Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিনছি কাওয়াকামি: জাপানের শেষ নিনজা

নিনজা হাতোড়ির কার্টুন আজকালের বাচ্চাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। আপনি নিজেও হয়তো টিভি সেটের সামনে বসে অনেকবার দেখে ফেলেছেন এই কার্টুনটি। তবে আজ সেই কার্টুন নিনজা নয়, কথা বলবো বাস্তবের নিনজা জিনছি কাওয়াকামির কথা। ৬৩ বছর বয়স্ক এই নিনজাকে জাপানের সর্বশেষ নিনজা বলে মনে করা হয়।

জাপানের শেষ নিনজা জিনছি কাওয়াকামি; Source: GineersNow

নিনজুতসু ব্যবহারকারীদের নিনজা বলে সম্বোধন করা হয়। নিনজুতসু এক বিশেষ ধরনের মার্শাল আর্ট। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত এই বিশেষ মার্শাল আর্টের নাম নিনজুতসু। জাপানের কিছু অঞ্চলে উৎপত্তি হয় এই নিনজুতসুর। শোগান ও সামুরাই যুগে জাপানের খুব পরিচিত ব্যাপার ছিল নিনজা। কূটনীতি, গোয়েন্দাগিরি আর মানুষ খুনের জন্য তখন বেছে নেওয়া হত নিনজাদের। সারা শরীর কাপড়ে মোড়া নিনজাদের চোখ দুটো দেখা যেত কেবল।

শুরিকেন এবং ফুকিয়া নামের বেশ কিছু অস্ত্র ব্যবহার করতো তারা। কোনো সমস্যা ছাড়াই নীরবে মেরে ফেলতো মানুষকে। তলোয়ার চালাতে পারদর্শী ছিল নিনজারা। বিশাল সব পাথরের দেয়াল টপকে শত্রুপক্ষের খবর নিয়ে আসতো তারা। এই পারদর্শীতা আর পরিচয়- সবটুকুই থাকতো গোপন। মুখে মুখে নিজেদের শিক্ষা পরের প্রজন্মের কাছে দিয়ে যেত নিনজারা। খুব গোপন আর রহস্যময় একটি ব্যাপার হওয়ায় মানুষ নিনজাদের সম্পর্কে নানারকম কথা ভেবে নিয়েছে, তাদেরকে সাজিয়েছে মনের মাধুরী দিয়ে। বর্তমানে সেই পুরনো নিনজারা আর নেই। হাতে গোনা কয়েকজন নিনজা জাপানে টিকে ছিল কয়েক বছর আগেও। তবে বর্তমানে জিনছি কাওয়ামিকেই এই দেশের একমাত্র জীবিত নিনজা বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

জিনছি কাওয়াকামি একজন প্রকৌশলী। কোকা নিনজা বংশ গড়ে উঠেছিল প্রায় ৫০০ বছর আগে ৫৩টি পরিবারের সমন্বয়ে। আর তাদের মধ্যে একটি ছিল ব্যান পরিবার। ব্যান পরিবারের ২১তম প্রজন্ম জিনছি কাওয়াকামি। মাত্র ছয় বছর বয়সে নিনজুতসুর প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন এই মানুষটি। তার প্রশিক্ষক ছিলেন মাসাজো ইশিদা। অবশ্য সেসময় না বুঝেই এসব শিখছিলেন জিনছি। জীবনটাই তখন এমন ছিল। তাই প্রশিক্ষণকে জীবনের একটি অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন তিনি। মনে কখনো প্রশ্ন আসেনি যে, এই কাজগুলো কেন করছেন।

