Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক অদ্ভুত গোয়েন্দাগিরি: সাইকেল চুরি রহস্য

গোয়েন্দা গল্প ভালোবাসেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুবই বিরল। গোয়েন্দা গল্পে থাকে রহস্য, সাসপেন্স, থ্রিল এবং গল্পের আকর্ষণীয় যবনিকা পতন। আজ পাঠকদের সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এমন এক সত্যিকার গল্পের সন্ধান দেয়া হবে, যেখানে কিছুটা গোয়েন্দা গল্পের ছোঁয়া পাঠক পেতেই পারেন।

ঘটনার শুরু একটি সাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে। পুরো ঘটনাই রীতিমতো রোমাঞ্চকর এবং নাটকীয়তায়পূর্ণ। কীভাবে একজন ভদ্রমহিলা তার সাইকেল হারালেন, কীভাবে তার হদিস পেলেন, আর ঠিক কীভাবে তার হারানো সাইকেল উদ্ধার করলেন- তা কোনো গোয়েন্দা গল্পকেও হার মানায়। ঘটনার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে রহস্য, সাসপেন্স ও উত্তেজনায় ভরপুর মুহূর্ত।

ঘটনার সূত্রপাত

জেনি মর্টন হামফ্রেস যুক্তরাজ্যের বিস্টল শহরের এক স্থানীয় অধিবাসী। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। ৮০০ ইউরো দিয়ে কেনা সাইকেলটি ছিল তার খুবই পছন্দের। যখনই সুযোগ পেতেন, বেরিয়ে পড়তেন তার সাইকেল নিয়ে। একসময় জেনির নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠলো এই প্রিয় সাইকেলটি। কিন্তু  হঠাৎই একদিন চুরি হয়ে গেলো তার সাইকেল।

জেনি মর্টন হামফ্রেস; Source: bbc.com

সাইকেল চুরি যাওয়াটিও ছিল বেশ ভূতুড়ে। একদিন তিনি তার সাইকেল নিয়ে বিস্টল বন্দরের কাছেই একটি কাজে গিয়েছিলেন। একটা নিরাপদ জায়গায় তালাচাবি দিয়ে সাইকেলটি আটকানোও ছিল। কিন্তু চোর কখন এসে যেন চেইন দেয়া তালা কেটে সাইকেল নিয়ে চম্পট হয়ে গিয়েছে! জেনি কাজ সেরে ফিরে এসে দেখেন, তার সাইকেলটি সে জায়গায় নেই। তন্ন তন্ন করে আশেপাশে খুঁজেও কোনো হদিশ পেলেন না। সাইকেল হারিয়ে তিনি রীতিমতো হতবাক ও বিমর্ষ। সাধের বাইসাইকেল হারিয়ে ব্যথিত জেনি পার্শ্ববর্তী পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ জানালেন। কিন্তু থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা খুব একটা আশার বাণী শোনাতে পারেননি জেনিকে।

জেনির প্রিয় সেই নীল রঙের সাইকেল; Source: bbc.com

সাইকেল হারিয়ে বিমর্ষ জেনির ফেসবুক পোস্ট

সাইকেল হারিয়ে ব্যথিত হৃদয়ে বাসায় ফিরে আসেন জেনি। নীল রঙের প্রিয়  সাইকেলটি হারানোর ব্যথা তিনি কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিলেন না। সংবাদমাধ্যমের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অত্যন্ত মন খারাপ নিয়ে জেনি তার ফেসবুক ওয়ালে তার সাইকেল চুরির খবরটা সকলকে জানালেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি তার ফেসবুক পেজে নিজের সাইকেলের একটা ছবিও পোস্ট করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সাইকেল হারানোর খবরের সাথে সাথে তার সাইকেল খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সকলের কাছে সাহায্য চাওয়ার পরই ঘটতে থাকে অভাবনীয় এক ঘটনা।

ফেসবুকে চোরের সাইকেল বিক্রির বিজ্ঞাপন

জেনি তার এই সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি বিস্টল সাইক্লিং ফেসবুক গ্রুপেও শেয়ার করেন। সৌভাগ্যক্রমে জেনির পোস্টটি চোখে পড়ে আরেক সাইক্লিস্টের। নাম তার ক্রিস। সে জেনির সাইকেল হারানো ঘটনায় সহমর্মিতা প্রকাশ করে।

কিছুক্ষণ পরই ক্রিস আচমকাই এক ফেসবুক পেজে আবিষ্কার করেন জেনির সেই সাইকেলটি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, যেটির মূল্য ১০০ ইউরো। ফেসবুকে পেজে পোস্টটি দেখার সাথে সাথে তিনি বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগে করেন। বিক্রেতা নিজেকে ‘বিবপ’ হিসেব পরিচয় দেন। জেনির সাথে কথা বলে ক্রিস বিক্রেতার সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ রাখা শুরু করেন। তিনি বিক্রেতাকে জানান, তার বোনের সাইকেলটি পছন্দ হয়েছে এবং এটি সে কিনতে চায়।

