Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জনগণের সুখ প্রতিষ্ঠার মিশনে নেমেছে কোরিয়ার সরকার

অর্থবৈভবের মাঝে ডুবে থেকেও শান্তির যেন অভাব দক্ষিণ কোরিয়ানদের। কর্মক্ষেত্রের সীমাহীন ব্যস্ততা তাদের পকেট ভরালেও কেড়ে নিচ্ছে অবসর যাপনের সময়টুকু। তাই কর্মজীবীদের কাজ কমানো, ছুটি আর বেতন বাড়ানোর মাধ্যমে ‘জাতীয় সুখ’ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি।

২০১৩-এর জাতিসংঘ হিসেব মতে, জীবন নিয়ে দক্ষিণ কোরীয়দের সন্তুষ্টির হার গড়পড়তার চেয়েও অনেক কম। জাতিসংঘ ও OECD (Organisation for Economic Co-operation and Development) নানা রকম সূচকের ভিত্তিতে প্রতি বছর সুখী দেশের তালিকা করে। সূচকের অংশ হিসেবে থাকে মাথাপিছু আয়, জীবন প্রত্যাশা, শিক্ষা, দুর্নীতি ইত্যাদি। কিন্তু সুখ তো কেবল কয়টা সংখ্যার যোগফল নয়, বরং অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক। এ কারণে ৩০,০০০ ডলার মাথাপিছু আয় সত্ত্বেও, বিএমডব্লিউ গাড়ি আর রিমোট কন্ট্রোল্ড শৌচাগার থাকাসত্ত্বেও সুখের আকাল কোরিয়ায়। ‘সব পেয়েছির দেশে’ এসেও যেন তুষ্টি নেই তাদের।

অথচ উন্নয়নের আকাশ ছোঁবার পানে প্রবল কর্মব্যস্ততা দেশটিতে। অধিক উৎপাদনশীল বানাতে গিয়ে অবসাদ মানুষকে বানিয়ে দিচ্ছে উল্টো অনুৎপাদনশীল। চিন্তার ভাঁজ পড়লো সরকারের কপালে। ভাবলো, যে করেই হোক, সুখী রাখতে হবে মানুষকে। হাড়ভাঙা খেটেও দিনশেষে যাতে চওড়া হাসি হাসতে পারে জনগণ।

রাজধানী সিউল; Image Source: Oasis Chance

তাই সরকার হাতে নিলো ভিন্নধর্মী এক ক্যাম্পেইন, ‘Worabel’, ‘Work-Life-Balance’ এর সংক্ষিপ্তরূপ। “লাইনে দাঁড়াও, ব্ল্যাংকচেক নাও”- ধরনের মুফতে বিলাসদ্রব্য বিলানোর ক্যাম্পেইন Worabel নয়। এটি হলো সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী ক্যাম্পেইন, যা আপনাকে বর্তমান উপভোগ করতে ও জীবন নিয়ে সুখী থাকার অভ্যাস রপ্ত করতে সাহায্য করবে।

কোরিয়ায় এখন গেলেই শুনবেন, “অমুক কোম্পানি… বেতন ভালোই। তবে Worabel সুবিধের নয়। তমুক কোম্পানি… বেতন আহামরি না হলেও Worabel বেশ।” সারামিন.কম নামে কোরীয় এক ওয়েবসাইটের জরিপে ৬৫.৫ ভাগ তরুণ বলেছেন, তারা চড়া বেতনের কর্পোরেশনের চাকরির চেয়ে বরং অর্ধেক বেতনে কম ওভারটাইমওয়ালা চাকরিতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন। ২২.৮ ভাগ তরুণ চান, বেতন কম হোক, কিন্তু ওভারটাইম একেবারেই না থাকুক। মানে দাঁড়াচ্ছে, বেতন হোক যেমন তেমন, Worabel চাই খাসা। পর্যাপ্ত ছুটি পাওয়া, প্রাণবন্ত সময় কাটানোটাই তাদের চাওয়া। লক্ষ্য অভিন্ন, সুখী হওয়া। 

প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়ার্ক-লাইফ-ব্যালেন্স কি তবে কোরিয়াতে নেই? সোজাসাপটা জবাব, “একদম না।” তো কেন এই ‘ব্যালেন্স’ খেই হারালো? তিনটি কারণ-

প্রথমত, উন্নত হবার পুঁজিবাদী নেশা পেয়ে বসেছে কোরিয়াকে। কর্মক্ষেত্রে কাজের তাই পাহাড়সম চাপ। OECD-এর তথ্যমতে, দক্ষিণ কোরিয়ার ২০ ভাগ মানুষ সপ্তাহে ৫০ ঘন্টার বেশি কাজ করে। অথচ বিশ্ব শ্রম সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিয়মমতে, কোথাও সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। কর্মঘন্টার হিসেবে কোরিয়ার লোকেরাই সবচেয়ে বেশি কাজ করে, যা রীতিমতো পাগলাটে ব্যাপারস্যাপার।