ব্যান পরিবারের শেষ নিনজা সদস্য তিনি; Source: Ancient Origins

আমি ভাবছিলাম তিনি আমাকে চোর হওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কারণ তিনি আমাকে কী করে ধীরে হাঁটতে হয় আর বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হয় সেটা শিখিয়েছিলেন।” তবে এসবের পাশাপাশিও নানারকম ঔষধ আর বিষ্ফোরক তৈরি করতেও শিখেছিলেন তিনি সেসময়। এখনও গাছগাছড়া দিয়ে এমন অনেক ঔষধি তৈরি করতে পারেন জিনছি যেগুলো গ্রহণ করলে আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন যে, আপনার নির্ঘাত কোনো একটি সংক্রামক রোগ রয়েছে। আঠারো বছর বয়সে নিনজাদের উত্তরাধীকারসূত্রে পাওয়া পার্চমেন্ট বা স্ক্রল পান কাওাকামি। তবে এমন না যে, নিনজা হতে গেলে রক্তের সম্পর্ক থাকতেই হত। বাইরের অনেকেই নিনজা হতে চাইতো আর তাদেরকে গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করতো নিনজারা।

আরো অনেকে ছিল বটে, তবে সমসাময়িকদের মধ্যে কাওয়াকামির কোকা এবং প্রতিবেশি ইগা গোত্র ছিল সবচাইতে বেশি শক্তিশালী ও চোখে পড়ার মতো। ষোড়শ শতকে কয়েক শতকের গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে সেকিগাহারার যুদ্ধ জিতে নিয়ে জাপানকে আবার এক করেন শক্তিশালী লেইয়াসু তোকিগাওয়া। তার জন্যই কাজ করতো কোকা আর ইগা গোত্র। সেই যুগেই প্রথম নিনজাদের নিয়ে পাকাপাকিভাবে কিছু অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন করা হয়। সেখানে নিনজাদের কাজ কী হবে তার সুন্দর বর্ণনা ছিল। মোট কথায় বলা যায়, নিনজারা মোটেই আর্থিক দিক দিয়ে নিনজা হওয়ার উপরে নির্ভর করতো না। কারণ এ কাজে তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেত না। ফলে দিনের বেলায় তাদের জীবিকার তাগিদে নানাবিধ কাজ করতে হতো। যোদ্ধা, কৃষক, ব্যবসায়ী- সব পেশার মানুষের মধ্যেই সামুরাইরা লুকিয়ে ছিল এমনটা মনে করা হয়।

নিজের নিনজা যন্ত্রপাতির সাথে কাওয়াকামি; Source: YouTube

একবিংশ শতাব্দীর নিনজা কাওাকামি একজন প্রকৌশলী, যাকে দেখে ভাবার উপায় নেই যে, তিনি নিনজা। বিশেষ করে স্যুট টাই পরে তাকে আর দশজন স্বাভাবিক জাপানির মতোই দেখায়। তবে কাওয়াকামির জাপানের শেষ নিনজা হওয়ার তকমাটা একেবারে সঠিক নয়। ৮০ বছর বয়সী মাসাকি হাতসুমি, তোগাকুরে গোত্রের দলপতি, নিজেকে নিনজা বলে দাবী করেন। হাতসুমি বর্তমানে বুজিনকান নামক একটি আন্তর্জাতিক মার্শাল আর্টস প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ৩,০০,০০০ প্রশিক্ষণার্থী আছেন, যাদের মধ্যে অনেকে মিলিটারি এবং পুলিশে কাজ করেন। তবে হাতসুমির দাবিটা কতটা পাকাপোক্ত সেটা ভাবার ব্যাপার।

কথা বলছিলাম জিনছি কাওয়াকামিকে নিয়ে। জিনছি কাওয়াকামির কান এবং চোখ যথেষ্ঠ প্রখর। একটি সুঁই মাটিতে পড়লে সেটার শব্দও বুঝে ফেলতে পারেন কাওয়াকামি। ডেথ স্টার ব্যবহার করা এবং দ্রুত অদৃশ্য যাওয়ার প্রশিক্ষণও আছে তার। কাওয়াকামির মতে, তাকে শেষ নিনজা বলা হয় কারণ গত পাঁচ শতকের মধ্যে তিনিই একমাত্র নিনজা যিনি সরাসরি নিনজা মাস্টারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কাওয়াকামি কি নিনজাদের বহু বছরের প্রথা চালিয়ে যাবেন? আর কাউকে নিনজা হওয়ার কৌশল শিখিয়ে দেবেন তিনি?

