Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উত্তর কোরিয়ার ষষ্ঠ পারমাণবিক পরীক্ষা, কোরীয় উপদ্বীপে অশান্তির আদ্যোপান্ত

সর্বময় নেতা কিম জং-উনের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়া গত দু’বছরে চালানো আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক বোমা আর মিসাইলের সফল পরীক্ষাগুলো মার্কিন জোটের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ৩ সেপ্টেম্বরের হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা। সেদিন সকালেই উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কেসিএনএ দাবি করে “উত্তর কোরিয়ার কাছে আগের চেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা আছে”। আর এই সংবাদ প্রচারের ঘন্টাখানেক পরেই যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-জরিপ অধিদপ্তর উত্তর কোরিয়ার পানগেয়ি-রি পারমাণবিক কেন্দ্রের কাছে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করে। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে এই ভূকম্পনের কারণ হিসেবে নিশ্চিত করে ষষ্ঠবারের মতো চালানো পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা।

ষষ্ঠবারের মত উত্তর কোরিয়া চালিয়েছে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা; Source: twimg.com

নিউ ইয়র্ক টাইমসের দেওয়া তথ্য অনুসারে, সর্বশেষ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ চালানো পঞ্চম পারমাণবিক পরীক্ষার চেয়ে ষষ্ঠ এই পরীক্ষাটি প্রায় ১৬ গুণ শক্তিশালী এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরের উপরে নিক্ষেপ করা বোমার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী। ২০০৬ সালের ৯ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া তাদের প্রথম ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আর অবরোধ উপেক্ষা করেও নিয়মিত বিরতিতে ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকে উত্তর কোরিয়া।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে উঠার দিনলিপি; Source: dw.com

তবে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচী শুধু ভূগর্ভে চালানো পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষাগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে নতুন দুশ্চিন্তার কারণ। উত্তর কোরিয়ার দাবি অনুসারে, তাদের মজুদে থাকা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আঘাত হানা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র; Source: dw.com

জাপানের আকাশসীমায় উত্তর কোরিয়ার মিসাইল

যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা শুরুতে উত্তর কোরিয়ার কাছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এসব আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র থাকার ব্যাপারটিকে গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ‘কেসিএনএ’তে প্রকাশিত ছবি আর সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার সফল পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়াকে নতুন করে চিন্তার খোরাক যোগাচ্ছে। ২৯ আগষ্ট হঠাৎ করেই উত্তর কোরিয়ার ছোঁড়া মিসাইল জাপানের আকাশসীমার উপর দিয়ে উড়ে যায়। কোনো অঘটন না ঘটিয়ে, মিসাইলটি ১,৭০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে প্রশান্ত মহাসাগরে পতিত হয়। তবে কোনো অঘটন না ঘটলেও কূটনৈতিক মহলে ঝড় উঠে যায় এই ঘটনার পরপরই। উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার মিসাইল নিক্ষেপের সক্ষমতা নিয়ে যারা প্রশ্ন করতেন তাদের মুখেও জোর চপেটাঘাত পড়ে। তবে এটাই প্রথম নয়, ১৯৯৮ সালেও জাপানের আকাশসীমার উপর দিয়ে মধ্য ক্ষমতাসম্পন্ন মিসাইল নিক্ষেপ করেছিলো উত্তর কোরিয়া।

জাপানের আকাশসীমায় উত্তর কোরিয়ার মিসাইলের গতিপথ;  Source: www.nytimes.com

তবে বরাবরের মতো এই ঘটনার পরেও জাপানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ‘Hwasong-12’ নামের এই মিসাইলটি প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাটি গুয়ামের খুব কাছেই পতিত হয়েছে। তাই এই ধরনের মিসাইল নিক্ষেপকে আমেরিকার ঘাটিতে হামলার সমকক্ষ গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করবে; পেন্টাগন নিউ ইয়র্ক টাইমসের বরাত দিয়ে এমনটাই জানিয়েছে পেন্টাগন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো এবে এই ঘটনার পরে বিবৃতি দিয়েছেন, “জাপান সরকার তার জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত”।

দূরপাল্লার ‘Hwasong-14’ মিসাইল; Source: nytimes.com

তবে উত্তর কোরিয়ার এই হুমকি মোকাবেলায় প্রস্তুত ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনও। প্রশান্ত মহাসাগরে থাকা ৯৭,০০০ টন ওজনের মার্কিন রণতরী ‘ইউএসএস কার্ল ভিনসন’-এ সুসজ্জিত আছে টমাহক মিসাইল, কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান আর আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী প্রযুক্তি দিয়ে। মার্কিন ভূখন্ডের দিকে নিক্ষেপিত যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবেলায় কাজ করছে উত্তর কোরিয়ার উপরে কড়া নজরদারি করছে প্রশান্ত মহাসাগরে থাকা আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিগুলো।

