Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নোভিচক নার্ভ এজেন্ট: এক অব্যর্থ রাসায়নিক মারণাস্ত্রের আদ্যোপান্ত

অতি সম্প্রতি সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালকে ‘নোভিচক’ নামে এক বিশেষ ‘নার্ভ এজেন্ট’ প্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টায় সারা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় রাশিয়াকে সরাসরি দায়ী করে প্রথমে ব্রিটেন এবং পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৪০ জনেরও বেশি রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাশিয়া এই নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের ঘটনা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। তারপরেও কিসের ভিত্তিতে এই ‘নার্ভ এজেন্ট’ প্রয়োগের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা হচ্ছে?

সের্গেই স্ক্রিপালকে যখন ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়, তখন সেখানে পাওয়া রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিশ্লেষণ করে ব্রিটেনের ‘ডিফেন্স সায়েন্স এন্ড ল্যাবরেটরি’ এটিকে ‘নোভিচক’ নামের এক নার্ভ এজেন্ট হিসেবে শনাক্ত করেছে।

সের্গেই স্ক্রিপালকে যখন ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করার পরে নমুনা সংগ্রহ করছেন বিশেষজ্ঞরা; Source: Getty Images

এই নোভিচক সরাসরি প্রয়োগকৃত ব্যক্তির স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে। যার ফলাফল হিসেবে সারা দেহের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গে তৈরি হয় নানা ধরনের জটিলতা। ফলে প্রয়োগকৃত ব্যক্তিকে খুব দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হলে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য এই রাসায়নিক মারণাস্ত্র নোভিচকের আদ্যোপান্ত নিয়েই এই লেখা।

মানবদেহের উপর নার্ভ এজেন্টের প্রভাব; Source: Centers for Disease Control and Prevention

১. সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্ম নোভিচকের

রুশ ভাষায় নোভিচক অর্থ দাঁড়ায় ‘নতুন আগমনকারী’। ১৯৭০-৮০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করেই সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত সব রাসায়নিক অস্ত্র। সত্তরের দশকে শুরু হওয়া ‘ফোলিয়ান্ট‘ নামক গোপন সামরিক অপারেশনের সময় চতুর্থ প্রজন্মের রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে পরিচিত এই নোভিচক তৈরি করা শুরু হয়েছিলো। দীর্ঘদিন গোপনে থাকার পর ১৯৯০ এর দিকে রাশিয়ান গণমাধ্যমে দেওয়া এক বক্তব্যে রসায়নবিদ ড. ভিল মিরজায়ানভ নোভিচকের অস্তিত্ব নিয়ে বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে রাশিয়ার পক্ষ ত্যাগ করে মিরজায়ানভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ শুরু করেন এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই নার্ভ এজেন্টের খুঁটিনাটির বিবরণ দিয়ে দেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই ১৯৯৯ সালে আমেরিকান বিশেষজ্ঞদের একটি দল উজবেকিস্তানে অবস্থিত সোভিয়েত আমলের সবচেয়ে বড় রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির কারখানাটি বিকল করে দিতে সক্ষম হয়।

তবে ড. ভিল মিরজায়ানভের মতে, এটিই একমাত্র কারখানা ছিলো না। রাশিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন গোপন গবেষণাগারে স্বল্প পরিসরে নোভিচক তৈরি করার সক্ষমতা আছে রাশিয়ার।

২. শনাক্ত করা খুবই মুশকিল

অতি উচ্চমাত্রার বিষাক্ত এই নার্ভ এজেন্ট শনাক্ত করা খুবই মুশকিল। ‘ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং’ এর ফার্মাকোলজির অধ্যাপক গ্যারি স্টিফেনস এর মতে,

“নোভিচক সাধারণ নার্ভ এজেন্ট ‘সারিন’ কিংবা ‘ভিএক্স’ এর তুলনায় প্রায় পাঁচ থেকে আটগুণ বেশি বিষাক্ত আর কোনো নমুনা থেকে একে শনাক্ত করার ধাপও বেশ জটিল।” 

‘নোভিচক’ জাতীয় নার্ভ এজেন্ট শনাক্ত করা খুবই মুশকিল; Source: PA Images

৩. নোভিচকের কত রূপ?

নোভিচকের অন্যতম বড় সুবিধা হলো একে তরল, কঠিন কিংবা সুক্ষ্ম গুঁড়া আকারেও সংরক্ষণ, পরিবহন করা যায়। মূলত এই নোভিচক এজেন্টকে দুটি কম বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান হিসেবে পরিবহন করা যায়। এবং সেই উপাদানগুলো এয়ারপোর্টে বহন করার উপর নিষেধাজ্ঞা নেই।  ফলে এয়ারপোর্ট কিংবা কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় খুব সহজে। ব্যবহারের সময় ঐ দুইটি কম বিষাক্ত রাসায়নিকের সঠিক সংমিশ্রণই হয়ে ওঠে এক নীরব মৃত্যুদূত নার্ভ এজেন্ট।

