Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল হত্যাচেষ্টার নেপথ্যের রহস্য: দায়ী কি পুতিন?

রুশ গুপ্তচার সের্গেই স্ক্রিপালের পুরো জীবনটাই কেটেছে রহস্যময়তায়। আশেপাশের মানুষের কাছে তার পরিচয় ছিল অত্যন্ত দেশপ্রেমিক এক সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে, যিনি তার পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কল্যাণের জন্য। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, উচ্চপদস্থ সোভিয়েত গোয়ন্দা পরিচয়ের আড়ালে বাস্তবে তিনি কাজ করছিলেন ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্সের (MI6) হয়ে!

সের্গেই স্ক্রিপাল; Source: Financial Times

ঘটনার সেখানেই শেষ না। বিচারে শাস্তির রায় হলেও তিনি ক্ষমা পেয়ে যান গোপন চুক্তির বলে। মুক্তি পেয়ে বসবাস করতে থাকেন ব্রিটেনে, যে দেশটির প্রতি ছিল তার মূল আনুগত্য। কিন্তু রহস্য সেখানেই শেষ হয়নি, বরং বলা যায় শুরু হয়েছে মাত্র। গত ৪ মার্চ হঠাৎ করেই শক্তিশালী রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয় সের্গেই এবং তার মেয়ে ইউলিয়াকে। সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে রাশিয়ার দিকে, আরো স্পষ্টভাবে বললে ভ্লাদিমির পুতিনের দিকে। সের্গেই স্ক্রিপালকে হত্যাচেষ্টার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সাথে ব্রিটেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক চরম অবনতিতে পৌঁছে। পাল্টাপাল্টি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে দেশ দুটি। মৌখিক বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স এবং ন্যাটোও।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পুতিন কেন এরকম সংকটময় একটি মুহূর্তে এরকম বিতর্কিত একটি কাজ করতে যাবেন? অথবা আসলেই কি তিনি সের্গেই স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের ঘটনার জন্য দায়ী? তার চেয়ে বড় কথা, কে এই সের্গেই স্ক্রিপাল? ঠিক কী করেছিলেন তিনি? কেনই বা তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ? চলুন জেনে আসি সের্গেই স্ক্রিপালের রহস্যময় জীবন সম্পর্কে।

কে এই সের্গেই স্ক্রিপাল?

বিমান বাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদেতে থাকার সময় স্ক্রিপাল; Source: BBC

সের্গেই ভিকট্রোভিচ স্ক্রিপালের জন্ম ১৯৫১ সালের ২৩ জুন, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কালিনিনগ্রাদে। সুঠাম এবং শক্ত-সমর্থ দৈহিক গঠনের অধিকারী স্ক্রিপাল পড়াশোনা শেষে যোগ দিয়েছিলেন সোভিয়েত বিমানবাহিনীর বিশেষ সৈন্যদল ডেসান্টনিকিতে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তান আক্রমণ করে, তখন স্ক্রিপাল ছিলেন সেখানে যাওয়া প্রথম সৈন্যদের মধ্যে একজন। আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসার পর তিনি মস্কোর ডিপ্লোম্যাটিক মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদান করেন এবং ধীরে ধীরে কর্নেল পদে উন্নীত হন।

মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে থাকার সময়ই স্ক্রিপাল তার দক্ষতা এবং মেধা দিয়ে সোভিয়েত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা GRU এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। তিনি প্রবেশ করেন এসপিওনাজের জটিল জগতে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কূটনীতিকের ছদ্মবেশে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে তার গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। GRU এর গঠন ছিল কেজিবি বা অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ে ভিন্ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও সংস্থাটি আগের মতোই নিজের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে এবং স্ক্রিপালও তার দায়িত্বে বহাল থাকেন।

ডাবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপাল

১৯৭৭ সালে মধ্য এশিয়ায় স্ক্রিপাল; Source: The Times

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে স্ক্রিপালের পোস্টিং ছিল স্পেনে। তিনি ছিলেন স্পেনে নিযুক্ত রাশিয়ার মিলিটারি অ্যাটাশে। সে সময়ই তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দ্বারা প্রলুব্ধ হন। মাত্র ১ লাখ ডলারের বিনিময়ে তিনি বিক্রি করে দেন নিজের দেশকে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্সের হাতে তিনি তুলে দেন অন্তত ২০,০০০ পৃষ্ঠার গোপন নথিপত্র। ফাঁস করে দেন ব্রিটেনে নিযুক্ত কয়েক ডজন (ভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ৩০০) রাশিয়ান গোয়েন্দার নাম, ঠিকানা, ছদ্মনাম, ফোন নাম্বার এবং অপারেশনের বিস্তারিত তথ্য। অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয় রাশিয়া।

রাশিয়ার কোমারস্যান্ট (Kommersant) পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, স্ক্রিপালের দ্বারা রাশিয়ার গোয়েন্দা কার্যক্রমের যে ক্ষতি হয়েছিল, তাকে রাশিয়ার ফেডেরাল সিকিউরিটি সার্ভিস, FSB আরেক বিখ্যাত GRU কর্মকর্তা ওলেগ পেনকোভস্কির সাথে তুলনা করেছিল। পেনকোভস্কি ছিলেন তৎকালীন GRU এর প্রধানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তিনি ব্রিটিশ এবং আমেরিকানদের কাছে কিউবাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল স্থাপনের গোপন অপারেশনের তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন, যার ফলে ১৯৬২ সালে ‘কিউবা মিসাইল ক্রাইসিস‘ শুরু হয়েছিল এবং বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।

পেনকোভস্কি অবশ্য ধরা পড়েছিলেন। বিচারে তার মৃত্যুদন্ড হয়েছিল এবং ১৯৬৩ সালে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। সে তুলনায় স্ক্রিপালকে বেশ ভাগ্যবানই বলতে হবে। কারণ স্ক্রিপাল তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়েননি। তিনি ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে গেছেন আরো প্রায় এক দশক। ১৯৯৯ সালে তিনি GRU থেকে অবসর নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন। তিনি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতাও করতেন। কিন্তু পুরো সময়টা জুড়েই তার সাথে মস্কোর ব্রিটিশ দূতাবাসে নিযুক্ত এমআইসিক্স গোয়েন্দাদের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

স্ক্রিপালের নাটকীয় গ্রেপ্তার এবং বিচার

এফএসবির হাতে আটকের সময় স্ক্রিপাল; Source: Sky News

২০০৪ সালে রাশিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা স্ক্রিপালকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন অনুসন্ধান এবং নজরদারি করে নিশ্চিত হওয়ার পর সে বছর ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার ফেডেরাল সিকিউরিটি সার্ভিস, FSB এক অভিযানের মাধ্যমে তাকে আটক করে। তার বাড়ির সামনে থেকে তাকে আটক করে ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে থেকে প্রস্তুত থাকা সংবাদিকদের মাধ্যমে পুরো অভিযানের ঘটনাটিটির ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয় এবং তা রাশিয়ার টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করা হয়।

স্ক্রিপালের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। গোপনে অনুষ্ঠিত বিচারে সামরিক ট্রাইবুনালের কাছে তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই তার বিচারকার্য শেষ হয়। ২০০৬ সালে তাকে ১৩ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয় এবং তার সামরিক পদবী ও সকল অর্জন বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো অপরাধে এত লঘু শাস্তি নিয়ে সে সময় রাশিয়ার গণমাধ্যমে সমালোচনা হয়, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারকার্যে সহযোগিতা করায় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করায় স্ক্রিপালের শাস্তি হ্রাস করা হয়েছে।

