Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফাদি আল-বাত্‌শ: মোসাদের গুপ্তঘাতকদের শিকার এক মেধাবী রকেট বিজ্ঞানী

প্রতিদিনের মতো ভোর বেলা ফজরের নামাজ পড়তে বেরিয়েছিলেন ফাদি মোহাম্মদ আল-বাত্‌শ। গন্তব্য ছিল কুয়ালালামপুরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত তার বাড়ির কাছের মসজিদটি, যে মসজিদে প্রধান ইমামের অনুপস্থিতে তিনি নিজেই মাঝে মাঝে ইমামতি করতেন। প্রায় নির্জন রাস্তা দিয়ে নিশ্চিন্তমনে হেঁটে যাচ্ছিলেন সদাহাস্য, মিষ্টি স্বভাবের প্রফেসর ফাদি। কিন্তু তার জানা ছিল না, তাকে হত্যা করার জন্য মসজিদের কাছেই মোটরসাইকেলের উপর বিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছিল কুখ্যাত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দুই গুপ্ত ঘাতক।

ফাদি আল-বাত্‌‌শ; Source: AqsaTVChannel

ফাদি কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই পিস্তল বের করল মোসাদের এজেন্ট দুজন। পরপর ১৪টি গুলি করল ফাদিকে লক্ষ্য করে, যার মধ্যে চারটিই আঘাত করল তার মাথায় এবং বুকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটল মেধাবী অ্যাকাডেমিক, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং রকেট বিজ্ঞানী ফাদি আল-বাত্‌শের। তবে এতগুলো পরিচয়ের বাইরেও ফিলিস্তিনি এ প্রফেসরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় ছিল, যার কারণেই হয়তো প্রাণ দিতে হয়েছে মাত্র ৩৫ বছর বয়সী ফাদি বাত্‌শকে। সেটি হলো, তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

ফাদি মোহাম্মদ আল-বাত্‌শের জন্ম ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার জাবালিয়া গ্রামে, ১৯৮৩ সালে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ফাদি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ গাজা থেকে ২০০৬ সালে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর এবং ২০০৯ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০১১ সালে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি গাজার বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে তিনি গবেষণার জন্য মালয়েশিয়ায় যান এবং কুয়ালালামপুরের ইউনিভার্সিটি অফ মালায়া থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

ইউনিভার্সিটিতে ফাদি আল-বাত্‌‌শ; Source: Aqsa Syarif

সহপাঠী এবং ছাত্রদের বর্ণনা অনুযায়ী, ফাদি গাজা উপত্যকার অধিবাসীদের জীবন যাপনের মানোন্নয়নের জন্য সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন। তিনি প্রায়ই বলতেন, সর্বদা বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে থাকা গাজার জন্য তিনি একসময় অফুরন্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিবেন। ফাদি ছিলেন তার অ্যাকাডেমিক জগতে অত্যন্ত সফল এবং নিবেদিত। তিনি ছিলেন মালয়েশিয়ান সভেরিন ওয়েলথ ফান্ডের বৃত্তি পাওয়া প্রথম আরব। ২০১৬ সালে তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি বিশেষ পুরস্কারও লাভ করেন।

স্ত্রী এবং তিন শিশু সন্তানসহ মালয়েশিয়াতে বসবাস করা ফাদি ইউনিভার্সিটি অফ কুয়ালালামপুরের ব্রিটিশ-মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউটে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। বিদ্যুৎ ছাড়াও ফাদি ড্রোন এবং রকেট নিয়েও গবেষণা করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার একাধিক গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৩ সালে তিনি ড্রোন প্রযুক্তির উপরও একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, হামাসের পক্ষ থেকেই তাকে ড্রোন এবং রকেট প্রযুক্তির উপর গবেষণার জন্য মালয়েশিয়াতে পাঠানো হয়েছিল।

