Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে আসা ছয় রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার

কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, বাউখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প আর চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের নতুন ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছেন কাতারভিত্তিক প্রখ্যাত সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার সাংবাদিক কেটি আরনল্ড। তিনি সেখানে কথা বলেছেন শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সাথে, নিয়েছেন সাক্ষাৎকার। সেই সাক্ষাতকার থেকে দুর্ভাগ্যপীড়িত ছয় রোহিঙ্গার দুর্দশার বয়ান তুলে ধরা হলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।

রাখাইন রাজ্যের চিনখালি গ্রাম হতে আহেসান পালিয়ে এসেছে সপ্তাহ দুই আগে। মুখে বয়স ত্রিশ বছর বললেও, সাম্প্রতিক বিভীষিকা তাকে যেন আরো বৃদ্ধ করে দিয়েছে। নিজ দেশের সেই বিভীষিকার বর্ণনা তিনি করেছেন এভাবে:

আহেসান (৩০), কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, উখিয়া, কক্সবাজার; © Katie Arnold/Al Jazeera

আমি আহেসান। এই তাণ্ডবের আগে আমি আমার গ্রাম চিনখালীতে কৃষিকাজ করতাম। সাথে সাথে প্রতিদিন কাজের পর বাচ্চাদের ইংরেজি পড়াতাম। বেশ ব্যস্ত চলে যাচ্ছিলো দিনকাল।

২৫ আগস্ট সকালে আমি আমার পরিবার নিয়ে নাস্তা করছি, এমন সময় দেখি, মিলিটারিরা হঠাৎ আমাদের গ্রামে চলে আসে আর নির্বিচারে গুলি করা শুরু করে কোনোরকম বাছবিচার বাছাই। আমার পরিবারের পাঁচজনকে আমি চোখের সামনেই মারা যেতে দেখলাম!

আমার মাকে দেখলাম মেঝেতে পড়ে আছেন, তার পিঠ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তার ঠিক পাশেই আমার বোন, তার মুখ ও শরীরে হাজারটা ক্ষত নিয়ে পড়ে আছে । রক্তে মাখামাখি হয়ে থাকা মা-বোনের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। তাদের নিয়ে বিলাপ করার সময়ও আমার হাতে নেই, তবে যে গুলি খেতে হবে!

এক সৈন্যকে দেখলাম, আমার বোনকে ধর্ষণের চেষ্টা করছে। সে বাধা দিতেই তাকে আবার রক্তাক্ত করলো জানোয়ারগুলো। হঠাৎ করে এত কিছু ঘটে যাওয়ায়, সে মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পায়। তারপর থেকে সে একটি শব্দও বলেনি। এত আঘাত আর ধর্ষণে তার নড়বার ক্ষমতাও ছিলো না। তাই আমি আর আমার ভাই তাকে কাঁধে করে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি, সাথে ছিলো কিছু বাঁশ আর কম্বল।

বাংলাদেশের পথে আমরা আরো অনেক বীভৎস জিনিস দেখি। রাস্তায় শ’য়ে শ’য়ে লাশ পড়ে আছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা বৃদ্ধ আর মায়ের লাশ পাশে নিয়ে কাঁদতে থাকা বাচ্চাদের পাশ কাটিয়ে আমরা একদিন বর্ডারে পৌঁছে গেলাম। সেখানে তখন হাজারো রোহিঙ্গা নদী পার হবার জন্য অপেক্ষা করছে। সৌভাগ্যক্রমে আমরা একটা নৌকা পেয়ে যাই।