গোয়েন্দা বিনিময়ের আওতায় ক্ষমা এবং মুক্তি লাভ

বাবার সাথে স্ক্রিপাল; Source: BBC

ঘটনা নতুন মোড় নেয় ২০১০ সালে, যখন হঠাৎ করেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ সের্গেই স্ক্রিপালকে ক্ষমা করে দেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা গুপ্তচরদেরকে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে লঘু শাস্তি দেওয়া কিংবা ক্ষমা করে দেওয়ার ঘটনা শুনতে অদ্ভুত বা অযৌক্তিক মনে হলেও বাস্তবে এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে থাকে। আর যেকোনো রাষ্ট্র এটা করে তার নিজের স্বার্থেই, যেন নিজেদের কোনো গুপ্তচর শত্রু রাষ্ট্রের হাতে ধরা পড়লে পূর্বে আটককৃত শত্রুরাষ্ট্রের গুপ্তচরদের বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে আনা যায়।

স্ক্রিপালের ক্ষেত্রেও ঠিক সেরকম ঘটনাই ঘটেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় কিংবা তার পরেও শুধু যে ব্রিটিশ বা আমেরিকানদের নিযুক্ত গোয়েন্দা রাশিয়ার হাতে ধরা পড়েছিল, এমন নয়। রাশিয়ার নিযুক্ত অনেক গোয়েন্দাও ধরা পড়েছিল ব্রিটিশ এবং আমেরিকানদের হাতে। ২০১০ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় রাশিয়ান গোয়েন্দাদের একটি বড় চক্রকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। বহু বছর ধরে তারা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রাশিয়াতে পাচার করে আসছিল।

কন্যা ইউলিয়াকে কোলে নিয়ে স্ক্রিপাল; Source: BBC

বছরের পর বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা মেধাবী ও দক্ষ এ গোয়েন্দাদেরকে হারাতে রাজি ছিল না রাশিয়া। অন্যদিকে রাশিয়াতে বন্দী কিছু গোয়েন্দাকেও ফেরত নেওয়া জরুরী ছিল মার্কিন এবং ব্রিটিশদের। ফলে তারা পরস্পরের সাথে আলোচনা শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত বন্দী বিনিময়ে একমত হয়। ২০১০ সালের জুলাই মাসে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা এয়ারপোর্টে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি রাশিয়ান এবং মার্কিন বিমানে দুই পক্ষের গোয়েন্দাদের এ বিনিময় সম্পন্ন হয়।

স্ক্রিপালসহ রাশিয়ার হাতে বন্দী থাকা মোট চারজন গোয়েন্দাকে তুলে দেওয়া হয় এফবিআইর হাতে। আর বিনিময়ে রাশিয়া ফেরত পায় এফবিআইর হাতে বন্দী দশজন রাশিয়ান এজেন্টকে। স্নায়ুযুদ্ধের পর এটি ছিল গোয়েন্দা বিনিময়ের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি।

ইংল্যান্ডে স্ক্রিপালের নিভৃত জীবন

ইংল্যান্ডে সের্গেই স্ক্রিপাল; Source: The Times

রাশিয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সের্গেই স্ক্রিপালের স্থান হয় ইংল্যান্ডের সলসবারিতে। সেখানে তিনি অনেকটা নিভৃতিই জীবন যাপন করতেন। অভিযোগ আছে, ইংল্যান্ডে আসার পরেও তিনি ব্রিটিশ এবং অন্যান্য ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন। অবশ্য রাশিয়া ছেড়ে চলে আসায় তার পক্ষে নতুন কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব ছিল না। ধারণা করা হয়, তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ধারণা দিতেন।

রাশিয়ার দৃষ্টিতে তিনি বিশ্বাসঘাতক হলেও তার পরিবারের রাশিয়াতে যাওয়া আসার ব্যাপারে কোনো বিধি নিষেধ ছিল না। তার ছেলেমেয়েরা প্রায়ই ইংল্যান্ড এবং রাশিয়াতে আসা যাওয়া করত। তার স্ত্রী ২০১২ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার বড় ভাইও বয়সজনিত কারণে দুই বছর আগে মারা যান। এই দুইজনের মৃত্যু স্বাভাবিক হলেও তার ছেলে হঠাৎ করেই গত বছর মার্চ মাসে মস্কো সফরকালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৩ বছর। মৃত্যুর কারণ হিসেবে যকৃতের অকার্যকারিতাকে দায়ী করা হলেও পারিবারিকভাবে এই মৃত্যুকে রহস্যজনক হিসেবেই বিবেচনা করা হতো।