স্ত্রী ও পরিবারের সাথে ফাদি আল-বাত্‌‌শ; Source: Aqsa Syarif

হামাসের সাথে সম্পৃক্ততার কারণেই ফাদি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার নজরে পড়েন বলে ধারণা করা হয়। তবে মালয়েশিয়াতে যাওয়ার আগে গাজায় থাকা অবস্থায়ও তিনি একবার ইসরায়েলি হামলায় মৃত্যুবরণ করতে বসেছিলেন। তার চাচা তাইসির আল-বাত্‌শ, যিনি গাজার পুলিশ বাহিনীর প্রধান, তাকে হত্যার জন্যও ইসরায়েল ২০১৪ সালে বিমান হামলা চালিয়েছিল। সে সময়ের আক্রমণে বাত্‌শ পরিবারের ১৮ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছিল।

ফাদি আল-বাত্‌শ ছিলেন খুবই মিষ্টি স্বভাবের নিরুপদ্রব ধরনের একজন মানুষ। আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতদের বর্ণনা অনুযায়ী, তার কোনো শত্রু ছিল না। তিনি ছিলেন স্থানীয় মসজিদের দ্বিতীয় ইমাম। এছাড়াও তিনি ‘মাই কেয়ার’ নামে একটি সেবামূলক ইসলামিক সংস্থার সাথেও জড়িত ছিলেন। কাজেই গত ২১ এপ্রিল শনিবার যখন অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই মেধাবী, সজ্জন বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়, স্বভাবতই সন্দেহের তীর নিক্ষিপ্ত হয় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দিকে।

মসজিদে ফাদি আল-বাত্‌‌শ; Source: Aqsa Syarif

মোসাদকে সন্দেহ করার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও আছে। মোসাদ এর আগেও বিভিন্ন দেশে হামাসের সদস্যদেরকে এভাবে হত্যা করেছে। ২০১৬ সালে তিউনিসিয়ায় হামাসের ড্রোন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জাওয়াহিরিকে হত্যার পেছনেও মোসাদকে দায়ী করা হয়। ২০১০ সালে দুবাইর হোটেলে হামাস নেতা মাহমুদ আল-মাবুহকে হত্যাও মোসাদের কাজ বলে ধারণা করা হয়। এ বছর জানুয়ারি মাসে লেবাননে গাড়ি বোমা হামলায় হামাসের এক ড্রোন নির্মাতা মোহাম্মদ হামদানকে হত্যা প্রচেষ্টার পেছনেও দায়ী ছিল মোসাদ।

ফাদি হত্যাকান্ডের তদন্ত যদিও এখনও চলমান, কিন্তু ঘটনার পরপরই মালয়েশিয়ার ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি ঘটনাটিকে বিদেশী কোনো গোয়েন্দাবিভাগের কাজ বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি হত্যাকারী দুজনকে মধ্যপ্রাচ্য অথবা পশ্চিমা কোনো দেশের নাগরিক বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং প্রায় পরিষ্কারভাবেই ইসরায়েলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এই হত্যাকান্ড এমন কোনো দেশের কাজ হতে পারে, যারা ফিলিস্তিনের শত্রু।

তবে মোসাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সবচেয়ে জোরালো সন্দেহ প্রকাশ করেন ইসরায়েলি সাংবাদিক এবং মোসাদের গোপন অপারেশন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ গবেষক-লেখক রোনেন বার্গম্যান। গত ২২ এপ্রিল আল-জাজিরর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হত্যাকারীরা যে হত্যার কাজে মোটর সাইকেল ব্যবহার করেছে এবং দক্ষতার সাথে অত্যন্ত নিঁখুতভাবে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, তা থেকেই সন্দেহ হয় এটি মোসাদের কাজ। তার মতে, মোসাদ এর আগেও অনেক হত্যাকান্ড একই পদ্ধতিতে ঘটিয়েছে।

তবে শুধু সন্দেহ নয়, গতকাল বৃহস্পতিবার রোনেন বার্গম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্য প্রাচ্যের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নিশ্চিত করেন, ফাদি আল-বাত্‌শকে মোসাদই হত্যা করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, এই হত্যাকান্ড মোসাদের প্রধান ইওসি কোহেনের নির্দেশে চলমান একটি বৃহত্তর অপারেশনেরই ধারাবাহিকতা, যার আওতায় হামাসের সেরা সেরা ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানীদেরকে হত্যা করা হচ্ছে, যাদেরকে হামাস বিদেশে পাঠিয়েছে অস্ত্র সম্পর্কে আরো বিস্তৃত জ্ঞান লাভ করার জন্য।

