।

একজন বাগ্মী ও সুবক্তা, কবি ও সমাজ সংস্কারক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার নাম ছিল। অনেকেই বলতেন, পৃথিবী নামক গ্রহ, যেখানে চারদিকে শুধু যুদ্ধ আর অশান্তি, এমন স্থানে একজন শান্তিপ্রিয় মানুষের আগমন ঘটেছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতার জন্যও লড়েছেন বাজপেয়ী। আজকের লেখায় প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতকে নতুনভাবে গড়তে যে কাজগুলো তিনি করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই কাজগুলো ভারতকে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গনে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে সহায়তা করেছে।

ভারতকে আধুনিক করে গড়ে তোলার এক কারিগর অটল বিহারী বাজপেয়ী; Image Source: zeenews.india.com

অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়ে ভারতের নিউক্লিয়ার মিসাইল টেস্ট করা এবং ভারতকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে পাকিস্তানের সাথে বিখ্যাত লাহোর ডিক্লারেশন সাইন করা, বৈদেশিক এবং কূটনৈতিক নীতি সংস্কার করা, অর্থনীতি এবং রাজস্ব খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজানো, শিশুদের জন্য ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’ নামক প্রচার অভিযান চালানো, ভারতে তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের পথ তৈরি করে দেয়া এবং সেই ১৫ বছর আগেই স্টার্টআপ ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা। উল্লেখ্য, ভারতে এখন এই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

 ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’ শুরু করেন তিনি; Image Source: IBTimes India

বাজপেয়ী তার শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অবকাঠামো এবং বড় ও দীর্ঘ হাইওয়ে নির্মাণ প্রকল্প শুরু করেন এবং বাস্তবায়ন করেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গোল্ডেন কোয়াড্রিলেটেরাল (Golden Quadrilateral)। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ভারতের সবচেয়ে যানজটপূর্ণ এলাকার তালিকা করেন এবং শহরগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য চার লেনের ফ্রি-ওয়ে তৈরি বাস্তবায়ন করেন।

এই রাস্তাগুলো মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা, দিল্লিকে এক করেছে। অর্থনীতি সংস্কারের জন্য তিনি ফিসকাল পলিসির সূত্রপাত ঘটান। এর ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সুস্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করেছিলো। তার সময়ে ভারতের জিডিপি বেসরকারি খাতে ০.৮%-২.৩% পর্যন্ত হয়েছিলো। তার সময়ে ভারত প্রচুর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। একটি বড় ভূমিকম্প, দুটি সাইক্লোন, একটি বড় আকারের খরা হয়েছিলো তার আমলে। আবার তেলের ঘাটতি, কারগিল যুদ্ধ, পার্লামেন্ট অ্যাটাক ইত্যাদি ঘটনাও ঘটে।

কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও বাজপেয়ী অর্থনীতির হাল ধরে রেখেছিলেন। টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু নতুন পলিসি বা নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে আরেকটি নজরকাড়া অবদান রাখেন। তিনি সব টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির জন্য লাইসেন্স ফি নির্দিষ্ট করে দেন এবং প্রত্যেকটি ইন্ডাস্ট্রি যেন নিজেদের ভেতর টেলিকম ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় ভাগ করে নিতে পারে সেই ব্যবস্থা চালু করেন।

Image Source: The Financial Express

‘সর্বশিক্ষা অভিযান’ ছিল বাজপেয়ীর স্বপ্নের প্রকল্প। তার স্বপ্ন ছিল ভারতের সকল নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। তার মতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই একটি শিশুকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের দেশের মতো ভারতেও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সমস্যা ছিল। কিন্তু বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পর পুরো প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত সিস্টেমকে নতুন করে গড়ে তোলেন। প্রাথমিকভাবে ১৮টি প্রদেশের ২৭২টি জেলায় এই অভিযান শুরু করা হয়।