কিন্তু বাংলাদেশেও আমাদের অবস্থা খুবই দুর্বিসহ। আমাদের মাথা গোঁজার কোনো ছাদ নেই, নেই কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। সবার ঘুমানোর জন্যও পর্যাপ্ত জায়গা এখানে নেই। আমরা হয়তো এখানে জীবিত আছি, কিন্তু অবস্থা এমন যে, আমরা একই সাথে জীবিত, আবার মৃত! আমার ভয় হয়, এমন অবস্থায় আরো অসংখ্য রোহিঙ্গা মারা যাবে। আমরা মায়ানমারে থাকলে হয়তো এত দিনে মারা পড়তাম, কিন্তু এখানেও আমাদের জীবন বলে কিছু নেই।

আমার বিশ্বাস, পুরো পৃথিবী আমাদের পক্ষে আছে। তারা আমাদের সাহায্য করছে, এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা চাই, তারা আমাদের অবস্থানে এসে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুক। তারাও মানুষ, আমরাও মানুষ। শুধু পার্থক্য হলো, তারা কোনো না কোনো দেশের নাগরিক, কিন্তু আমরা নই। আমাদের কোনো দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক, পৃথিবীর আর সবার মতো আমরাও বাঁচতে চাই।

ছোট্ট জসীমের বয়স বারো বছর। সে তেরো দিন হেঁটে পাহাড় ডিঙিয়ে, নদী পার হয়ে আশ্রয় পেয়েছে বাংলাদেশে। তার কথা আমরা শুনবো এবার।

জসীম (১২), কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, উখিয়া, কক্সবাজার; © Katie Arnold/Al Jazeera

আমি জসীম, আমার বয়স বারো বছর। এই বিপদের আগে আমি স্কুলে লেখাপড়া করতাম। আমার প্রিয় বিষয় ছিলো ইংরেজি। কারণ আমি জানতাম, যদি আমি ভালো ইংরেজি বলতে পারি, তবে আমি পৃথিবীর সবার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো এবং আমার মতামত প্রকাশ করতে পারবো। আশা করি, আমি আবার খুব দ্রুত আমার লেখাপড়া শুরু করতে পারবো। কারণ লেখাপড়া শেষ করে আমি শিক্ষক হতে চাই।

সে রাতে যখন মিলিটারিরা আমাদের গ্রামে আসলো, আমরা সবাই দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। আমি সেদিন অনেক সৈন্য দেখেছিলাম, একশো বা দুইশো কিংবা আরো বেশি। তারা যেখানেই রোহিঙ্গা দেখেছে, গুলি করে মেরেছে। একে একে গ্রামের সবগুলো ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি অমন ভয় জীবনে আর কোনোদিন পাইনি।

আমরা রাতে জঙ্গলে পালিয়ে ছিলাম, দিনের আলো ফুটতেই আমরা বাংলাদেশের পথে হাঁটা শুরু করি। পথে আমাদের তেরো দিন লেগেছিলো। আমরা জঙ্গলে কাটিয়েছিলাম অনেকগুলো রাত।

আমাদের যাত্রাপথ খুব সহজ ছিলো না। আমরা কয়েকটা বড় পাহাড় ডিঙিয়েছি, নদী পার হয়েছি। আমরা যখন হাঁটছিলাম, আমার তখন বারে বারে মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি মিলিটারিরা আমাদের ধরে ফেললো! কিন্তু যখন বাংলাদেশের বর্ডারের কাছে এসে পৌঁছুলাম, তখন বাঁধলো আরেক বিপত্তি। আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিলো, কারণ মিলিটারিরা সেখানে অসংখ্য ছোট ছোট বোমা পেতে রেখেছে। একবার পা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু!

আমার মন ভীষণ খারাপ আমার গ্রামের জন্য। আমাদের গ্রামটি আর আগের মতো নেই। আমরা সাথে করে কিছুই আনতে পারিনি। সেগুলো সবকিছুই চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। আমি এখানে এসেছি আমার মায়ের সাথে। আর আমার বাবা এখনও রয়ে গেছেন রাখাইনে। তিনি বলেছিলেন, কিছুদিন পর তিনি আমাদের এখানে আসবেন। কিন্তু আমরা জানি না তিনি কোথায় আছেন, সেদিনের পর থেকে তার কোনো খবর আমরা শুনিনি। আমার ভয় হয়, মিলিটারিরা হয়তো তাকে ধরে ফেলেছে কিংবা তিনি হয়তো কোনো বোমার উপর পা রেখেছিলেন!

আমরা এখানে ঠিকমতো পৌঁছেছি, কিন্তু এখানে বসবাস করা সত্যিই খুব কঠিন। খোলা আকাশ আর বৃষ্টিতে কাদা কাদা হয়ে থাকা মাটিতে আমাদের ঘুমুতে হচ্ছে।

পৃথিবীর সবাইকে আমি বলতে চাই, আমরা মায়ানমারের নাগরিক। সেই প্রাপ্য নাগরিকত্বের স্বীকৃতি আমাদের প্রাণের দাবি। যদি মায়ানমার সরকার আমাদের নাগরিকত্ব প্রদান করে, তাহলে আমরা খুবই খুশি হবো।

অন্য আরো অনেকের সাথে রাখাইন হতে পালিয়ে এসেছেন বৃদ্ধা বেগম জান, বয়স পঁয়ষট্টি বছর। তিনি তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন এভাবে:

বেগম জান (৬৫), বাউখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প, কক্সবাজার; © Katie Arnold/Al Jazeera

আমার পুরো জীবনটাই তো একটা সংগ্রাম! পঁচিশ বছর আগে যখন আমার স্বামী মারা গেলো, তারপর থেকে আমি গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে খাই। আমার দুই মেয়ের বিয়ে অবশ্য দিয়েছিলাম ততদিনে, তাই এই বৃদ্ধার ভার বইবার মতো পাশে ছিলো না কেউ।

একরাতে ভীষণ গোলাগুলি আর বোমা বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। ভয়ঙ্কর সে শব্দ! আমি তা সহ্য করতে পারলাম না। সেদিনের পর থেকে আজ অব্দি আমি ঠিকমতো ঘুমুতে পারি না, আজও মৃত্যুর সে শব্দ আমাকে তাড়া করে ফেরে।

সবাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো। আমিও তাদের সাথে পথ ধরলাম। আমার আসতে মন সায় দিচ্ছিলো না, কিন্তু আর উপায় কী? বাংলাদেশে আসতে সময় লাগলো দু’দিন। আমি এমনিতে হাঁটতে পারি না, লাঠি লাগে। শত শত মানুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিলো না। সবাই নিজের আর নিজের পরিবারকে বাঁচাতে ব্যস্ত। যখন নৌকা পার হচ্ছিলাম, মিলিটারি জাহাজের শব্দ শুনে আমার আত্মার পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো।

এখন আমি বাংলাদেশে, কিন্তু আমার ভয় হয়, মিলিটারিরা বোধ হয় এখানেও চলে আসবে! এখন পর্যন্ত অন্তত এটুকুতে স্বস্তি পাচ্ছি যে, সেই ভয়ঙ্কর গোলাগুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ আর শুনতে হচ্ছে না।

মায়ানমারের বাইরের পৃথিবী হতে আমরা প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছি এবং আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা চাই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ আমাদের দুর্দশার কথা জানুক। তাতে অবশ্য বিশেষ কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমাদের বাংলাদেশ কিংবা মায়ানমার, কোথাও কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

পঁচিশ বছর বয়সী তিন সন্তানের মা রাশিদা, বারো দিন হলো ঘর ছেড়েছেন। তার নতুন ঠিকানা হয়েছে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তার মুখে শোনা যাক, নিজ রাজ্য রাখাইন থেকে মৃত্যুভয়ে বাংলাদেশের পালিয়ে আসার কথা।

রাশিদা (২৫), কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, উখিয়া, কক্সবাজার; © Katie Arnold/Al Jazeera