মালয়েশিয়াতে ভক্তদের হাতে ফাদির পোস্টার; Source: AFP

গাজায় ফাদির বাড়ির সামনে কাস্‌সাম ব্রিগেডের সদস্যরা; Source: AP

ইসরায়েলের জন্য এই বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররা বেশ বড় ধরনের হুমকি। কারণ এদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান এবং আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তিশালী হয়ে ওঠা হামাসকে পরাজিত করা ভবিষ্যতে ইসরায়েলের পক্ষে সহজ না-ও হতে পারে। সে কারণেই হয়তো মোসাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন রকেট এবং ড্রোন বিশেষজ্ঞ ফাদি। ইসরায়েলিরা হয়তো জানতে পেরেছিল, ফাদি হামাসের সাধারণ কোনো সদস্য ছিলেন না, সম্ভবত তিনি ছিলেন হামাসের সামরিক শাখা কাস্‌সাম ব্রিগেডের সদস্য। ফাদির মৃত্যুর পর তার গাজার বাড়ির সামনে স্থাপিত তাঁবুর সামনে অবস্থান নিতে দেখা কাস্‌সাম ব্রিগেডের দশজন সশস্ত্র যোদ্ধাকে, যাদের তৈরি ব্যানারে ফাদিকে উল্লেখ করা হয়েছে কাস্‌সাম ব্রিগেডের ‘ইঞ্জিনিয়ার কমান্ডার’ হিসেবে।

ফাদি বাত্‌শের মৃত্যুর দিনটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন ফাদির ইস্তাম্বুলে যাওয়ার কথা ছিল একটি অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যপ্রাচ্যের একটি গোয়েন্দা সংস্থা রোনেন বার্গম্যানকে জানায়, হামাস বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত তাদের সদস্যদের সাথে ইস্তাম্বুলের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে। এবং সেদিন ইস্তাম্বুলে গিয়ে আসলে ফাদির হামাসের বহির্বিশ্ব শাখার প্রধান মাহের সালাহর সাথে দেখা করার কথা ছিল।

কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা এরকমও সন্দেহ প্রকাশ করে, ফাদি হয়তো উত্তর কোরিয়ান অস্ত্র মালয়েশিয়া হয়ে গাজায় পাঠানোর ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যই তুরস্কে যাচ্ছিলেন। আর সেজন্যই মোসাদ তাকে হত্যা করে। এর আগে মিসরীয় সেনাবাহিনী গাজার উদ্দেশ্যে প্রেরিত অস্ত্রের একটি চালান আটক করেছিল, যা উত্তর কোরিয়া থেকে মালয়েশিয়া হয়ে মিসর সীমান্ত দিয়ে গাজায় পাঠানো হচ্ছিল। যদিও এটা শুধুই সন্দেহ মাত্র, কোনো প্রমাণ নেই।

তবে কারণ যেটাই হোক, ফাদি বাত্‌শকে যে মোসাদই হত্যা করেছে, সে সম্ভাবনা বেশ জোরলো। ইসরায়েল একদিকে প্রতিনিয়ত গাজাতে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত বেসামরিক জনগণকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে সেই হামলার বিরুদ্ধে গাজাবাসী বা গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস যেন কোনো প্রতিরোধ গড়তে না পারে, সেজন্য গুপ্তহত্যার মাধ্যমে বিদেশে অবস্থিত তাদের মেধাবী বিজ্ঞানীদেরকে হত্যার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে, অন্যদিকে পরিহাসমূলকভাবে তারা নিজেরাই হামাস সদস্যদেরকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য আইন বহির্ভূত গুপ্তহত্যা পরিচালনা করে থাকে।

ফিচার ইমেজ- Aqsa Syarif

Related Articles