১৯৫০ সালে ওল্ড মারাকানা স্টেডিয়ানে ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচটি দেখতে উপস্থিত হয়েছিল ১,৯৯,৮৫৪ জন দর্শক। রীতিমতো অবিশ্বাস্য একটি সংখ্যাই বটে। কিন্তু আসলেই কি সংখ্যাটি খুব বড়? চলুন একটু বিশ্লেষণ করি।
- ২০০৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অভিষেক অনুষ্ঠান দেখতে হাজির হয়েছিল ১৮ লক্ষ মানুষ, যাদের দিয়ে নয়টি মারাকানা স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব।
- ২০১৩ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করেছিল ৩১ লক্ষ মানুষ, যাদের দিয়ে ১৬টি মারাকানা স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব।
- ২০১৫ সালে পোপ ফ্রান্সিসের প্যাপাল উদযাপনে সমবেত হয়েছিল ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ মানুষ, যাদের দিয়ে ৩৫টি মারাকানা স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব।
- আর ২০১৩ সালে সর্বশেষ প্রয়াগরাজ কুম্ভমেলায় অংশ নিয়েছিল ১২ কোটি মানুষ, যাদের দিয়ে ৬০০টি মারাকানা স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব। আর হ্যাঁ, এটি প্রায় জাপানের জনসংখ্যারও সমান!
এই যে কুম্ভমেলার কথা বলছি, এটি হলো মানবজাতির ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণজমায়েত। গত ১৫ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) আরও একবার শুরু হয়ে গেছে ৫০ দিনব্যাপী এই কুম্ভমেলা, এবং প্রথম দিনেই পবিত্র নদীতে স্নানের মাধ্যমে মেলার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ। ধারণা করা হচ্ছে, ৪ মার্চ পর্যন্ত এবারের কুম্ভমেলায়ও ১২ থেকে ১৫ কোটি মানুষ অংশ নেবে।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কালীপুর ইউনিয়নের কোকদণ্ডী গ্রামের ঋষিধামে প্রতি তিন বছর অন্তর কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেটি ভারতের মূল কুম্ভমেলার অন্তর্ভুক্ত নয়। এছাড়া মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ীর দীঘিরপাড় শ্রী শ্রী গনেশ পাগল সেবাশ্রমেও এমন একটি কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
কুম্ভমেলা কী?
কুম্ভমেলা হলো হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় উৎসব। এই উপলক্ষ্যে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা তীর্থস্নান করতে আসেন। তাদের বিশ্বাস, পবিত্র নদীতে স্নান করলে সকল পাপ নদীর জলে ধুয়ে যাবে, এবং তারা পূত-পবিত্র হয়ে উঠবেন। পুরাণেও এমন নির্দেশনা দিয়ে বলা আছে,
"কার্তিকে সহস্র বার, মাঘ মাসে শতবার গঙ্গাস্নানে এবং বৈশাখ মাসে কোটি নর্মদা স্নানে যে ফললাভ হয়, সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ ও শত বাজপেয় যজ্ঞে যে ফললাভ হয়, লক্ষ পৃথিবী প্রদক্ষিণ করলে যে ফললাভ হয়, একবার কুম্ভ স্নানেই তা পাওয়া যায়।"
ঐতিহ্যগতভাবে চারটি কুম্ভমেলাকে প্রকৃত কুম্ভমেলা বলে ধরা হয়। সেই চারটি কুম্ভমেলা হলো: হরিদ্বার কুম্ভমেলা, প্রয়াগ কুম্ভমেলা, নাসিক-ত্রিম্বকেশ্বর সিংহস্থ ও উজ্জ্বয়িনী সিংহস্থ। এই চারটি কুম্ভমেলা পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয় প্রয়াগরাজ (২০১৮ পর্যন্ত নাম ছিল এলাহাবাদ), হরিদ্বার, নাসিক জেলা (নাসিক ও ত্রিম্বক) এবং উজ্জ্বয়িনীতে। মেলার মূলভূমি হিসেবে বিবেচিত হয় হরিদ্বারে গঙ্গার তীর, প্রয়াগরাজে যেখানে গঙ্গা, যমুনা ও পৌরাণিক নদী সরস্বতীর সঙ্গম হয়েছে, নাসিকে গোদাবরীর তীর, এবং উজ্জ্বয়িনীতে শিপ্রার তীর।
সাধারণ কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি চার বছরে একবার। প্রতি ছয় বছর অন্তর হরিদ্বার ও প্রয়াগে অর্ধকুম্ভ আয়োজিত হয়। প্রতি বারো বছর অন্তর প্রয়াগ, হরিদ্বার, উজ্জ্বয়িনী ও নাসিকে পূর্ণকুম্ভ আয়োজিত হয়। বারোটি পূর্ণকুম্ভ অর্থাৎ প্রতি ১৪৪ বছর অন্তর প্রয়াগে আয়োজিত হয় মহাকুম্ভ। ২০১৩ সালের কুম্ভমেলাটি ছিল একটি মহাকুম্ভ।
মেলার অবস্থান ও তিথি
সূর্য ও বৃহস্পতির অবস্থান অনুসারে মেলার অবস্থান নির্ধারিত হয়।
- বৃহস্পতি ও সূর্য সিংহ রাশিতে অবস্থান করলে - নাসিকের ত্রিম্বকেশ্বরে;
- সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করলে - হরিদ্বারে;
- বৃহস্পতি বৃষ রাশিতে এবং সূর্য কুম্ভ রাশিতে অবস্থান করলে - প্রয়াগে;
- সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করলে - উজ্জয়িনীতে।
মেলা আয়োজনের তিথি নির্ধারিত হয় সূর্য, চন্দ্র ও বৃহস্পতির রাশিগত অবস্থান অনুযায়ী। এবারের কুম্ভমেলায় স্নানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারিখ আছে ছয়টি।
- ১৫ জানুয়ারি - মকর সংক্রান্তি
- ২১ জানুয়ারি - পৌষ পূর্ণিমা
- ৪ ফেব্রুয়ারি - মৌনি অমাবস্যা
- ১০ ফেব্রুয়ারি - বসন্ত পঞ্চমী
- ১৯ ফেব্রুয়ারি - মাঘী পূর্ণিমা
- ৪ মার্চ - মহাশিবরাত্রি
কেন হয় কুম্ভমেলা?