আমি রাশিদা। আরাকানে এই ভীষণ দুর্যোগ সৃষ্টি হওয়ার আগে আমি খুব সাদাসিধে এবং সুখী জীবন কাটাতাম। স্বামী এবং তিন সন্তান নিয়ে কৃষিকাজ করে দিব্যি আমাদের চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু এখন আমরা সবকিছু ফেলে এসেছি। আমাদের বাড়ি এবং ক্ষেত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে করে আমরা আর ওখানে ফিরে যেতে না পারি।

মিলিটারিরা যখন আমাদের গ্রামে গণহত্যা শুরু করলো, আমরা প্রথমে তিন বাচ্চাকে জঙ্গলে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাই। তারা ওখানে বুনো জন্তু-জানোয়ারের ভয় পাচ্ছিলো। কিন্তু তা ছাড়া যে কোনো উপায় নেই। আমরা যাদের মানুষ হিসেবে জেনেছি, তারা তো বুনো জন্তুর থেকেও ভয়ঙ্কর! আমি তাদের সেখানে রেখে বাড়ির দিকে গেলাম, কিছু নিয়ে আসতে পারি কিনা সেই আশায়। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। আমি সেদিন মানুষের লাশ ছাড়া আর কিছুই দেখিনি।

জঙ্গল থেকে টানা আটদিন হেঁটে আমরা বর্ডারে এলাম। আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিলাম আর আমাদের কাছে গাছে পাতা ছাড়া খাবার মতো আর কিছুই ছিলো না। বাচ্চারা বারে বারে খেতে চাচ্ছিলো, কিন্তু ওরা ছাড়া আর কিছুই যে আমার সাথে নেই!

বর্ডার পার হলাম ছোট্ট একটা নৌকায়। এতো ছোট নৌকায় এতজন উঠেছিলাম যে, আমার ভয় হচ্ছিলো কখন না ডুবে যায়! আমি শুধু বাচ্চাদের জাপটে ধরেছিলাম আর দোয়া-দুরুদ পড়ছিলাম।

বাংলাদেশে এসেও আমরা শান্তিতে নেই। আমরা দেশে ফিরত যেতে চাই। সেখানে আমাদের গবাদি পশু ছিলো, এক একর ধানী জমি ছিলো, একটা আরামদায়ক বাড়ি আর একটা খুব সুন্দর গ্রাম ছিলো। আমরা সেসব পেছনে ফেলে এসেছি। আশা করি আপনারা বুঝতে পারছেন, আমাদের মনের অবস্থাটা এখন কেমন।

আমি আমার বাড়িটাকে খুব মিস করি। আমাদের এখানে কোনো আশা নেই। আমরা কেউই জানি না আমাদের ভবিষ্যত কী।

বাংলাদেশিরা অনেক দয়া করেছে আমাদের। তারা তাদের খাবার-পোশাক আমাদের দিয়েছে। কিন্তু তা একেবারেই যথেষ্ট নয়। আমি এখানে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দেখিনি ত্রাণ পাঠাতে। আশা করি তারা দ্রুত আমাদের সাহায্য করবে, আমাদের এখনও প্রচুর খাবার দরকার।

রোহিঙ্গারা সবসময়ই শান্তির পক্ষে এবং আমাদের দেশে ফের শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হলে আমাদের বেঁচে থাকার কোনো আশাই হয়তো আর থাকবে না।

রাখাইনের বুথিডাং উপশহর থেকে পালিয়ে এসেছে তেত্রিশ বছর বয়সী মোহাম্মাদ। এবার শুনুন তার কথা।