উত্তর কোরিয়ায় নির্মিত হাইড্রোজেন বোমা বহনে সক্ষম মিসাইল; Source: nytimes.com

ঘটনার প্রতিক্রিয়া

জাপানের আকাশসীমা লংঘন করার রেশ কাটতে না কাটতেই ষষ্ঠবারের মতো পারমাণবিক পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন উত্তর কোরিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া। রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা ‘কেসিএনএ’-এর বরাত দিয়ে উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমা বহনে সক্ষম মিসাইলের ছবিও উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জোরদারের কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে টুইট করেছেন

“United States is considering, in addition to other options, stopping all trade with any country doing business with North Korea.’’

উত্তর কোরিয়ার এই আচরণে ক্ষুব্ধ দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। ঘোষণাটি দেওয়ার পরে দক্ষিণ কোরিয়া চালিয়েছে মহড়া। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথ মহড়ায় অংশ নেওয়ার আগাম সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।

চীনের প্রতিক্রিয়া

উত্তর কোরিয়ার সাথে সরাসরি স্থলসীমান্ত থাকা চীন বরাবরই জাতিসংঘের আদেশের সীমানা ঘেঁষে বাণিজ্য করে আসছে। জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মেনে উত্তর কোরিয়া থেকে কয়লাসহ যাবতীয় আমদানি বন্ধ রাখলেও চীন বরাবরের মতোই তেল ও খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করতে রাজি নয়। চীনের দাবি অনুযায়ী, খাদ্য এবং জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে দেশটিতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি উত্তর কোরিয়া থেকে চীন জিংক, লোহা সহ বেশ কিছু খনিজ দ্রব্যাদি ছাড়াও সামুদ্রিক খাদ্য আর গার্মেন্টস সামগ্রী ক্রয় করে থাকে।

চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অটুট আছে উত্তর কোরিয়ার; Source: www.nytimes.com

কূটনৈতিকদের মতে মূলত দুটি কারণে চীন উত্তর কোরিয়ায় কোনো ধরনের মানবিক কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখতে চায় না।

  •  প্রথমত, চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার আপাত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ায় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হলে চীন অভিমুখে উদ্বাস্তুর স্রোত শুরু হবে। উত্তর কোরিয়ার সাথে দীর্ঘ স্থলসীমান্ত থাকায় এই সমস্যা সমাধান করা চীনের জন্যে বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।

‘The Friendship Bridge’ নামে খ্যাত এই সেতু দিয়ে চীন আর উত্তর কোরিয়ার মধ্যে পণ্য পরিবহণের সিংহভাগ সম্পন্ন হয়ে থাকে; Source: www.nytimes.com

  •  দ্বিতীয়ত, উভয় কোরিয়া যদি একত্র হয়ে যায় কিংবা উত্তর কোরিয়া যদি মার্কিন প্রভাবে চলে আসে, তবে কোরীয় উপদ্বীপ জুড়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আরো জেঁকে বসবে।

বরাবরের মতো নীরব রাশিয়া

বরাবরে মতোই উত্তর কোরিয়ার মিসাইল হামলা কিংবা পারমাণবিক পরীক্ষার ব্যাপারে নীরব রাশিয়া। উত্তর কোরিয়ার এই ধরনের হামলা এই এলাকার শান্তি বিঘ্নিত করবেই বলেই অভিমত রাশিয়ার। উত্তর কোরিয়ার সাথে ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় বরাবরই রাশিয়া এই এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রকল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছে রাশিয়া।

ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে ইতোমধ্যে পুতিন পৌঁছেছেন চীনে; Source: Mikhail KLIMETYEV

৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে ইতোমধ্যে পুতিন পৌঁছেছেন চীনে। সেখানে আলোচনা হতে পারে সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে। তবে গার্ডিয়ানে দেওয়া এক বিবৃতিতে ক্রেমলিন মুখপাত্র জানিয়েছেন কোরীয় উপদ্বীপের এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব জোরদার কূটনৈতিক পদক্ষেপের সাহায্যে।

সমাধান কোথায়?

জার্মানি, ফ্রান্সের পাশাপাশি এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে ব্রিটেন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাকি দেশগুলোও। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি আলোচনা শেষে মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। তবে বিশ্ব নেতাদের অনেকেরই আশা, সঠিক কূটনৈতিক পদক্ষেপই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে।

ফিচার ইমেজ- nytimes.com

Related Articles