নিনজা ডে-তে জিনছি কাওয়াকামি; Source: The Straits Times

না, এমন কোনো ইচ্ছাই নেই কাওয়াকামির। তার মতে নিনজা এই আধুনিক যুগের সাথে মানায় না। এখন ইচ্ছে করলেই কাউকে বিষ্ফোরক ব্যবহার করে বা বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা যায় না। বিষগুলো হয়তো তৈরি করা যায় কিন্তু সেটার কোনো ব্যবহার নেই। আর তাই নিজের মধ্যে থাকা প্রশিক্ষণ এভাবে নিজের মধ্যে নিয়েই মারা যেতে চান তিনি।

নিনজাদের সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ভাবনা আছে অনেকের মনে, সেটাকে দূর করতে চান কাওয়াকামি। তার ব্যান গোত্রের শেষ নিনজা হতে চান তিনি। নিনজা রহস্যের মূল ব্যাপারটাই, কাওয়াকামির মতে, তাদের মানুষকে অবাক করে দেওয়ার পদ্ধতি। একজন মানুষকে তার দুর্বলতাগুলো ব্যবহার করে বোকা বানানো নিনজাদের আসল কাজ। এমন সব স্থানে গিয়ে লুকানো যেগুলো কখনোই মানুষের মাথায় আসবে না- এটাও নিনজাদের আরেকটি কৌশল। শত্রুর মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, শত্রুর এত কাছে চলে যাওয়া যেখানে শত্রু আপনাকে কখনো দেখবেই না- এই কৌশলগুলো তাদেরকে অন্য যোদ্ধাদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে।

কাওয়াকামির ইগা-রিউ জাদুঘর; Source: Star2.com

বর্তমানে টোকিওর ২২০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ইগা-রিউ নিনজা জাদুঘর নামে একটি জাদুঘর তৈরি করেছেন জিনছি কাওয়াকামি। কেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিনজাদের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছেন তিনি। সেখানেই একটি গবেষণা চালাচ্ছেন কাওয়াকামি। তার মতে, নানারকম চলচ্চিত্র আর লেখায় সবসময় নিনজারা একটু নেতিবাচকভাবেই প্রকাশ পেয়েছেন। কথায় কথায় রক্তারক্তি, খুনোখুনি, প্রতারণা- এসবের মিশেলে সবাই কাল্পনিকভাবে সাজিয়েছেন নিনজাকে। তবে বাস্তবে নিনজাদের কাছে কাউকে খুন করা বা আঘাত করা ছিল সবচাইতে নিচু কাজ। কয়েকটি স্তরে যদি নিনজাদের দায়িত্ব ভাগ করা হয়, তাহলে মারামারি ছিল তার সবচাইতে নিচের ধাপে।

সাধারণত মারামারি, প্রতারণা ইত্যাদির চাইতে গোয়েন্দা হিসেবে শত্রুপক্ষের কোনো তথ্য এনে দেওয়াকেই সবচাইতে সম্মানীয় কাজ মনে করতো নিনজারা। অনেকদিন না খেয়ে, অনেক দূরের রাস্তায় কোনো বিরতি না দিয়ে চলার মতন কষ্টের কাজগুলোর জন্য মানানসই ছিল নিনজারা। বর্তমানে অবশ্য বেশিরভাগ মানুষের চোখে নিনজাদের এই ইতিবাচক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলা হয় না। এ নিয়ে দুঃখ আছে জিনছি কাওয়াকামির। তবে নিজের নিনজা পরিচয় নিয়ে গর্বিতও তিনি।

ফিচার ইমেজ: GineersNow

Related Articles