Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে যা শিখতে পারেন ট্রাম্প

আমরা একটা বড় দেয়াল গড়ে তুলবো দেশের দক্ষিণ দিকের সীমান্তে। আর এই দেয়াল গড়ে তোলার জন্য যে টাকা লাগে, তা আমি আদায় করে ছাড়বো মেক্সিকোর কাছ থেকে।

অভিবাসনবিরোধী নিষেধাজ্ঞা, অভিবাসনবিরোধী দেয়াল – মোট কথা অভিবাসনই ছিলো আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার মূল বিষয়বস্তু। সেই প্রচারণায় নিরাপত্তার ইস্যু এসেছে, বিদেশ নীতির ইস্যু এসেছে, সন্ত্রাসবাদ ইস্যু এসেছে, পরিবেশের ইস্যু এসেছে, কিন্তু শেষমেশ প্রায় প্রতিটা বিষয়ই এসে ঠেকেছে অভিবাসনে, বাকি বিশ্ব থেকে আমেরিকাকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে কল-কারখানা গড়ে তোলে স্বর্ণ যুগের আমেরিকা গড়ে তোলার এক ইউটোপিয়ান স্বপ্ন দেখিয়ে আমেরিকানদের মন জয় করে নিয়েছেন এই ধনকুবের।

সাধারণ আমেরিকানরাও (বিশেষ করে যারা শ্বেতাঙ্গ ও স্বল্প শিক্ষিত) এতোটাই মজেছিলেন যে, রাজনীতিতে ট্রাম্পের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে কি না, দেয়াল তুলে দিয়ে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদৌ সন্ত্রাসবাদ ঠেকিয়ে রাখা যাবে কি না এসব মৌলিক প্রশ্ন মাথাতেও আনেননি। সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কটের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসনের যে অদৃষ্টপূর্ব স্রোত শুরু হয়, তার পরে ইউরোপের অনেক দেশই সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তুলে দিয়েছে। কিন্তু আটলান্টিকের ওপারে ৩২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৩০ ফিট উঁচু যে সীমান্ত দেয়াল তুলে দেয়ার কথা বলছেন ট্রাম্প, ততখানি বিভাজনপন্থী কেউ হয়ে উঠতে পারেনি এখন পর্যন্ত। কোনো কোনো সমালোচক তো আবার রসিকতা করতেও ছাড়েননি- আর কিছু পারুক আর না-ই পারুক, ট্রাম্পের আমেরিকা অন্তত দেয়াল তোলার ক্ষেত্রে চীনকে টেক্কা দিতে পারবে (যদিও বিষয়টা সত্য নয়, কারণ চীনের গ্রেট ওয়ালের দৈর্ঘ্য সব মিলিয়ে ২১ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি)।

সীমান্তের উঁচু দেয়াল অবৈধ অভিবাসী, মাদক, ধর্ষণ ইত্যাদি সব সমস্যা সমাধান করে ফেলবে বলে ট্রাম্প দাবি করলেও দ্য ডিপ্লোম্যাট পত্রিকায় ভারতের ব্যাঙ্গালোরভিত্তিক গবেষক ডঃ সুধা রামচন্দ্রন বলছেন একেবারেই উল্টো কথা। আর এজন্য তিনি উদাহরণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত ভারত-বাংলাদেশ সীমারেখাকে। ভারত এবং বাংলাদেশের মাঝে ৪ হাজার ৯৭ কিলোমিটার লম্বা কাঁটাতারের বেড়া। দুই দেশেই সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে পৃথক হওয়া এই দুই দেশেই সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় এমন অসংখ্য পরিবার আছে, যাদের স্বজনদের বাস সীমান্তরেখার ও’পাড়ে। রক্তের টানেই অনেক সময় ঝুঁকি নিয়ে পেরোতে হয় কাঁটাতারের বেড়া।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, Interburnsk2d

মূল লেখায় প্রবেশের জন্য এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। গত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে ভারতের আসাম অঙ্গরাজ্যের দিকে নজর দিলে, সে সময়কার আসামবাসী এবং বর্তমান আমেরিকানদের মধ্যে ভীষণ মিল চোখে পড়বে। আশির দশকে বাংলাদেশী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। আজকের আমেরিকানদের মতোই তখনকার আসামবাসী দাবি তুলেছিলো, তাদের চাকরি, প্রভাব ইত্যাদি ক্ষুণ্ন হচ্ছে সীমান্ত পেরিয়ে আসা বাংলাদেশীদের কারণে। এখানে বলে রাখা ভালো, ভারতের কেন্দ্রীয় দিল্লি সরকারের অভাবনীয় বৈষম্য এবং অবহেলার শিকার হওয়া একটি রাজ্য আসাম। সত্তরের দশকে রাজ্যটিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহও শুরু হয়। যা-ই হোক, উত্তাল অগ্নিকুণ্ড হয়ে থাকা আসামের অধিবাসীদের ঠাণ্ডা করতে ভারতের সরকার তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশের অভিবাসী থামানোর ব্যবস্থা নিলেন। টানা হলো কাঁটাতারের বেড়া, বসানো হলো সতর্ক প্রহরা।

ভারত বাংলাদেশ সীমানা, Intoday

৮ ফুট লম্বা, বিদ্যুতায়িত এই কাঁটাতারের বেড়া বসানোর পরিণতি কি? গত কয়েক বছরে পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, এই বেড়া কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা থামাতে পারেনি। এখনো হরহামেশাই সীমান্তের ওপারে থাকা স্বজনের বাড়ি যাওয়ার জন্য বেড়া টপকাচ্ছেন বাংলাদেশী এবং ভারতীয়রা। এমনকি, প্রেমের টানে সীমানা পেরিয়ে আরেক দেশে চলে আসার খবরও চোখে পড়ে। আত্মীয়তার প্রসঙ্গ যদি বাদও দেয়া হয়, কাঁটাতারের এই বেড়া মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, চোরাচালান ইত্যাদিতেও বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। অনেক সময়ে এসব চলে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের জ্ঞাতসারেই।

মানচিত্রে দক্ষিণ এশিয়া, Source: Kimberrywg

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই এর অধ্যাপক রিস জোনস বলেন, “অভিবাসন ঠেকাতে সীমান্ত দেয়ালগুলো যে কাজে দিচ্ছে, এমন নজির খুব কম। সীমান্তে রেখার বিভিন্ন পয়েন্টে জাল কাগজপত্র এবং ঘুষের বিনিময়ে মানুষ হরহামেশাই আসা-যাওয়া করে। অর্থাৎ অভিবাসনের প্যাটার্ন বা ধরণটা পরিবর্তন করতে পারলেও, তা বন্ধ করতে প্রায় অক্ষম সীমান্ত বেড়া।” এছাড়া সন্ত্রাসবাদ বন্ধেও কাