মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, অমুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার তুলনায় মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা গণমাধ্যমে ৩.৫৭ গুণ বেশি আলোচিত হয়। শুধু গণমাধ্যমই না, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ অনেক বিশ্বনেতার টুইট বার্তায়ও দুই ধরনের হামলার ক্ষেত্রে শব্দ চয়নে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
কাজেই গত শুক্রবার (১৫ই মার্চ ২০১৯) যখন নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে এক শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী, ইসলামবিদ্বেষী সন্ত্রাসীর মেশিনগানের এলোপাথাড়ি গুলিতে অন্তত ৫০ জন মুসল্লি নিহত হয়, তখন প্রথমে অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, এই হামলার ঘটনাও হয়তো ‘টেররিজম’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে না।
কিন্তু হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই যখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আসেন, তখন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি এই হামলাকে ‘টেরোরিস্ট অ্যাটাক’ বলে উল্লেখ করেন। হামলার শিকার মুসল্লিদের সম্পর্কে তিনি বলেন, "যারা আহত বা নিহত হয়েছে, তাদের অনেকেই অভিবাসী এবং শরণার্থী হিসেবে নিউজিল্যান্ডে এসেছে দেশটিকে নিজেদের দেশ মনে করে। এবং এটি তাদেরই দেশ। বিপরীতে যে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে, তারই বরং নিউজিল্যান্ডে কোনো স্থান নেই।" প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়- "তুমি হামলার জন্য আমাদেরকে বাছাই করেছ, কিন্তু আমরা পরিষ্কারভাবে তোমাকে বর্জন করছি, নিন্দা করছি।"
কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এরকমই হওয়া উচিত। শুরু থেকেই তিনি প্রচার করে আসছেন শান্তি, সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার বাণী। দেশে দেশে পপুলিজম তথা লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের এই যুগে তার এ যৌক্তিক ভূমিকাই যেন বিশ্ববাসীর কাছে হয়ে উঠেছে অবিশ্বাস্য। সংকটময় মুহূর্তে যোগ্য নেতার মতো আচরণ করে তিনি যেন অন্যান্য দেশের নেতাদের সীমাবদ্ধতাগুলো, তাদের ভুল অবস্থানগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।
নিউজিল্যান্ডের আলোচিত এ প্রধানমন্ত্রীর নাম জাসিন্ডা কেট লরেল আর্ডার্ন, সংক্ষেপে জাসিন্ডা আর্ডার্ন। মাত্র পৌনে পাঁচ মিলিয়ন জনসংখ্যার শান্তিপূর্ণ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডে তেমন কিছু ঘটে না বলে অনেকেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে তেমন কিছু না। কিন্তু নানান কারণেই জাসিন্ডা আর্ডার্ন আগে থেকেই দেশটির ভেতরে এবং বাইরের আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বেশ আলোচিত এবং প্রশংসিত।
৩৮ বছর বয়সী জাসিন্ডা আর্ডার্ন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৭ সালে। গত ১৫০ বছরের ইতিহাসে তিনি দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। একইসাথে তিনি দেশটির তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর পর তিনিই বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে নিজের শিশু সন্তানসহ উপস্থিত হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, সন্তান জন্মদান তার দায়িত্ব পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
জাসিন্ডা আর্ডার্ন নিজেকে একজন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এবং প্রগ্রেসিভ রাজনীতিবিদ হিসেবে দাবি করেন। ২০১৭ সালে তিনি যখন তার দলের প্রধান নির্বাচিত হন, তখন তা নিউজিল্যান্ডের জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার দল রেকর্ড সংখ্যক অনুদান লাভ করে। একের পর এক গণমাধ্যমে উপস্থিতি তার জনপ্রিয়তাকে শীর্ষে নিয়ে যায়, যা জাসিন্ডা ইফেক্ট বা জাসিন্ডাম্যানিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।
জাসিন্ডা ক্ষমতায় আসেন অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শিশুদের দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বিশ্বের পপুলিস্ট নেতারা যেখানে ক্ষমতায় আসেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষাদাগার করে, সেখানে বরাবরই জাসিন্ডার অবস্থান ছিল সকলের প্রতি উদার এবং সহানুভূতিশীল। নিউজিল্যান্ডের আবাসিক সমস্যার অযুহাতে তিনি বৈধ অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি না করার অঙ্গীকার করেন ঠিকই, কিন্তু এর বিপরীত দিকে অধিক সংখ্যক শরণার্থী গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন। বাস্তবেও ক্ষমতায় আসার পর তার সরকার পাপুয়া নিউ গিনি এবং নাউরুতে আটকে পড়া শরণার্থীদেরকে নিউজিল্যান্ডে এনে আশ্রয় দেয়।
সমালোচকদের অবশ্য জাসিন্ডাকে নিয়ে শুরু থেকে সন্দেহ ছিল যে, তিনি হয়তো তার তারকাখ্যাতিকে ছাপিয়ে বাস্তবে দেশের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারবেন না। এবং ক্ষমতায় আসার এক বছর পরেও নিউজিল্যান্ডের রাজনীতিকে কিছুটা বাম দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাকে কৃতিত্ব দেওয়া হলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কেবল বৃদ্ধিই পাচ্ছিল যে, বিভিন্ন খাতে মজুরির নিম্নসীমা বৃদ্ধি করে তিনি বরং নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতিকে স্থবির করে দিচ্ছেন।
কিন্তু গত শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে তার যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি শুধু তাদের নিজের দেশেই না, সারা বিশ্বের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালামের উপদেষ্টা সৃজন পাল সিং টুইটারে মন্তব্য করেন, মাত্র ৩৮ বছর বয়সী জাসিন্ডা এই দুঃসময়েও জাতিকে যেভাবে একত্রে ধরে রেখেছেন, তা তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য শিক্ষণীয়।
জাসিন্ডা আর্ডার্ন শুধু সংবাদ সম্মেলন করেই তার দায়িত্ব শেষ করেননি। যেখানে আমেরিকায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাস শ্যুটিং হওয়ার পরেও অস্ত্র আইন সংশোধনের ব্যাপারে নীতি নির্ধারকদেরকে রাজি করানো যায় না, সেখানে নিউজিল্যান্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রথম হামলা হওয়া সত্ত্বেও হামলার পরদিন সকালেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, শীঘ্রই তিনি দেশটির অস্ত্র আইনে সংশোধনী আনতে যাচ্ছেন। যদিও তিনি ভালো করেই জানেন, এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করা তার জন্য রাজনৈতিকভাবে কতটা কঠিন হবে।
এরপর দুপুরে তিনি সাক্ষাৎ করতে যান হামলায় নিহতদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। সেই সাক্ষাতের সময় মুসলমানদের একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি মুসলিম নারীদের মতো মাথায় কালো রংয়ের স্কার্ফ পরিধান করেন। এসময় তিনি নিহতদের আত্মীয়-স্বজনদেরকেই কথা বলার সুযোগ দেন, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, এরপর তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক এবং অন্যান্য সহযোগিতা প্রদানের কথা ঘোষণা করেন।
ক্ষমতায় আসার পরপরই জাসিন্ডা আর্ডার্নকে গণমাধ্যম ‘অ্যান্টি ট্রাম্প’ হিসেবে উপাধি দিয়েছিল। এই দুঃসময়েই জাসিন্ডা সেটা প্রমাণ করেছেন। শনিবার যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন আমেরিকা নিউজিল্যান্ডকে এই পরিস্থিতিতে কীভাবে সাহায্য করতে পারে, তিনি উত্তর দেন, “মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি এবং ভালোবাসা প্রকাশ করার মাধ্যমে।”
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ট্রাম্পের মতো রাষ্ট্রপ্রধানের সংখ্যা বিশ্বে যত কম হবে, আর জাসিন্ডার মতো নেত্রীর সংখ্যা যত বেশি হবে, এই পৃথিবী থেকে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ততই হ্রাস পাবে। পৃথিবীটা কিছুটাও হলেও মানুষের বসবাসের জন্য আরেকটু উপযোগী হয়ে উঠবে।
This article is in Bangla language. It's about the Prime Minister of New Zealand, Jacinda Ardern and her role after the Mosque attack.
All the references are hyperlinked inside the text.
Featured Image: HAGEN HOPKINS/ GETTY IMAGES