নোভিচকের ‘জেনেরিক’ রাসায়নিক সংকেত; Source: chemistryworld.com

৪. কীভাবে কাজ করে নোভিচক

নোভিচক যে অন্যান্য যেকোনো নার্ভ এজেন্টের চেয়ে শক্তিশালী এই ব্যাপারটি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। নোভিচক মূলত একটি জৈব-ফসফেট জাতীয় জটিল রাসায়নিক বিষ। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নোভিচক গ্রহণের ত্রিশ সেকেন্ড থেকে দুই মিনিটের স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হানে। আর নোভিচক এই কাজটি করে মানব স্নায়ুতন্ত্রের সাথে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ন এনজাইম ‘এসিটাইলকোলিন-এস্টারেজ’কে বিকল করার মাধ্যমে। এই এনজাইম বিকল হয়ে গেলে স্নায়ু থেকে পেশিতে তথ্য আদান প্রদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এর ফলে মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ধীরে ধীরে বিকল হতে শুরু করে।

৫. নার্ভ এজেন্টে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিকার কী?

নার্ভ এজেন্টে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত শুরুতেই অস্বস্তিতে ভোগেন। একটু পরেই বমি শুরু হয় এবং এর পরে দেখা দেয় খিঁচুনি। এই পর্যায়ে যদি আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না দেওয়া হয় তাহলে মৃত্যু অবধারিত। যদি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে প্রথমেই সেই ব্যক্তির কাপড়চোপড় সরিয়ে নিয়ে তার শরীর ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত। চোখ ভালোভাবে পরিষ্কার করে ব্যক্তিকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারলে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব। এরপর বিষের কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে আনার জন্য এন্টিডোট ব্যবহার করা হয়।

ড. ভিল মিরজায়ানভের মতে, নোভিচকে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য দুটি এন্টিডোট দেওয়া যেতে পারে। এর একটি হলো ‘এট্রোপিন’ আর অন্যটি ‘এথিন’। তবে এর কোনোটিই ব্যক্তির বেঁচে ওঠার এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার নিশ্চয়তা দেয় না।

‘এট্রোপিন’ নামক এন্টিডোট দিয়ে বাঁচানো যেতে পারে নোভিচকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে; Source: mcguffmedical.com

৬. রাশিয়ার সম্পৃক্ততা কতটুকু?

মস্কোর মুখপাত্ররা বরাবরই নোভিচকের ব্যাপারে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়ে আসছেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রাশিয়ার ভূখণ্ডে ‘নোভিচক’ নামের কোনো নার্ভ এজেন্ট তৈরি কিংবা কারো উপর প্রয়োগ করার সাথে জড়িত নয়। এমনকি মস্কোর বিবৃতি অনুসারে, ‘নোভিচক’ নামটিও দলত্যাগী সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন যারা নব্বইয়ের দশকে আমেরিকা কিংবা অন্যান্য দেশের সাথে হাত মিলেয়েছেন।

ড. ভিল মিরজায়ানভের বিশ্বাস, রাশিয়া সের্গেই স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের সাথে সরাসরি জড়িত। কারণ রাশিয়াতেই এটি সর্বপ্রথম তৈরি হয়েছে আর রাশিয়াই এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সোভিয়েত আমলের সব রাসায়নিক অস্ত্রের কাজ থেমেছে ১৯৯২ সালেই। ২০১৭ সালে বাকী থাকা অস্ত্রগুলোও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বের রাসায়নিক অস্ত্রের কর্তা প্রতিষ্ঠান ‘OPCW’র পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে রাশিয়ার কাছে জমা থাকা ৩৯,৯৬৭ মেট্রিক টন রাসায়নিক অস্ত্র সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু রাশিয়া কখনোই OPCW এর কাছে তাদের নোভিচক থাকার ব্যাপারে স্বীকার করেনি। এবং তৈরির ব্যাপারেও কোনো তথ্য দেয়নি। তাই রাশিয়ার কাছে নোভিচকের মজুদ আছে এই ব্যাপারে অনেকের মনেই জোরালো সন্দেহ রয়ে গেছে। এজন্য এই ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য সংগৃহীত নমুনাও প্রেরণ করা হয়েছে OPCW এর কাছে। তবে যদি রাশিয়া OPCW এর তদন্তের কোনো পর্যায়ে বাধা দেয় তবে এই সংস্থা সেটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার জন্য পাঠাতে পারবে। তবে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা থাকায় সেই আলোচনা কতদূর ফলপ্রসু হয় সেটিও দেখার বিষয়।

রাশিয়া এই ব্যাপারে তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ড. ভিল মিরজায়ানভের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১-৭৩ সালের মধ্যে রাশিয়ার ‘শিকহানি’ নামক শহরেও একটি গবেষণাগারে স্বল্প পরিসরে নোভিচক তৈরি করা হতো। আর তাই OPCW এর কাছে রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ হ্যামিশ ডি ব্রেটন মধ্য রাশিয়ায় অবস্থিত ‘শিখহানি’ শহরে গিয়ে তদন্ত করার অনুমতি চেয়েছেন।

ফিচার ইমেজ: Shutterstock

Related Articles