Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিবাদ

নূর হোসেনকে মনে পড়ে? নিজের শরীরকে ক্যানভাস বানিয়ে যিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে? “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”, তার বুকে-পিঠে সাদা রঙ দিয়ে সেই লেখা, যার জন্য তাকে জীবন দিতে হয়েছিল? অথচ এরই জন্য তিনি এদেশের ইতিহাসের পাতায় হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক।

’৫২ থেকে ’৭১, বাংলার ইতিহাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বহু নিদর্শন আছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও জনমানুষের অধিকারের দাবিতে, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নিদর্শন আছে অনেক। ’৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ’১৩ এর গণজাগরণ মঞ্চ, এমনকি সাম্প্রতিককালের কোটা সংস্কার আন্দোলন – দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে এসেছে সাধারণ মানুষ। বিশ্বজুড়ে বহু দেশেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রাণের দাবিতে সাধারণ মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। অনেক সময়ই তাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিল যেমন অভিনব, তেমনই শক্তিশালী। বিশ্বজুড়ে এমনই কতগুলো প্রতিবাদের নিদর্শন এখানে দেয়া হলো।

১. রাস্তা জুড়ে শ্রমিকদের হেলমেট বিছিয়ে রাখা – ইতালি

২০১২ সালের অক্টোবর মাস। অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত ইতালিতে অনেকটা হুট করেই বহু কারখানা বন্ধ করে দেয় মারিও মন্টি সরকার। একে অর্থনৈতিক সঙ্কট তার উপর হঠাৎ বেকারত্বের দরুন দিশেহারা হয়ে পড়ে তৎকালীন সাধারণ শ্রমিকরা। পেটের তাগিদে, কারখানা খোলার দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়েন হাজার হাজার শ্রমিক। এসময় সার্ডিনিয়ার শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের একটি অভিনব উদাহরণ উপস্থাপন করেন।

কারখানা খোলা রাখার দাবিতে ইতালির শ্রমিকদের রাস্তায় হেলমেট রেখে প্রতিবাদ, Source- trueactivist.com

প্ল্যাকার্ড বা স্লোগান নয়, বরং শ্রমিকদের পরনের হেলমেটখানা রাস্তায় রাখেন একে একে সকলে। একেকটি হেলমেট যেন একেকজন শ্রমিক, তাদের বেদনা।

ইতালির রাস্তায় শোভা পায় সারি সারি, হাজার হাজার হেলমেট। শ্রমিকের হেলমেটের রঙে হলুদ হয়ে যায় ইতালির ধূসর রাস্তাগুলো।

২. পুলিশের উপর ইইউ খামারিদের দুগ্ধ কামান – বেলজিয়াম

বেলজিয়ামের পুলিশের উপর দুগ্ধকামান; Source- trueactivist.com

২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশ ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস থেকে হাজার হাজার দুগ্ধ খামারি ট্র্যাক্টরে চেপে উপস্থিত হন ব্রাসেলস শহরে। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সামনে এসে জড়ো হন তারা, উদ্দেশ্য স্থানীয় খামারিদের স্বার্থবিরোধী ইইউ এর নীতিকে প্রতিহত করা। ইইউ এর প্রস্তাবিত নীতির কারণে ডেইরি বাজার থেকে স্থানীয় খামারিদের বের করে দেয়ার আশঙ্কায় তারা এর প্রতিবাদ জানান। কিন্তু আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশী আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা গেলে খামারিরা নিজেরাই পুলিশের উপর তাদের ‘দুগ্ধ কামান’ চালান।

৩. মানুষের বদলে জুতো দিয়ে র‍্যালি – ফ্রান্স

২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর । বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে একটি র‌্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য প্যারিসে জমায়েত হবার কথা ছিল দেশ-বিদেশের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষের। কিন্তু এর কিছুদিন আগে অর্থাৎ নভেম্বরের ১৩ তারিখে প্যারিস হামলায় ১৩০ জনের মৃত্যু হবার পর দেশটিতে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। এর কারণে যেকোনো ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করে দেয় ফ্রান্স সরকার। জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী র‌্যালি বাতিল হয়ে যাবার কারণে আশাহত হন অনেকেই। কিন্তু র‌্যালিটির আয়োজক একটি এনজিও আভাজ (Avaaz.org) থেমে যেতে চায়নি, তাই তারা প্রতীকী আন্দোলনের একটি অভিনব উপায় বের করেন, অংশগ্রহণকারীদের জুতো জোড়া পাঠিয়ে দেয়ার আহবান জানান। তাদের ডাকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। বাক্সে বাক্সে উপস্থিত হয় হাজার হাজার জুতো। র‌্যালির দিন দেখা যায় প্যারিসের Place de la République এ হাজার হাজার জুতো সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এ যেন যে র‌্যালিটি সেদিন হবার কথা ছিল তারই প্রকাশ।

মানুষের বদলে জুতার র‌্যালি ; Source- huffingtonpost.ca

এমনকি পোপ ফ্রান্সিস নিজেই তাঁর এক জোড়া জুতো পাঠিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

সেদিন প্যারিসে ঠিক কতগুলো জুতো রাখা হয়েছিল বলতে পারবেন কি? প্রায় ২২,০০০ জোড়া জুতো!