প্রায় ৮৫ শতাংশ ব্যয় বহন করে কেন্দ্রীয় সরকার। কিছু অর্থ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ডিএফআইডি এবং ইউনিসেফ থেকে সরবরাহ করা হয়। ২০০১ সালের দিকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন শিশুকে এই প্রকল্পের আওয়ায় এনে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হয়। বর্তমানে এতে প্রায় ২০ কোটি প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী, ১৫ লক্ষ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬৭ লক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োজিত আছে। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, কতটুকু সফল ছিল তার এই প্রকল্প। ভারতের শিক্ষার হার বাড়ানোর ব্যাপারে এই উদ্যোগ একটি নব দিগন্তের সূচনা করেছেন।

বৈদেশিক বাণিজ্যের দিকেও লক্ষ্য ছিল বাজপেয়ীর। তার সময়ে তিনি বাণিজ্য উন্নতি করেন এবং চীনের সাথে ভারতের যে বিবাদ সেটাও সমঝোতার মাধ্যমে কমিয়ে আনেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নতির জন্য তিনি তখনকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ২০০০ সালে আমন্ত্রণ করেন। এমনকি কাশ্মীর বিবাদ এবং ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য ২০০১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে ভারতে আমন্ত্রণ জানান। দুই দেশের মধ্যে বাস সার্ভিস চালুর জন্যও বাজপেয়ী সবুজ সংকেত দেন।

বৈদেশিক বাণিজ্যের দিকেও লক্ষ্য ছিল বাজপেয়ীর; Image Source: NewIdnianExpress

ভারতের মহাকাশ অভিযানের জন্য চন্দ্রায়ন-১ প্রজেক্ট অনুমোদন করেন বাজপেয়ী। তিনি ভারতের ৫৬ তম স্বাধীনতা দিবসে ঘোষণা দেন, ভারত চন্দ্র জয় করতে যাবে। এছাড়া ভারতের পোখরানে নিউক্লিয়ার টেস্ট করার কথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে নিউক্লিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার বিকল্প নেই। ততদিনে অবশ্য ভারত মিসাইল প্রযুক্তিতে প্রায় এককভাবে উন্নতি লাভ করেছিলো।

নিউক্লিয়ার টেস্ট করার জন্য তাদের সবধরনের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রকে নিউক্লিয়ার টেস্ট এবং অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না। তারা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সব দেশের উপর নজর রাখছিল। ভারত একবার নিউক্লিয়ার টেস্ট করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে বাজপেয়ীর বিশ্বস্ততায় এবং আশ্বাসের কারণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়ে এই টেস্ট করে এবং নিজেদের নাম পারমাণবিক শক্তিধর দেশের কাতারে লিখিয়ে ফেলে।

অনেকেই এই প্রকল্পকে ভারতের শ্রেষ্ঠ প্রকল্প বলে থাকে এবং বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করে। কারণ একজন প্রধানমন্ত্রী কতটুকু ঝুঁকি নিয়ে এরকম প্রকল্পের অনুমতি দিতে পারেন যেটা কি না আগে একবার ব্যর্থ হয়েছিলো। আবার আরেকটি ব্যাপারও এখানে লক্ষ্যণীয়, নিজ দেশের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের প্রতি কতটুকু বিশ্বাস থাকলে একজন রাষ্ট্রপ্রধান এমন ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নতির জন্য তিনি তখনকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ২০০০ সালে আমন্ত্রণ করেন; Image Source: Money Control

উপরে উল্লেখিত কয়েকটি বিশেষ কারণে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ভারতের সাধারণ মানুষ মনে রাখবে। তিনি দেশে শান্তি আনতে চেয়েছিলেন। পুরোটা সময় তিনি নিজেকে দেশের কাজে উৎসর্গ করেন। তার কাজগুলো অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকতে পারে। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যারা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন, তারা প্রত্যেকে বাজপেয়ীর পরামর্শ কোনো না কোনো সময় নিয়েছেন।

যদিও পরবর্তীতে রাজনীতি থেকে তিনি পুরোপুরি নিজেকে গুটিয়ে নেন। সারাটা জীবন তিনি নিজ দেশের জন্য রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে থেকে কাজ করে গেছেন। তার মৃত্যু সমগ্র ভারতবাসীর জন্য একটি শোকের কারণ। এমন রাষ্ট্রনায়ক যুগে যুগে খুব বেশি আসে না। ভারতবাসী তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশের কাছেও তিনি একজন আদর্শের প্রতীক।

ফিচার ইমেজ- The statesman      

Related Articles