মোহাম্মাদ (৩৩), চট্টগ্রাম; © Katie Arnold/Al Jazeera

বুথিডাংয়ের অন্য সবার মতো আমিও কৃষিকাজ করতাম। সেখানে আমাদের অন্য কোনো কাজ করার কিংবা লেখাপড়া করার অধিকার ছিলো না। তাই পুলিশ, মিলিটারি বা অন্য কোনো চাকরিতে আমাদের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের কৃষিকাজ করতে হতো কিংবা বন থেকে বাঁশ-কাঠ জোগাড় করে বাজারে তা বিক্রি করে পেট চালাতে হতো। আমাদের কোনো প্রকার স্বাধীনতা ছিলো না, তবু দিনে আনি-দিনে খাই করে দিনগুলো চলে যাচ্ছিলো।

সপ্তাহ দুই আগে একদিন মিলিটারি আর স্থানীয় বৌদ্ধ সন্নাসীরা আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে আর আমাদের ঘরগুলোতে একে একে আগুন দিতে থাকে। যাকে সামনে পায়, তাকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। তারা আমার ভাইয়ের ঠিক মাথায় গুলি করে, সে সেখানেই মারা যায়। আমরা বাকিরা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম, নয়তো আমাদের অবস্থাও হতো পড়ে থাকা লাশগুলো মতো।

আমরা জানতাম না কোথায় যাচ্ছি। আমরা শুধু হাঁটছিলাম আর হাঁটছিলাম। টানা দশদিন এভাবে হাঁটার পর অবশেষে আমরা বাংলাদেশে পৌছাই।

আমার মায়ের বয়স আশি বছর। তিনি প্যারালাইজড এবং ভয়াবহ হাঁপানির রোগী। পুরোটা পথ আমি তাকে কাঁধে করে নিয়ে এসেছি। বাংলাদেশের পথে আমরা তিনটা নদী পাড়ি দিয়েছিলাম, আর বাদবাকি পুরোটাই ছিলো হাঁটাপথ। প্রায়ই মিলিটারিদের ধাওয়া খেয়েছি, তাদের গুলিতে আমাদের দলটি দিনে দিনে ছোট হয়েছে। বনে-বাদাড়ে জন্তু-জানোয়ারের সাথে রাত কাটিয়েছি।

পথের মধ্যে তাই আমাদের বিপদের কোনো কমতি ছিলো না। তবু জানের মায়ায় আমরা একদিন ঠিকই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম। এখানে আমরা বেশ নিশ্চিন্ত মনে দিনযাপন করতে পারছি, অন্তত জানে মারার তো কেউ নেই!

কিন্তু বাংলাদেশ আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। আমরা অশিক্ষিত, এখানে আমাদের জন্য কোনো কাজ নেই। তাই যদি মায়ানমারে ফের শান্তি ফিরে আসে, আমরা সবাই যে যার বাড়ি ফিরে যাবো। অবশ্য ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছুই হয়তো বাকি নেই সেখানে।

আমি জানি, পুরো বিশ্বই আমাদের ছবিগুলো দেখছে। কিন্তু কেউ কিছুই করছে না। কেউই এই গণহত্যা বন্ধে মায়ানমারকে চাপ দিচ্ছে না। আসলে কেউ চায়ই না যে, রোহিঙ্গা সমস্যার একটা সমাধান হোক। যদি আসলেই চাইতো, তবে এতদিনে এর সমাধান হয়ে যেত। বিশ্বনেতারা সবকিছু দেখেও কেন না দেখার ভান করছেন, আমার অশিক্ষিত মাথা তা ধরতে পারে না।

মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সমান। বৌদ্ধদের মতো আমরাও রক্ত মাংসের মানুষ, ধর্ম আমাদের পাল্টে দেয়নি। তারা সেখানে বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারলে আমরা কেন পারবো না? ওই মাটিতেই তো আমাদের জন্ম!