জেনির পোস্টের কিছুক্ষণ পরেই চোরের চুরি হওয়া সাইকেলের বিক্রির বিজ্ঞাপন; Source: BristolPost

বিক্রেতার সাথে কথা বলে পরের দিন দেখা করার ব্যবস্থা করেন ক্রিস। বিষয়টি তিনি সঙ্গে সঙ্গে জেনিকে জানিয়ে দেন। দুজন মিলে আলোচনা করতে থাকেন, কীভাবে চোরের হাত থেকে জেনির হারানো সাইকেলটি উদ্ধার করা যায়। প্রথমে ঠিক করা হয় পুলিশের সাহায্য নেয়া হবে। পুলিশ যদি ইতিবাচক সাড়া না দেয়, তাহলে তারাই ওই চোরের বাড়ি হানা দিয়ে উদ্ধার করে আনবে সাইকেলটি।

সাইকেল কেনার জন্য বিক্রেতার সাথে সাক্ষাতের আয়োজন ; Source: BristolPost

পুলিশের চূড়ান্ত অসহযোগিতা

জেনি ও তার ফেসবুক বন্ধু ক্রিসকে নিয়ে পুলিশকে বিষয়টি জানান। কিন্তু পুলিশ বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। চোরকে গ্রেফতার করে সাইকেলটি উদ্ধার করা তো দূরে থাক, চোরের বাড়িতে পুলিশ বাহিনী পাঠাতেও রাজি হয়নি ঐ পুলিশ ফাঁড়ির প্রধান। পুলিশের এই চূড়ান্ত অসহযোগিতায় একদম ভেঙে পড়েন জেনি। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি নাছাড়বান্দা। তাকে যে করেই হোক উদ্ধার করতে হবে তার চুরি হওয়া বাইসাইকেলটি। তখন সে পুলিশ অফিসারকে জানায়, তিনি নিজেই চোরের সাথে বোঝাপড়া করে নেবেন। কারণ তা না হলে যেকোনো সময় সাইকেলটি বিক্রি হয়ে যেতে পারে। পুলিশ অফিসারটি জেনির পরিকল্পনার কথা শুনে জেনিকে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বলেন। কারণ এতে জেনির বিপদ ঘটতে পারে। পুলিশ অফিসারটি জেনিকে বলেন, আইনকে আইনের মতো চলতে দেয়া উচিত। কারো আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া উচিত নয়। জেনির হাজার চেষ্টায় পুলিশ অফিসারকে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন যে, হারানো সাইকেলটি ঐ লোকের কাছেই আছে।

পরবর্তীতে এ বিষয়ে সমারসেট পুলিশ সংবাদমাধ্যমে এক ভাষ্য প্রদান করে। তাতে তারা উল্লেখ করেন,

“আমরা অপরাধ প্রতিরোধ ও শনাক্তকরণে জনসাধারণের সার্বিক সহযোগিতার উপর ভরসা করি এবং জনগণের দেয়া যেকোনো তথ্যের জন্য সবসময় কৃতজ্ঞ। কিন্তু জনগণের এমন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়া উচিত নয়, যেখানে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া এ ধরনের কর্মকান্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তি সুযোগ বুঝে তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস করে দিতে পারে। বাইসাইকেল চুরির বিষয়ে আমরা পুরোদমে তদন্ত চালাচ্ছি এবং অপরাধীকে ধরার জন্য ভিক্টিমের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। নতুন তথ্যের বদলে পূর্বে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে তদন্তকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।”

সাইকেল উদ্ধারে জেনির মিশন

অগত্যা জেনি ও তার বন্ধু ক্রিসকে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হয়। চোরের সঙ্গে দেখা করতে যান জেনি ও ক্রিস। বিক্রেতার সাথে সাক্ষাতের সময়ের ঘন্টা দুই আগে বিক্রেতার বাড়ির একটু দূরে এক কফি শপে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন এই দুজন। কফি শপে বসেই বিক্রেতা চোরের বাড়ির চারপাশ দেখতে গিয়ে একটা নীল সাইকেলে দুজনেরই চোখ আটকে যায়। জেনি নিশ্চিত হয় এটি তারই চুরি হওয়া সাইকেল। জেনি একটু চিন্তিতই হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে, যদি আর কেউ এসে সাইকেলটা কিনে নিয়ে যায়!