কোরিয়ার শ্রমজীবী নারীদের বড় অংশই গার্মেন্টসকর্মী; Image Source: Dress & Stripped

দ্বিতীয়ত, কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে ‘কাকাও টক’ নামে একটি যোগাযোগ মাধ্যমের অস্তিত্ব একরকম বিষিয়ে তুলেছে কর্মজীবীদের জীবন। বাসায় গিয়েও যেন শান্তি নেই। কাকাও টকে অফিস-বস দিয়ে দিচ্ছেন নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। কাকাও টকেই ফাইল ক্লিয়ার করে সাবমিট করতে হচ্ছে চাকুরেদের। প্রযুক্তির এমনই মহিমা!

তৃতীয় কারণটি সবচেয়ে গুরুতর। কোরিয়ার সামাজিক মূল্যায়নের ধরনটাই কর্মজীবনকে একঘেয়ে বানিয়ে দিতে যথেষ্ট। এ ব্যাপারে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ ও সংস্কৃতি বিষয়ক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণালয়ের প্রধান ইয়ুনকুক সুহ। তার মতে, আমেরিকার মতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নির্ভর সংস্কৃতি যেখানে, সেখানে সুখের সংজ্ঞাটা পুরোপুরি ব্যক্তির আরোপিত, নিজস্ব স্বাধীনতা। কিন্তু কোরিয়ার সংস্কৃতি হচ্ছে সামষ্টিকতানির্ভর। কীভাবে আমি নিজের জীবন কাটাচ্ছি, সেই প্রশ্নটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ না। বরং এখানে একজন ব্যক্তি নিজেকে সেভাবেই মূল্যায়ন করেন, যেভাবে সমাজের আর দশটা মানুষ তাকে মূল্যায়ন করেন। 

এজন্য স্বাভাবিকভাবেই নিজের তুষ্টির চেয়ে সমাজের কাছে নিজেকে ‘প্রমাণ’ করবার তাগিদটাই যেন বেশি থাকে। সুখের জন্য তাই কোরিয়ানদের চাই কিছু দেখানোর মতো অর্জন, যেমন- সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, লোভনীয় সরকারি চাকরি, নিখুঁত চেহারা (প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে হলেও), বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, সুখের এসব ‘কাঁচামাল’ এর প্রাপ্যতা সীমিত, সবাই তো পায় না। তাই জীবনের ইঁদুরদৌড়ে হতাশাও সেখানে ক্রমবর্ধমান। 

অভিজাত গ্যাংনাম শহরের বিলাসবহুল নাইটক্লাব। সোশাল মিডিয়ায় এসবে ‘চেক-ইন’ দিতে পারার তাগিদ বা না পারার আক্ষেপ কোরিয়ানদের সুখী হওয়ার পথে একটি বিরাট প্রশ্ন; Image Source: 10 Magazine Korea

তো এই ওয়ার্ক-লাইফ-ব্যালেন্সের প্রয়োজনটা কী? প্রয়োজন এটাই যে, এই ব্যালেন্সের অভাবে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কোরিয়ান সমাজে।

আত্মহত্যার হার বিবেচনায় দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের চতুর্থ দেশ এবং প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে কেবল এই দেশটিই আছে সেরা দশের তালিকায়। কর্মজীবনের একঘেয়েমি আর হতাশা যার বিশাল বড় নিয়ামক। নিম্ন জন্মহারের দিক থেকেও এশিয়ায় কোরিয়ার অবস্থান সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের পরেই। এত ব্যস্ততা নিয়ে সন্তান নেওয়া ও লালন-পালনের বাড়তি ঝক্কি নিতে কোন বাবা-মা-ই বা উৎসাহী হবেন! ফলস্বরূপ দেশটিতে বাড়ছে বার্ধক্য সমস্যা। 

তাই কতটা চাপে পড়ে সরকারকে Worabel এর কথা ভাবতে হচ্ছে, বুঝতেই পারছেন। জনগণকে যেকোনো মূল্যে সুখী করার তীব্র তাড়না তাই সরকারের।

এ ক্যাম্পেইনের শুরুতেই যেটি করা হয়েছে তা হলো কর্মঘন্টা কমানো আর মজুরি বাড়ানো। সর্বোচ্চ কর্মঘন্টা ৬৮ থেকে এক লাফে নামিয়ে আনা হয়েছে ৫২-তে। শুধু কি তা-ই? এই আইন ভাঙলে মালিকের পত্রপাঠ ২ বছরের জেল। ওদিকে মজুরিও বাড়ানো হয়েছে ১৬.৪ ভাগ। আসছে বছর তা আরো ১০ ভাগ বাড়ানো হবে। 