রাখাইন রাজ্যের ফোইরা গ্রামের মাদ্রাসার ছাত্র রাহিমুল, স্বপ্ন দেখে একদিন সে শিক্ষক হবে। কিন্তু নিজ দেশ থেকে মৃত্যুতাড়িত হয়ে অন্য সবার মতো আজ তার ঠাঁই মিলেছে পরদেশে।

রাহিমুল মোস্তফা (২২), কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, উখিয়া, কক্সবাজার; © Katie Arnold/Al Jazeera

আমার নাম রাহিমুল মোস্তফা, বাইশ বছর বয়স। এখানে আসার আগে আমি আমার এলাকার এক মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতাম। লেখাপড়া আমার খুবই ভালো লাগতো। পড়ানোও আমার খুব পছন্দের। প্রায়ই আমি ছোটদের বিভিন্ন বিষয় শেখাতে চেষ্টা করতাম। আমার এলাকার বেশিরভাগই ছিলো অশিক্ষিত।

আমার ইচ্ছা ছিলো, আমি শিক্ষক হবো। নিজের লেখাপড়া আর ছোটদের শেখানো, দুইয়ে মিলিয়ে নিজ গ্রাম ফোইরাতে দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু সেই সুখের দিনগুলোয় অমাবস্যা নিয়ে এলো মিলিটারি বাহিনী।

প্রতিদিনকার মতো রাত নেমে আসার কিছু পরেই ঘুমিয়ে পড়ে ফোইরা গ্রাম। বলা নেই কওয়া নেই, মিলিটারি বাহিনী আমাদের গ্রামে এসে বৌদ্ধদের সাথে নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যায় মেতে উঠলো। রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে। তারা পুড়িয়ে দিলো আমাদের বাড়িঘর। আমাদের দেখামাত্রই তারা গুলি করছিলো, তাই বাড়ি থেকে বের হবার সাহস হলো না। কিন্তু তাতে আবার পুড়ে মরবার ভয়! তবু আমরা ঘরের ভেতর লুকিয়ে ছিলাম। খানিক বাদে মিলিটারিরা আমাদের বাসার সামনে এসে গুলি চালাতে শুরু করে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর শোঁ শোঁ করে গুলি ঢোকার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে একটা বুলেট এসে আমার বাঁ হাঁটু একেবারে ঝাঁঝরা করে দিলো। সে রাতে আমাদের গ্রামে কতো মানুষকে যে তারা মেরেছিলো, তার সঠিক হিসাব হয়তো তাদের কাছেও নেই। আমি আমাদের পাশের বাসার তিনজনের লাশ দেখেছিলাম পালিয়ে যাবার সময়।

আমার বাবা এবং ভাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। কিন্তু সেখানকার ডাক্তাররা আমার চিকিৎসা করলো না, কারণ আমি রোহিঙ্গা। আমার পরিবার তাই আমাকে বয়ে নিয়ে আসে বাংলাদেশে। আমি পুরোটা পথ তাদের কাঁধে চেপে এখানে আসি। তারা দুর্গম পাহাড়ি পথ দিয়ে এসেছিল, কারণ সেখানে মিলিটারির উপদ্রব কম।

বাংলাদেশে আসার এই রাস্তাটা ছিলো অনেক দীর্ঘ। তত দিনে আমার ক্ষত সংক্রমিত হয়ে পায়ের বেশ খানিকটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। আমার পরিবার আমার জন্য অন্য সবকিছু ফেলে চলে এসেছে। তারা সাথে করে আর কিছুই নিয়ে আসতে পারেনি।

আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, আমরা অবশেষে বাংলাদেশে পৌছেছি এবং এখানকার ডাক্তাররা আমার চিকিৎসা করেছেন।

তবু এখানে আমাদের কোনো আশা-ভরসা নেই। বাড়ি ফিরে যেতে পারলে আমরা অনেক ভালো থাকবো। আমরা শুধুই দেশে ফিরে যেতে চাই এবং আমরা শান্তি চাই। আমার বিশ্বাস, পুরো পৃথিবী আমাদের দেখছে এবং তারা নিশ্চয়ই আমাদেরকে আমাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে সাহায্য করবে।

ফিচার ইমেজ- Katie Arnold/Al Jazeera

Related Articles