Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লিউ ইয়ংবিয়াও: ক্রাইম থ্রিলার লেখক, নাকি ভয়ংকর খুনী?

মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও তার গতিপথ কিন্তু উপন্যাসের চেয়েও কম রহস্যময় নয়। মানব মনের রহস্যময়তা বিজ্ঞানীদের পক্ষে এখনো পূর্ণাঙ্গরূপে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি, যেমন বিশ্লেষণ করা যায় না একজন জনপ্রিয় লেখক কেন ডাকাতি ও খুনের মতো নৃশংস কাজে জড়িয়ে পড়ে? লিউ ইয়ংবিয়াও তেমনি এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ, চীনের একজন জনপ্রিয় লেখক হয়েও যিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন ডাকাতি ও খুনের মতো নিষ্ঠুর পেশায়।

লিউ ইয়ংবিয়াওয়ের স্কেচ ছবি; Source: Punch Newspapers

লিউ ইয়ংবিয়াও একজন জনপ্রিয় চাইনিজ ক্রাইম থ্রিলার লেখক। রহস্য গল্পের লেখক হিসেবে সারা চীন জুড়েই তার রয়েছে ব্যাপক খ্যাতি, পেয়েছেন একাধিক পুরস্কারও। ১৯৮৫ সালে কলেজ জীবনে থাকা অবস্থায়ই একটি ম্যাগাজিনে প্রথম তার লেখা ছাপা হয়। ২০০৫ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘এ ফিল্ম’ প্রকাশিত হয়। এরপর আর থেমে থাকেননি তিনি। লিখেছেন একের পর এক উপন্যাস। তার বইগুলোর যেমন ছিল কাটতি, তেমনি তার প্রায় সব উপন্যাসই পাঠকদেরকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রাখতো।

লিউ ইয়ংবিয়াও ; Source: Twitter.com

২০১৪ সালে তিনি একটি রোমান্টিক থ্রিলার উপন্যাস লেখেন, যার উপর ভিত্তি করে স্থানীয় এক টিভিতে ৫০ এপিসোডের টিভি সিরিজও নির্মিত হয়। সিরিয়ালটিও দর্শকদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়। চীনের অন্যতম বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলো তার সাথে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকতো। ২০১৩ সালে চীনের মর্যাদাপূর্ণ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন চীনা রাইটার্স এসোসিয়েশনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হন লিউ।

মাও সেতুংয়ের মর্মর মূর্তির সামনে লিউ ইয়ংবিয়াও ; Source: corriere.it

২০১০ সালে প্রকাশিত হয় লিউয়ের এক সাড়া জাগানো থ্রিলার বই ‘গিল্টি সিক্রেট’। বইটির মুখবন্ধে লিউ লেখেন যে, তিনি পরবর্তীতে আরেকটি রহস্য উপন্যাস লিখেবেন যেটি হবে পুরোপুরি সাসপেন্সে ভরা, রহস্যে আবৃত। পাঠক এতে পাবেন গোয়েন্দা গল্পের আমেজ। লেখক গল্পের মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে মুখবন্ধে জানান, পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একজন সুন্দরী লেখিকা একের পর এক খুন করে যাবেন এই বইয়ের কাহিনীতে।

লিউ-র এক সাড়া জাগানো থ্রিলার বই ‘গিলটি সিক্রেট’ ; Source: theguardian.com

লেখক বইটির নাম ঘোষণা করেন ‘দ্য বিউটিফুল রাইটার হু কিল্‌ড’। কিন্তু বইটি এখনো পর্যন্ত তিনি শেষ করতে পারেননি। কাজেই বইটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। তাহলে কি পুলিশ এই মুখবন্ধ পড়েই খুনীকে শনাক্ত করেছিলেন? কিন্তু ঘটনাটি আদতে তা ছিলো না।

