Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শনি শিঙ্গাপুর: যে গ্রামে ঘরের দরজায় নেই কপাট, ব্যাংকে নেই তালা

যে সময়টিতে আমরা আমাদের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য বাসা-বাড়িতে তিন স্তরের দরজা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি না, সেই সময়টিতেই আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে রয়েছে এমন একটি গ্রাম, যেখানে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা সবার ঘরের দরজা খোলা থাকে। ‘খোলা থাকে’ বললেও কিঞ্চিত ভুল হবে, কেননা সেই গ্রামের ঘর-বাড়ির দরজাতে কপাটই নেই; মানে চাইলেও দরজা বন্ধ করার সুযোগ নেই। এই গ্রামটির নাম ‘শনি শিঙ্গাপুর’

শনি শিঙ্গাপুর গ্রামের অবস্থান ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশে। জেলার নাম নাভাসা। মহারাষ্ট্রের সুপরিচিত শহর আহমেদ নগর থেকে গ্রামটির দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। শনি শিঙ্গাপুর গ্রামটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এখানে হিন্দু ধর্মের অন্যতম দেবতা শনির একটি মন্দির রয়েছে। শনি দেবতার নাম অনুসারেই এই গ্রামটির নাম ‘শনি শিঙ্গাপুর’।

শহরটির আয়তন প্রায় ৮২ বর্গ কিলোমিটার। ভাষা মারাঠি। জনসংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। শহরজুড়ে গ্রামবাসীর বসবাসের জন্য ২ শতাধিক ঘর-বাড়ি রয়েছে। 

শনি শিঙ্গাপুর গ্রামের প্রবেশ পথ; Image Source: wikimedia.org

কথিত আছে, প্রায় ৩০০ বছর আগে গ্রামটিতে একবার প্রচন্ড বৃষ্টি ও বন্যা হয়। বন্যা শেষ হলে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানাশালা নদীর তীরে বিশালাকৃতির কালো রঙের একটি পাথর পাওয়া যায়। হঠাৎ করে এত বিশাল পাথর দেখে গ্রামের মানুষের মধ্যে কৌতূহল জাগে। অনেকে এটা নদী থেকে স্বাভাবিকভাবে ভেসে ওঠা পাথর ভাবতে লাগলো; আবার অনেকে ভাবতে লাগলো এটি কোনো দৈবশক্তির প্রভাবে এখানে এসেছে। এসব যখন বলাবলি হচ্ছিলো, তখন এক রাখাল তার হাতের লাঠি দিয়ে পাথরটিকে স্পর্শ করে বসলো। সাথে সাথে সারা পাথর থেকে অঝোর ধারায় রক্ত বইতে শুরু করলো। গ্রামের সকল মানুষ দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করতে শুরু করলো। একপর্যায়ে রাত হয়ে গেলো। সবাই কোনো এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে যুগপৎভাবে ঘুমিয়ে পড়লো। সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন একই সময় গ্রামের সবার সাথে স্বপ্নে যোগ দিলেন শনি দেবতা। সবাইকে তিনি জানালেন, 

এটি কোনো সাধারণ মূর্তি নয়, এটি আমার প্রতিমূর্তি। যদি তোমরা আমার উপাসনা করো তাহলে আমি তোমাদের সবার মুক্তি ও নিরাপত্তা দান করবো। অন্যথায় এই রক্তের ধারা বন্ধ হবে না।

সেই পাথরটিকে শনি দেবতার প্রতিমূর্তি হিসেবে গণ্য করে পূজা দিচ্ছেন দুই ভক্ত; Image Source: New Indian Express

এ সময়ে শনি দেবতা তার উপাসনার পদ্ধতি হিসেবে দুটি শর্ত জুড়ে দেন। প্রথমত, এই গ্রামের কোনো এক জায়গায় আমার এ পবিত্র প্রতিমূর্তিটিকে সংরক্ষণ রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, গ্রামের কেউ তাদের ঘরের দরজার কপাট বন্ধ করতে পারবে না। যদি কেউ ঘরের দরজার কপাট বন্ধ করে তাহলে তিনি তাদের নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব নিবেন না। কেননা সবার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য দেবতাকে যখন তখন সবার ঘরে প্রবেশের সুযোগ থাকতে হবে। তাছাড়া দরজার কপাট বন্ধ থাকলে দেবতার সুনজর থেকেও গৃহবাসী বঞ্চিত হবে।