রাসায়নিক বিষ প্রয়োগে স্ক্রিপালকে হত্যাচেষ্টা

বিষ প্রয়োগের পর যে বেঞ্চটিতে অচেতন হয়ে পড়ে গিয়েিলেন স্ক্রিপাল, সেটি ঘিরে রাখা হয়েছে; Source: Peter Nicholls/ REUTERS

গত ৪ মার্চ হঠাৎ করেই সের্গেই স্ক্রিপাল নতুন করে বিশ্বজুড়ে সংবাদের শিরোনাম হন, যখন তার এবং তার মেয়ের উপর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগে তাদেরকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। তার মেয়ে, ৩৩ বছর বয়সী ইউলিয়া স্ক্রিপাল সে সময় মস্কো থেকে ছুটি কাটাতে এসে তার সাথে অবস্থান করছিলেন। তারা দুজনেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাদেরকে সাহায্য করতে যাওয়া পুলিশের এক কর্মকর্তাকেও গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, তবে বর্তমানে তিনি আশঙ্কামুক্ত।

ঠিক কীভাবে তাদের উপর রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে, তদন্তকর্মকর্তারা তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে আক্রান্তদের শরীরে পাওয়া পদার্থটির নমুনা এবং তাদের শারীরিক লক্ষণ দেখে তারা নিশ্চিত হন, এটি বিশেষ ধরনের ‘নার্ভ এজেন্ট’, যা সরাসরি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা পদার্থটিকে ‘নোভিচক এজেন্ট‘ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের উপর ব্যবহৃত সারিন গ্যাস, কিংবা উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের সৎ ভাইকে হত্যায় ব্যবহৃত ভিএক্স এর চেয়েও মারাত্মক

স্ক্রিপালের উপর ব্যবহৃত এই ‘নোভিচক’ হলো এমন এক ধরনের রাসায়নিক নার্ভ এজেন্ট, যা শুধুমাত্র রাশিয়ার কাছেই আছে। স্নায়ু যুদ্ধের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিউন বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণ করে, যার মধ্যে নোভিচকও ছিল। রাসায়নিক অস্ত্র প্রস্তুতকারক এক সাবেক সোভিয়েত রসায়নবিদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সে সময় এ রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণের কাজে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার মানুষ নিযুক্ত ছিল, যার মধ্যে অন্তত এক হাজার মানুষ নিযুক্ত ছিল শুধুমাত্র নোভিচক নির্মাণে। তার মতে, জটিল প্রস্তুত প্রণালীর কারণে কোনো রাষ্ট্রের বাইরে ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে নোভিচক এজেন্ট প্রস্তুত করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

হত্যাচেষ্টার রাজনৈতিক প্রভাব

২০১৪ সালে মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপাল; Source: The Times

স্ক্রিপাল হত্যােষ্টার ঘটনাটি ব্রিটেন তো বটেই, পুরো বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ব্রিটেনের কাউন্টার টেররিজম বাহিনীর ২৫০ বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা ঘটনাটির তদন্ত করছে। নোভিচক এজেন্টটি কোথা থেকে এসেছে তা নির্ণয় করা এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থটি অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে কিনা, তা অনুসন্ধান করার ব্যাপারে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মানুষের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে, ৭৫০টি নমুনা সংগ্রহ করেছে এবং ৪,০০০ ঘন্টার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা শুরু করেছে।