তাই পরবর্তী পরিকল্পনা অনুযায়ী, জেনি সরাসরি সাইকেল বিক্রেতার সাথে কথা বলার জন্য তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। ক্রিস একটু দূর থেকে সম্পূর্ণ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন, চোর যাতে বুঝতে না পারে জেনির সাথে আর কেউ আছে। আর জেনির কোনো বিপদ হতে দেখলেই ক্রিস যেন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। জেনি চোরের বাড়িতে গিয়ে কী করলেন, কীভাবেই বা উদ্ধার হলো তার চুরি যাওয়া সাইকেল, আসুন তা জেনে নেয়া যাক স্বয়ং জেনির মুখ থেকেই।

‘‘আমি বিক্রেতার কাছে গিয়ে সাইকেলটি কেনার জন্য আগ্রহ দেখালাম। সাইকেলটি সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে চাইলাম। এমন ভাব দেখাচ্ছিলাম যে, আমি খুবই উৎসাহী সাইকেলটির ব্যাপারে। নানা রকম বোকা বোকা প্রশ্ন করছিলাম। বলছিলাম সাইকেলের সিটটা বেশ উঁচু। আমি একবার চালিয়ে দেখতে চাই।”

প্রথমে চোর বিক্রেতা খুব একটা রাজি ছিল না। তবে জেনির উপর চোরের তেমন কোনো সন্দেহই হয়নি হয়তো। আর তা হয়নি বলেই জেনি তার ওয়ালেট বা ব্যাংক কার্ড কিংবা মোবাইল ফোন জাতীয় কিছু চোরের কাছে না রেখে শুধুমাত্র হাতে থাকা সিগারেটের প্যাকেট আর ঐ সাইকেলের একটি চাবির গোছা চোরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি এগুলো ধরুন। আমি সাইকেলটা একবার চালিয়ে দেখি।” এরপরই সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে চোরের চোখের সামনে কয়েক পাক ঘরে দ্রুতই প্যাডল করে ঐ জায়গা থেকে নিমেষে উধাও হয়ে যান জেনি।

পরে এক সাংবাদিককে তিনি জানান,

“আমার চিন্তা ছিল যত দ্রুত সম্ভব আমাকে ঐ জায়গা ত্যাগ করতে হবে। কেউ আমাকে তাড়া করছে কিনা তা দেখারও সময় ছিল না। আমি এতো জোরে চালাচ্ছিলাম যে বুঝতে পারছিলাম না আমি কোথায়। বাসায় এসে না পৌঁছা পর্যন্ত একটুর জন্যও কোথাও থামিনি।”

চোরকে বোকা বানিয়ে সাইকেলটি প্রকৃত মালিকের হাতে; Source: BristolPost

অত:পর সাইকেল রহস্যের সমাধান

যেভাবে জেনিকে হতভম্ব করে দিয়ে সাইকেলটা চুরি করেছিল চোর, ঠিক সেভাবে বা তার চেয়েও আরো বেশি চতুরতার সাথে চোরকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করে দিয়ে সাইকেল নিয়ে পালালেন জেনি। সাইকেল চালাতে চালাতে আবিষ্কার করেন, সাইকেলে যে ছোটখাটো সমস্যাগুলি ছিল, চোর তা আগেই সারিয়ে রেখেছে!

ক্রিসের কাছে জেনির বিরুদ্ধে চোর বিক্রেতার অভিযোগ; Source: BristolPost

এরপরের ঘটনাটা বেশ মজার। জেনি আসছে না দেখে চোর রাগান্বিত হয়ে মেসেজ পাঠায় যে, জেনি পরীক্ষা করার জন্য সাইকেল চালাতে নিয়ে গেছে। ১৫ মিনিটের বেশি হয়ে গেল এখনো ফিরে আসেনি। সে সাইকেল বিক্রির অর্থ দাবি করে। ক্রিস তখন সহাস্যে জবাব দেন এই বলে, “জেনি বোধহয় সাইকেলটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।” ক্রিস আরো যোগ করেন, “অন্যের জিনিস নিজের বলে চালিয়ে দেয়া কিছুতেই উচিত নয়। কারণ বাইসাইকেলটি জেনিরই যেটি গতকাল চুরি হয়েছিল। তুমি সেই সাইকেলটি চুরি করে নিজের বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে তোমাকে একটা শিক্ষা দেয়া হলো।

সাইকেল ফিরে পেয়ে বিস্টল শহর ভ্রমণে জেনি; Source: static.independent.co.uk

অন্যদিকে হারানো সাইকেল  ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বসিত জেনি ফেসবুকে পোস্ট দিলেন, “অবেশেষে আমি আমার প্রিয় সাইকেলটি ফিরে পেলাম। আর এই সাইকেল নিয়ে আমি বিস্টল শহর ভ্রমণে বের হবো।

এভাবেই সমাপ্তি ঘটলো একটি রোমাঞ্চকর সাইকেল চুরি রহস্যের।

ফিচার ইমেজঃ BristolPost

Related Articles