সকালবেলা একে একে সবাই বুঝতে পারলো, গ্রামের সবাইকে এই একই স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ সবার স্বপ্নে শনি দেবতা হাজির হয়েছিলো। ধীরে ধীরে গ্রামের সবাই সেই পাথরের নিকট হাজির হলো। দেখা গেলো, পাথর থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়া আপাতত বন্ধ হয়েছে।

পাথরটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ভারতের সর্ববৃহৎ শনি মন্দির; Image Source: BBC

গ্রামের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাবশালী নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন এই পবিত্র পাথরকে তারা সসম্মানে সংরক্ষণ করবেন। সিদ্ধান্ত অনুসারে পাথরটিকে মাটিতে খাড়াভাবে স্থাপন করে সেখানে একটি মন্দির গড়ে তোলা হয়, যার নাম শনি মন্দির বা শনি দেবতার মন্দির। ধীরে ধীরে সেই মন্দির জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলো। বর্তমানে এটি ভারতের, এমনকি সারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শনি দেবতার মন্দির হিসেবে বিবেচিত। ভারতের বিভিন্ন স্থানে শনি দেবতার আরও অনেক মন্দির রয়েছে।

যেখানে মানুষ বসবাসের জন্য নির্মিত ঘর-বাড়িতে কপাট নেই, সেখানে স্বয়ং দেবতার প্রতিমূর্তি রাখার স্থান কেমন হতে পারে? হ্যাঁ, শনি মন্দিরের উপরে কোনো ছাদ নেই। খোলা আকাশের নিচেই বেদি নির্মাণ করে শনি দেবতার পবিত্র পাথরটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

মন্দিরের ভবন থাকলেও শনি দেবতার আদেশে পাথরটিকে রাখা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে; Image Source: shanidev.com

সেই থেকে গ্রামের কেউ আর তাদের ঘরের দরজায় কপাট নির্মাণ করেন না। যাদের আগে থেকেই ছিল তারা সবাই তাদের ঘর থেকে কপাট সরিয়ে ফেলে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সেই ধারা অব্যহত আছে। তবে ঘরে কুকুর ঢুকতে পারে এমন আশঙ্কায় পরবর্তীতে কেউ কেউ দরজার নিচের অংশকে কাঠর ফ্রেম দিয়ে ঘিরে রাখেন। কিন্তু উপরের দিক দেবতার আদেশে সব সময়ে খোলাই থাকে। তবে দু’একটি ঘরে আড়াল করার জন্য পর্দা ঝোলানো হয়ে থাকে।

শনি শিঙ্গাপুর গ্রামের একটি গৃহের ঘর, যেখানে দরজা থাকলেও নেই কোনো কপাট; Image Source: BBC

শুধুমাত্র ঘর-বাড়ি নয়, অফিস, দোকান, স্কুলসহ শনি শিঙ্গাপুর গ্রামের সব কিছুরই দরজার কপাট ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। এমনকি গ্রামের মানুষরা তাদের টাকা-পয়সা উন্মুক্ত রেখে চলে যায় নির্ভারভাবে। তাদের বিশ্বাস, এসব সম্পদ দেখভাল করার দায়িত্ব স্বয়ং শনি দেবতার। গ্রামটির পাবলিক টয়লেটের দরজাতেও কপাট নেই। তবে টয়লেটের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য চারকোনা আকৃতির একটি বিশেষ পাতলা কাঠের ব্যবহার করে থাকেন গ্রামবাসী। গ্রামের আধুনিক ভবনগুলো নির্মাণের সময়েও দরজার কপাটবিহীন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

 শনি শিঙ্গাপুর গ্রামের একটি পাবলিক টয়লেট। টয়লেটের দরজাতে নেই কোনো কপাট, তবে গোপনীয়তা রক্ষায় চারকোন আকৃতির কাঠের ব্যবহার করে গ্রামবাসী, যার দুটি খণ্ড সামনে রাখা রয়েছে; Image Source: reacho.in

শনি দেবতার মন্দির প্রদর্শন ও পূজা দিতে প্রতিদিন গড়ে ৪০,০০০ মানুষ শনি শিঙ্গাপুর গ্রামে আগমন করেন। উন্মুক্ত মন্দিরে তারা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার সম্পদ দান করেন। এত মানুষের আনাগোনা এবং এভাবে উন্মুক্ত টাকা-পয়সা ও সম্পদ পড়ে থাকলেও গ্রামটিতে কখনো চুরির ঘটনা ঘটে না। গ্রামবাসীর বিশ্বাস, শনি দেবতার অধীনস্থ গ্রাম বিধায় এখানে কোনো চুরি করা সম্ভব নয়। বলে রাখা ভালো, শনি দেবতার আশীর্বাদ প্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে শনি শিঙ্গাপুর গ্রাম থেকে দারিদ্র‍্যও দূর হয়ে যায়। গ্রামের সকল অধিবাসীর পর্যাপ্ত পরিমাণে ধন-সম্পদ রয়েছে। 