তদন্ত কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কাউকে দায়ী না করলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ ঘটনার জন্য সরাসরি রাশিয়াকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, হয়তো রাশিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সরাসরি এর নির্দেশ দিয়েছে, অথবা তারা তাদের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। তিনি রাশিয়াকে ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব বরিস জনসন সরাসরি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে অভিযুক্ত করে বলেন, “খুব বেশি সম্ভাবনা” যে, পুতিন নিজেই এ হামলার  নির্দেশ দিয়েছেন।

সের্গেই এবং ইউলিয়া স্ক্রিপাল; Source: Sky News

স্বভাবতই রাশিয়া তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে এবং প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের অভিযোগের তীব্র সমালোচনা করেছে। ফলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এক সপ্তাহের মধ্যে ২৩ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে ব্রিটেন থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একইসাথে রাশিয়ার সাথে উচ্চ পর্যায়ের সকল যোগাযোগ স্থগিত করারও নির্দেশ দিয়েছেন। আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কোনো সদস্য এবং কোনো ব্রিটিশ মন্ত্রীও রাশিয়াতে যাবেন না বলেও জানানো হয়।

পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াও এক সপ্তাহের মধ্যে ২৩ জন ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে। তারা একইসাথে রাশিয়াতে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং সেন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত ব্রিটিশ কনস্যুলেটও বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কারের এ ঘটনাকে গত তিন দশকের মধ্যে ব্রিটেনের সাথে রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের সবচেয়ে বড় অবনতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

হত্যাচেষ্টার জন্য কি আসলেই রাশিয়া দায়ী?

যে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বিষাক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই রেস্টুরেন্টে আগে কোনো এক সময়; Source: The Times

সের্গেই স্ক্রিপালের হত্যাচেষ্টার পেছনে আসলে কে দায়ী, এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। তদন্তে যেহেতু এখনও কিছু প্রমাণিত হয়নি, তাই এখন পর্যন্ত সবই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই সীমিত। ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সমর্থকরা এ ঘটনার পেছনে রাশিয়াকে দায়ী করছে প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমত, শুধুমাত্র রাশিয়ার কাছেই নোভিচক এজেন্ট আছে বলে ধারণা করা হয়। এবং দ্বিতীয়ত, রাশিয়া এরকম ঘটনা আগেও ঘটিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে।

কিন্তু যদি শুধুমাত্র রাশিয়ার কাছেই এ রাসায়নিক অস্ত্র থাকে, তাহলে কেন তারা এটি ব্যবহার করবে? এর উত্তর হতে পারে, আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করলেও তারা এর মাধ্যমে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চায় যে, তারা ইচ্ছে করলেই বিশ্বের যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় তাদের শত্রুদের উপর আক্রমণ করতে পারে। এছাড়া এমনও হতে পারে, রাষ্ট্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরকে হত্যার মাধ্যমে তারা হয়তো বর্তমান গোয়েন্দাদেরকে একটি সতর্ক বার্তা দিতে চায়।

এর আগে ২০০৬ সালে আরেকজন দেশদ্রোহী রাশিয়ান গোয়েন্দা আলেক্সান্ডার লিটভিনেনকোকেও প্রায় একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল। দুজন রাশিয়ান নাগরিক তার চায়ের সাথে তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিশিয়ে তাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তদন্তে ঐ হত্যাকান্ডের পেছনে রাশিয়ার হাত ছিল বলে উঠে আসে। এছাড়াও বাজফিডের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, গত কয়েক দশকে ব্রিটেনে এমন অন্তত ১৪টি হত্যাকান্ড ঘটেছে, যেগুলোর পেছনে মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রাশিয়ার ভূমিকা আছে বলে সন্দেহ করেন।

ইংল্যান্ডে নিজ বাড়ির সামনে সের্গেই, ইউলিয়া এবং অন্য একজন; Source: Financial Times