Worabel তো অবশ্যই দারুন জিনিস, কিন্তু শ্রমজীবীরা আদতে এর সুফল কতটা পাবেন, সে প্রশ্নের সুরাহা এখনই হচ্ছে না। কেননা কর্মঘন্টা কমানো হলেও কাজের পরিমাণ তো কমেনি। ফলে বাড়তি মজুরি দিয়ে ‘ওভারটাইম’ করানো ছাড়া কোম্পানিগুলোর এমনিও গতি নেই। আর ওভারটাইমের মজুরি শোধ না করবার বদনাম কোরিয়ান মালিকপক্ষের জন্য পুরনো। ২০১২ সালে ৪০% মানুষ ওভারটাইমের মজুরি পাননি। ওদিকে বাড়তি মজুরি চুকোনোর শঙ্কায় কিছু বাস কোম্পানিসহ বেশি কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ও নেবে।

বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ নিজস্ব দাবিতে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিউলের রাস্তায় বিখ্যাত হিউন্দাই কোম্পানির শ্রমিকরা; Image Source: Wall Street Jorunal

এই সরকারি Worabel প্রচলিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। শ্রমক্লিষ্ট পুরুষেরা ভালো মজুরিতে কষ্টেশিষ্টে কিনছেন সস্তা গাড়ি। ছুটি পেলেই হাঁকিয়ে ছুটছেন দূর পাহাড়ে পরিবার নিয়ে বনভোজনে। কিংবা কারখানায় সাদামাটা এপ্রোন জড়িয়ে শৌখিনতা বিসর্জন দেয়া মেয়েটাও এখন সপ্তাহান্তে সানস্ক্রিন মেখে সূর্যস্নান করতে যাচ্ছে সৈকতে, সাথে হয়তো প্রিয় সঙ্গী। কিন্তু সবাই কি এত ভাগ্যবান হচ্ছেন? না। কেবল যেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আন্তরিক হচ্ছে, তাদের কর্মজীবীরাই এ সুবিধা পাচ্ছে। তাই কেবল সরকার নয়, মূলত মালিকপক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে কোরিয়ান শ্রমজীবীদের অভিমত। 

ছুটির দিনে মনের সুখে জেজু দ্বীপে মাছ ধরছেন এক কারখানা শ্রমিক; Image Source: BBC

বিশেষজ্ঞদের মতে, কাজের ফাঁকে পর্যাপ্ত অবসর দেওয়া হলো সমস্যার অর্ধেক সমাধান। অবসর তারা কীভাবে ব্যয় করতে চায়, সেই চাওয়া পূরণেই বাকি সমাধান নিহিত। সেই সঙ্গে পরিপূর্ণ সুখী সামাজিক জীবনের জন্য চাই রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ। সবগুলোই নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার ভাবছে সেসব নিয়েও। তো এই সরকারি উপায়ে ‘সুখ উৎপাদন’-এর বুদ্ধিটা কিন্তু কোরিয়ার নয়। দেশটির রাষ্ট্রপতি এই বুদ্ধিটি মূলত পেয়েছিলেন ভুটান থেকে।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি মুন জে-ইন; Image Source: Sputnik International

প্রশাসনিকভাবে সুখ ‘প্রতিষ্ঠা’ করবার কাজটি বোধহয় সফলভাবে করতে পেরেছে প্রতিবেশী ভুটানই। তারা ২০০৮ সাল থেকে জিডিপি বা গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিমাপ বাদ দিয়েছে। তারা পরিমাপ করে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’। উন্নয়ন জরিপে তাই প্রশ্ন রাখা হয়, ধ্যান করেন কি না, পরিবারের সাথে ঝগড়া করেন কি না, সামাজিক কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাব্যয় কেমন করেন, পরিবারকে কতটা সময় দেন, ঘুমান কতক্ষণ, দেশি পোশাক ভালো লাগে নাকি বিদেশি ইত্যাদি। সুখের পশ্চিমা পুঁজিবাদী ধারণার সূচকগুলোকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।

২০১৬ সালের ভুটান সফরের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি মুন জে-ইন নিজ দেশেও এমন কিছু করবার ব্যাপারে উৎসাহী হন। সেই ‘কিছু’ করবার অংশবিশেষই হলো Worabel। সামনে আরো পদক্ষেপ নেওয়া হবে সে দেশে। ওদিকে সম্প্রতি আস্ত একটা ‘সুখ মন্ত্রণালয়’ই খুলে বসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হওয়া। ভবিষ্যতে সুখ প্রতিষ্ঠায় শুধু কোরিয়াতেই নয়, পৃথিবীর আরো নানা জায়গায় সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাবো, তা বলাই যায়। সুখ যে সবারই আরাধ্য সোনার হরিণ!

ফিচার ইমেজ: Getty Images

Related Articles