তবে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো একজন দর্শনার্থী অভিযোগ করেন যে, তার গাড়ি থেকে প্রায় ৩৫,০০০ রুপি চুরি হয়ে গেছে। এরপর ২০১১ সালে আরেক দর্শনার্থী অভিযোগ করেন, তার সাথে থাকা প্রায় ৭০,০০০ রুপি সমমূল্যের স্বর্ণ চুরি হয়ে গেছে। উভয় অভিযোগের পরই স্থানীয় নেতারা বিচার বসান। বিচারে অভিযোগকারীরা কোনো শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়। গ্রামবাসীর বিশ্বাস, শনি দেবতার শক্তিকে খাটো করে দেখানোর জন্যই এসব লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উত্থাপন করেছিল।

কপাটবিহীন আরেকটি ঘর; Image Source: BBC

শনি শিঙ্গাপুর গ্রামে কোনো পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োজনও পড়ে না। তবুও ক্রমবর্ধমান সরকারি অফিস ও দর্শনার্থীদের দেখভাল করার স্বার্থে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে একটি পুলিশ স্টেশন স্থাপন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ স্টেশনে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে কোনো বিচার বা অভিযোগ আসেনি

শনি শিঙ্গাপুর গ্রামের একমাত্র পুলিশ স্টেশন; Image Source: huffingtonpost.in

গ্রামে রয়েছে একটি সরকারি ব্যাংকের শাখা। ব্যাংকটিতে দরজা থাকলেও নেই কোনো তালা। ২০১১ সালে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ‘ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক’ এর শাখা খোলা হয় গ্রামটিতে। ব্যাংক খোলার পরিকল্পনার সময় গ্রামবাসীর সাথে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের আলাপ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ব্যাংকের দরজায় কপাট থাকলেও তা হবে স্বচ্ছ গ্লাসের, যাতে বাইরে থেকে দেবতা ভেতরের সবকিছু অবলোকন করতে পারেন। পাশাপাশি কপাটে কখনো কোনো তালা লাগানো হবে না। এই শর্তে ব্যাংক খোলা হলেও ব্যাংকটিতে এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দিনরাত ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে ব্যাংকের দরজা।

‘ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক’ এর শনি শিঙ্গাপুর শাখা, ব্যাংকটির দরজায় কপাট থাকলেও তাতে নেই কোনো তালা; Image Source: BBC

শনি শিঙ্গাপুর গ্রামের এসব ঘটনা শুনলে মনে হতে পারে, তারা তাদের দরজা খোলা রাখলেও নিশ্চয়ই সবসময়ে তারা সম্পদ সজাগ দৃষ্টিতে পাহারা দেন; বাস্তবে তা-ও নয়। যখন গ্রামের কোনো পরিবার গ্রামের বাইরে কোথাও গমন করেন বা বেড়াতে যান, তখন তাদের সম্পদ পুরোপুরি উন্মুক্তই পড়ে থাকে। এমনকি তারা তাদের পাশের বাড়িতে ‘আমাদের ঘরটি দেখে রাখবেন’ ধরনের কোনো অনুরোধও করে যান না।

গ্রামবাসীর বিশ্বাস, কেউ যদি চুরি করতে আসে তবে সে শনি দেবতার অভিশাপে অন্ধ বা মারাত্মক ধরনের কোনো ক্ষতির মুখোমুখি হবেন। কথিত আছে, একবার এক লোক নিজের পরিবার ও সম্পদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির অজুহাত তুলে তার ঘরের দরজায় কাঠের কপাট লাগিয়েছিলেন। পরের দিন সকালেই এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় লোকটির মৃত্যু হয়।

বর্তমানে প্রতিদিন এভাবে হাজার হাজার মানুষ শনি মন্দিরে আগমন করেন। সূত্রমতে দৈনিক গড়ে প্রায় ৪০,০০ মানুষ এখানে আগমন করেন; Image Source : Hiranya Resorts

ফিচার ইমেজ: reacho.in

Related Articles