তবে শুধুমাত্র রাশিয়ার কাছে নোভিচক এজেন্ট আছে বলে যে দাবি করা হয়, তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। ইগর মরোজোভ নামে এক রাজনীতিবিদের বরাত দিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম স্পুটনিক দাবি করেছে, রাশিয়া অনেক আগেই সব ধরনের নার্ভ এজেন্টের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী পুরানো সকল নার্ভ এজেন্ট ধ্বংস করে ফেলেছে।অন্যদিকে রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রায়্যাবকোভ এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া দাবি করেন, নোভিচক নামে কোনো রাসায়নিক পদার্থ রাশিয়া কখনো তৈরি করেনি। এবং অন্যান্য যেসব রাসায়নিক অস্ত্র তাদের কাছে ছিল, সেগুলোও তারা ২০১৭ সালে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেছে।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এই হামলার জন্য পাল্টা ব্রিটেনকেই দায়ী করেছেন। তার দাবি অনুযায়ী, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাবেক সোভিয়েত বিজ্ঞানী পশ্চিমা দেশগুলোতে বাস করছে। তাদের সাথে থাকা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্রিটেনের তৈরি নার্ভ এজেন্টই এই হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একই দাবি করেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে নিযুক্ত রাশিয়ার প্রতিনিধি ভ্লাদিমির চিজোভও। তিনি ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে অবস্থিত একটি গবেষণাগারকে নোভিচক তৈরির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।

ব্রিটেনকে দায়ী না করলেও ব্রিটেনের কাছেও যে নোভিচক এজেন্ট থাকতে পারে, সে সম্ভাবনা চ্যাথাম হাউজের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিভাগের গবেষণা পরিচালক ড. প্যাট্রিশিয়া লুইসও স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ব্রিটেনের সামরিক গোয়েন্দারা যে এত দ্রুত রাসায়নিক পদার্থটিকে নোভিচক হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে, তা থেকেই বোঝা যায় তাদের এর রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে। তার মতে, রাশিয়া ছাড়াও অন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশের কাছে যদি স্বল্প পরিমাণে নোভিচক না থাকে, তবে সেটাই আশ্চর্যজনক হবে।

সের্গেই এবং তার মেয়ে ইউলিয়া; Source: Rex Features

রাশিয়ার নির্বাচনকে সামনে রেখে পুতিন এরকম একটি ঘটনা ঘটাতে পারেন কিনা, এর পক্ষে-বিপক্ষেও বিভিন্ন যুক্তি আছে। একদিকে মনে হতে পারে, পুতিন হয়তো নির্বাচনকে সামনে রেখে ইচ্ছে করেই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, যেন তার আপোষহীনতা এবং বিশ্বকে পরোয়া না করার চরিত্র দ্বারা ভোটারদেরকে আরো আকৃষ্ট করতে পারেন। অন্যদিকে মনে হতে পারে, ব্রিটেন হয়তো পুতিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্বাচনের আগে জনগণের মধ্যে তার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে চাচ্ছে।

তবে মূল ঘটনার জন্য যারাই দায়ী হোক না কেন, তদন্তে কিছু প্রমাণিত হওয়ার আগেই সরাসরি রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে কূটনৈতিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যে ভুল পদক্ষেপ, তা মনে করেন ব্রিটেনেরই অনেক রাজনীতিবিদ। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের মতে, পুলিশ কোনো প্রমাণ সংগ্র করতে পারার আগেই তড়িৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা সুবিচারও প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, কিংবা ব্রিটেনের জাতীয় নিরাপত্তাও রক্ষা করতে পারবে না।

করবিন যদিও উল্লেখ করেননি, তবে এরকম প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের ঘটনাটি স্মরণ করা যেতেই পারে। সে সময়ও কোনো শক্ত প্রমাণ ছাড়াই ভুল (অথবা মিথ্যা) গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণ করে দেশটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। রাশিয়া ব্যাপারেও ব্রিটেন আবারও প্রমাণ ছাড়াই পদক্ষেপ নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, যার ফলাফল হয়তো শেষ পর্যন্ত কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না।

ফিচার ইমেজ- YURI SENATOROV/ KOMMERSANT/ REUTERS

Related Articles