৪. দ্য আমব্রেলা মুভমেন্ট – হংকং

চীনের শাসনাধীন হংকং এর রাস্তায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছিল হাজার হাজার মানুষ, ছাতা হাতে অবস্থান কর্মসূচিতে।

দ্য আমব্রেলা মুভমেন্ট ;Source- mantlethought.org

তাদের দাবি, রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। বিস্তারিত বলতে গেলে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হংকং এর শাসক তথা চিফ এক্সিকিউটিভের নির্বাচন। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বের হবার পর দেশটির উপর কর্তৃত্ব লাভ করে চীন। চীনের মতে, চীফ এক্সেকিউটিভ পদটি নির্বাচনের জন্য হংকং এর চীন ঘেঁষা গোষ্ঠী এবং টাইকুনদের দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিটি যথেষ্ট। আমব্রেলা মুভমেন্টের আন্দোলনকারীরা এর বিরুদ্ধে ছাতা হাতে অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেয়। সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে ছাতাধারী মানুষে ছেয়ে যায় হংকং এর রাস্তাগুলো, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় অনেকগুলোতে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতকিছু থাকতে ছাতা কেন?

এ প্রশ্নের উত্তরে আন্দোলনকারীরা বলেন, পুলিশের পিপার-স্প্রে থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করা হয়। এভাবে এ ছাতাই তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এসে পুলিশী বাধার দরুন ৩ মাসব্যাপী এ অবস্থান কর্মসূচি ভেস্তে যায়, তারপরও এটি হংকং এর বৃহৎ জনআন্দোলনের একটি হিসেবে বিবেচিত হয়।

৫. ‘হেড ইন দ্য স্যান্ড’ প্রতিবাদ – অস্ট্রেলিয়া

২০১৪ সালের নভেম্বরের ১৩ তারিখে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত বন্ডি সমুদ্র সৈকতে জড়ো হয় ৪০০ জন মানুষ। এর কিছুদিন পরই নভেম্বরের ১৫-১৬ তারিখে ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনের এজেন্ডায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি রাখতে সারা বিশ্বের অধিকাংশ নেতাদের সায় থাকলেও অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবটের বিরোধিতার কারণে সেটা এজেন্ডাভুক্ত করা হয়নি।

হেড ইন দ্য স্যান্ড; Source- riledupjournal.com

অ্যাবটের জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর বিপদকে অস্বীকার করাটা অনেকটা উট পাখির বালুতে মাথা গোঁজার সামিল, এমনটাই মনে করেছিল অনেকেই। আর এটাই মাথায় রেখে তারা জড়ো হয়েছিল বন্ডি সৈকতে, আর একসাথে মাথা গুঁজে ফেলে তারা বালুতে। বিপদ দেখে উট পাখি যেমন বালুতে মাথা গুঁজে, তেমনই অ্যাবটও জলবায়ু পরিবর্তনকে দেখেও না দেখার ভান করেন, অস্বীকার করেন। অথচ এটা করে কিন্তু বিপদের কোনো সমাধান হয় না- এমনটাই বোঝাতে বালুতে মাথা গুঁজে প্রতীকী প্রতিবাদ করেন তারা।

৬. মোমবাতি আন্দোলন – দক্ষিণ কোরিয়া

শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম হল মোমবাতি প্রজ্বলন। একটি মোমবাতির কোনো শক্তি নেই, অথচ শতটি মোমবাতির শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি। এখন মোমবাতির সংখ্যা হাজার হয়, আরো বেশি। এখন যদি সেই মোমবাতির সংখ্যা হয় লক্ষাধিক, তাহলে?

কতখানি শক্তিশালী সেই প্রতিবাদ? কী করতে সক্ষম হবে সেই গণ আন্দোলন?

দক্ষিণ কোরিয়ার মোমবাতি আন্দোলন; Source- abc.net.au

ঠিক এ প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া গেছে দক্ষিণ কোরিয়ার এই গণ আন্দোলনে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাষ্ট্রপতি পার্ক গিউন হাই এর অব্যাহতির দাবিতে দক্ষিণ কোরিয়ার রাস্তায় নেমে আসে সর্বস্তরের সব বয়সের মানুষ। হাতে তাদের মোমবাতি। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে শুরু হওয়া এই আন্দোলন চলে প্রায় ৬ মাসব্যাপী। দেইগু থেকে সিউল, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি শহরে গণ আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তো শেষমেশ এই আন্দোলনের ফল? রাষ্ট্রপতি পার্কের অভিশংসন ঘটাতে বাধ্য হয় দক্ষিণ কোরিয়ো শাসক গোষ্ঠী।

অথচ এটি একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছিল।

সফল হোক বা ব্যর্থ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সময়ের সাথে সাথে হতে থাকবে বারবার। যা কিছু ন্যায় এবং কল্যাণকর তার জয় কামনা করা, তার জন্য চেষ্টা করার সৎ সাহস কামনা করে এখানেই শেষ করছি।

ফিচার ছবিসূত্র- qz.com

Related Articles