এই খুনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের ২২ বছর পেছনে ফিরে যেতে হবে। ১৯৯৫ সালের ২৯ নভেম্বর এক সন্ধ্যাবেলা, চীনের পূর্ব ঝেজিয়াং প্রদেশের হুজোও শহরের এক গেস্ট হাউজে একই সাথে খুন হন চারজন ব্যক্তি। ঐ রাতে খুন হওয়া গেস্ট হাউজের একজন অতিথির খোয়া যাওয়া জিনিসপত্র ও তাদের ময়নাতদন্ত থেকে প্রাথমিকভাবে ডাকাতি বলেই খুনের মোটিভ হিসেবে ভাবা হয়। কিন্তু গেস্ট হাউজের মালিক দম্পতি ও তাদের তের বছর বয়সী নাতির খুন হবার পিছনে মোটিভ কী ছিল, তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলো না তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা।

১৯৯৫ সালে হুজোও শহরের সেই গেস্ট হাউজ যেখানে খুন হন একসাথে চারজন ব্যক্তি ; Source: theguardian.com

পুলিশ সেদিন ঐ অতিথিশালায় থাকা অন্যান্য স্টাফ ও অতিথিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। দুই পুলিশের ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদ ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে, সে রাতেই আনহুই প্রদেশের দুজন লোক ঐ গেস্ট হাউজে এসেছিল। তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলছিল। তারা দুজনেই হয়তো এই ঘটনার পিছনে দায়ী। পুলিশের অনুমান, ঐ দুজন ব্যক্তি অতিথিদের মালপত্র ডাকাতির উদ্দেশ্যে গেস্ট হাউজে প্রবেশ করেছিল। প্রথমে যে বোর্ডার ঘরে ঢোকে, সে জেগে যাওয়ায় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে ডাকাতরা ‘ইউ’ নামের ঐ ব্যক্তিকে খুন করে। হয়তোবা পুরো ঘটনাকে অন্য খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই দুই ডাকাত গেস্ট হাউজের মালিক দম্পতি ও তাদের নাতিকে খুন করে।

পুলিশের তদন্তে উঠে আসে আনহুই প্রদেশের দুজন লোক এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ; Source: vox.com

কিন্তু তারপরও পুলিশের কাছে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় সত্যিকার খুনীকে ধরা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। খুনীকে চিনতে পারার কোনো চাক্ষুষ প্রমাণও পুলিশের কাছে ছিল না। খুনি কোনো প্রমাণও ফেলে যায়নি যা অনুসরণ করে খুনীকে ধরা যায়। খুনী ও তাদের খুনের মোটিভ নিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং বিভিন্ন তদন্ত কর্মকর্তা নানারকম তথ্য উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু কোনোটিই হালে পানি পায়নি। উপস্থাপন করা সেই তথ্যগুলোতে কোনো উপযুক্ত ক্লু না পাওয়ায়, সেসব তথ্য খারিজ করে দেয়া ছাড়া পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের তেমন কোনো উপায় ছিল না। আর এভাবে অন্যান্য খুনের মামলার মতোই এই ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যায়। এভাবে কেটে যায় ২২ টি বছর।

কিন্তু হঠাৎই ২০১৭ সালে আবার আলোর মুখ দেখে খুনের মামলাটি। এই বছরের জুন মাসে চীনের ঝেজিয়াং পুলিশ মামলাটি আবার সামনে নিয়ে আসে। সেই রাজ্য পুলিশ বিভিন্ন মামলার কাজে প্রায় ষাট হাজারের মতো ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করে। সেসব ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে পুলিশ ২২ বছর আগে সেই গেস্ট হাউজে খুন হওয়া একজনের শরীর থেকে পাওয়া ফিঙ্গার প্রিন্টের মিল খুঁজে পান, যার ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে ভিক্টিমের শরীরে পাওয়া খুনীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে যায়, তিনি আর কেউ নন, চীনের বিখ্যাত রহস্য ঔপন্যাসিক লিউ ইয়ংবিয়াও!