হিন্দু পুরাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো সমুদ্রমন্থন। ভগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও মহাভারতে বলা হয়েছে:
সমুদ্রমন্থনের সময় দেব ও দানব উঠিয়ে নিয়ে আসেন মন্দার পর্বতকে। বাসুকি নাগ বেষ্টন করেন তাকে। এমন সময় বিষ্ণু কুমিরের রূপ ধারণ করে সমুদ্রে নিমজ্জিত হন, আর পিঠে ধারণ করেন মন্দার পর্বতকে। পর্বতের আবেষ্টনকারী বাসুকী নাগের দুই প্রান্ত ধরে দেব আর দানব সমুদ্র মন্থন করতে শুরু করেন। এর ফলে একে একে উঠে আসে অসংখ্য মূল্যবান সামগ্রী, আর সেই সাথে অমৃতের ভাণ্ডার। কিন্তু দানবকে তো আর এই অমৃতের ভাগ দেয়া যায় না! তাই দেবগুরু বৃহস্পতির তত্ত্বাবধানে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত পেলেন সেই অমৃতভাণ্ড রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। আর চন্দ্রের কাঁধে বর্তাল প্রহরার ভার। দেবতারা সেই অমৃতভাণ্ড অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পালিয়ে বেড়ালেন তিন লোক– পাতাল লোক, মর্ত্যলোক এবং স্বর্গলোক। তারা বারো দিন ছিলেন মর্ত্যলোকে অর্থাৎ এই পৃথিবীতে। এই বারো দিন পৃথিবীর হিসেবে বারো বছর। এই সময় এই অমৃতভাণ্ড রাখা হয়েছিল চারটি স্থানে– হরিদ্বার, প্রয়াগ, ত্রিম্বকেশ্বর-নাসিক এবং উজ্জ্বয়িনী।
বিশ্বাস করা হয়, এই চারটি স্থানে কলস থেকে অমৃতরস ক্ষরিত হয়েছিল; তাই এই চারটি স্থান অমৃতসুধারস বিজড়িত। এবং এই চার স্থানে স্নানের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরাও কিছুটা অমৃতের ভাগ পেয়ে শুদ্ধ হতে পারবেন, এই আশাতেই তারা তীর্থস্নানে ছুটে আসেন, এবং পালিত হয় কুম্ভমেলা।
তবে এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখা দরকার, পুরাণে সমুদ্রমন্থনের উল্লেখ থাকলেও, অমৃতরস ক্ষরণের কোনো উল্লেখ কিন্তু নেই। এবং কোনো ধর্মগ্রন্থেও কুম্ভমেলার কথা বলা হয়নি। তাই হিন্দু ধর্ম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমুদ্রমন্থনের সাথে কুম্ভমেলার যোগসূত্র স্থাপন অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। এক্ষেত্রে একটি জনপ্রিয় অভিমত হলো, অষ্টম শতকে দার্শনিক আদি শঙ্করের হাত ধরে সূচনা ঘটে কুম্ভমেলার। তিনি সমসাময়িক সন্ন্যাসীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিছুদিন পরপর তাদেরকে কোনো একটি পবিত্র স্থানে এসে জমায়েত হতে হবে ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কের উদ্দেশে। স্বাভাবিকভাবেই তারা বেছে নিয়েছিলেন হরিদ্বার, প্রয়াগের মতো পুণ্যভূমিকে। এবং সেখান থেকেই কালের বিবর্তনে বর্তমান অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে কুম্ভমেলা।
এবারের কুম্ভমেলা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এবারের কুম্ভমেলাটি মহাকুম্ভ না হওয়া সত্ত্বেও, এটি সম্ভবত সর্বকালের সর্ববৃহৎ কুম্ভমেলা হতে চলেছে। এর কারণ ভারতের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, যে জন্য ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার এই কুম্ভমেলাকে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০১৩ সালের সর্বশেষ মহাকুম্ভের চেয়েও তিনগুণের বেশি বাজেট এবারের কুম্ভমেলার। উত্তর প্রদেশ সরকার এই মেলাকে কেন্দ্র করে মোট খরচ করবে ৪,২০০ কোটি রুপি, যেখানে সর্বশেষ কুম্ভমেলার খরচ ছিল ১,৩০০ কোটি রুপি। এছাড়া পূর্বের সকল কুম্ভমেলার বিস্তার সর্বোচ্চ ১,৬০০ হেক্টর জমিতে হলেও, এবার তা বেড়ে হয়েছে ৩,২০০ হেক্টর।
মেলায় তো বটেই, এমনকি পুরো প্রয়াগরাজ শহরই ছেয়ে ফেলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিলবোর্ডে। এছাড়া স্নান এলাকাসমূতেও লাগানো হয়েছে বিশাল বিশাল কার্ডবোর্ড কাট-আউট, যেখানে কায়দা করে প্রচারণা চালানো হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ও তার সরকারের।