ভিক্টিমের শরীরে খুনীর যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় তারে সাথে মিলে যায় লিউ ইয়ংবিয়াওয়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ; Source: thejakartapost.com

এই তদন্তের সাথে জড়িত মূল কর্মকর্তা ঝু জিচেয়াং সাংবাদিকদের জানান, এই খুনের মামলায় খুনীকে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। কারণ খুনীর সাথে ভিক্টিমের কোনোরকম সম্পর্ক ছিল না। আর খুনীও এর আগে কোনোরকম অপরাধে জড়িত ছিল না। এই মামলা সমাধানে ২২ বছর লাগার পেছনে তিনি জানান, পূর্বে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য উন্নতমানের কোনো প্রযুক্তি ছিল না, যার ফলে খুনীকে সনাক্ত করা যায় নি। বর্তমানে ডিএনএ টেকনোলজির আধুনিকায়নের ফলে ষাট হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের মধ্য থেকে সহজেই খুনীকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ৫৩ বছর বয়সী লেখক লিউ ইয়ংবিয়াওকে আনহুই প্রদেশে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। লিউয়ের সহযোগী হিসেবে ওয়াং নামের ৬৪ বছরের আরও এক ব্যক্তিকে ঐ গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়।

আনহুই প্রদেশের যে এলাকা থেকে লিউকে গ্রেফতার করা হয়; Source:dailymail.co.uk

পুলিশ যখর লিউকে গ্রেফতারের জন্য তার বাড়িতে এসে পৌঁছায়, তখন লিউ পুলিশের তদন্ত দলকে জানান, তিনি গত ২২ বছর ধরে এই দিনটির অপেক্ষায় আছেন। গ্রেফতারের সময় লিউ পুলিশের এক কর্মকর্তাকে একটি চিঠি দেন। তিনি ঐ কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন চিঠিটি যেন তার স্ত্রীকে পৌঁছে দেয়া হয়।

গ্রেফতার করার পর লিউকে পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে আসা হয়; Source: South China Morning Post

কী আছে সেই চিঠিতে? ‘দ্য গার্ডিয়ন’ পত্রিকায় দেয়া তথ্য হতে জানা যায়, স্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে লিউ তার স্ত্রীকে লেখেন, “নিজের সাথে দীর্ঘ লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ২২ আগের করা কৃতকর্মের ফল আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। অপেক্ষায় ছিলাম, কখন তা শেষ হবে? শেষ পর্যন্ত দিনটি এসেই গেলো।

২২ বছর আগে ঘটে যাওয়া কৃতকর্মের ফল লিউকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে যা থেকে তিনি আজ মুক্ত বলে  মনে করেন ; Source: nypost.com

লিউ ২২ বছর পূর্বে গেস্ট হাউজের সেই হত্যাকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে স্বীকার করে নিলেও, কেন তিনি এই খুন করেছিলেন? কেনইবা ২২ বছর আগে  ডাকাতির মতো জঘন্য পেশায় নিজেকে জড়িয়েছিলেন, সে বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তেমন কিছু জানাতে চাননি বলে তদন্তকারী এক কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে জানান।

তদন্ত কর্মকর্তাদের জেরার মুখে লিউ ; Source: newsjs.com

তবে ফাং মিং নামের লিউয়ের গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক জানান যে, এক দরিদ্র পরিবারে লিউর জন্ম। পরিবারে সবসময় লেগে থাকতো আর্থিক অনটন। নিজের একাগ্রতায় লিউ গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। অল্প বয়সেই স্কুলের এক পত্রিকায় সম্পাদনার কাজে জড়িত ছিলেন। কিছুদিন গ্রামেরই এক স্কুলে সাহিত্য নিয়ে ছাত্রদের পড়াতেনও। তিনি খুবই কম কথা বলতেন এবং উঁচু গলায় তাকে কথা বলতে কেউ কখনো দেখেনি। মুখে হাসি থাকতো না বললেই চলে। সবসময় তার মুখে হতাশা লেগেই থাকতো।

লিউ নাকি ঐ হত্যাকান্ডের চার বছর পর থেকে আত্মদংশনে ভুগছিলেন। নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত করতে পারতেন না। এভাবেই তার এতগুলো বছর কেটেছে। এবার তিনি স্বস্তি পাবেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানান।

ফিচার ইমেজঃ sixthtone.com

Related Articles