সাধারণ তীর্থযাত্রী ও মেলার দর্শনার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে ৩২ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি অস্থায়ী তাঁবু নগরী। এছাড়াও হাসপাতাল, ব্যাংক ও দমকল বাহিনী বসানো হয়েছে কেবল মেলার এই কয়দিনের জন্য। তৈরি করা হয়েছে ১ লক্ষ ২০ হাজার শৌচাগারও। নিরাপত্তা রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে মোতায়েন করা হয়েছে ৩০ হাজার পুলিশ ও প্যারা মিলিটারি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার বিশেষ ট্রেন আসছে কেবল মেলায় আগতদের নিয়ে।
১৯৪৬ সালে মেলায় প্রথম নিখোঁজ ও উদ্ধার ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেলায় আগত কোনো পরিবারের সদস্য বা বন্ধু যদি হারিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তারা এই ক্যাম্পে এসে খোঁজ নিতে পারে। আবার হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিও চাইলে এখানে এসে রিপোর্ট করতে পারে। এ বছরের কুম্ভমেলায় মোট ১৫টি নিখোঁজ ও উদ্ধার ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছে। এবারের ক্যাম্পগুলো সবই কম্পিউটারাইজড, এবং একটির সাথে অন্যটির আন্তঃসংযোগ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি হারিয়ে গেলে সাথে সাথে মেলা প্রাঙ্গনে লাউড স্পিকারে তা জানানো হবে। এছাড়া হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির ছবি ও বিস্তারিত তথ্য ফেসবুক ও টুইটারেও আপলোড করা হবে, যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁর সন্ধান মেলে।
এবারের কুম্ভমেলায় যা কিছু প্রথম
- নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ১২ বছরে একবার কুম্ভ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আর দুটি কুম্ভের মধ্যবর্তী বছরে পালিত হবে অর্ধকুম্ভ। সে হিসেবে ২০১৯ সালে অর্ধকুম্ভ হওয়ার কথা। কিন্তু উত্তর প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পাল্টে দিয়েছেন পূর্বের সকল নিয়ম। তাই ২০১৯ সালের অর্ধকুম্ভটিই পালিত হচ্ছে পূর্ণকুম্ভ হিসেবে। ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি ২০১৯ সালের অর্ধকুম্ভকে পূর্ণকুম্ভ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এছাড়া এখন থেকে প্রতি ১২ বছর অন্তর হওয়া পূর্ণকুম্ভকেই অভিহিত করা হবে মহাকুম্ভ হিসেবে।
- ২০১৭ সালে ইউনেস্কো কুম্ভমেলাকে মানবজাতির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইউনেস্কো কুম্ভমেলাকে অভিহিত করে 'পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ' হিসেবে। ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির পর এটিই প্রথম কুম্ভমেলা।
- এবারের তীর্থযাত্রীরা সুযোগ পাবেন অক্ষত বটের ছায়ায় বসে প্রার্থনা করার। ঋগ্বেদে উল্লেখ রয়েছে, এই বট গাছটির, যেটি সহস্র বছরের পুরনো। বিশ্বাস করা হয়, এই বট গাছটি বেশ কয়েকটি সৃষ্টি ও ধ্বংস চক্র পার করে এসেছে। এতদিন তীর্থযাত্রীরা মূল অক্ষয় বটের পরিবর্তে এর বিভিন্ন রেপ্লিকার নিচে বসে প্রার্থনা করতে পারতেন। তবে এবার তারা মূল অক্ষয়ের বটের নিচে বসেই প্রার্থনা করার সৌভাগ্য অর্জন করবেন। স্নানের দিনগুলো বাদে প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সকলে অক্ষয় বটের নিচে গিয়ে প্রার্থনা করতে পারবেন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
This article is in Bengali language. It is about Kumbh Mela, the largest gathering of mankind. Necesarry references have been hyperlinked inside.
Featured Image © Ankit Srinivas/BBC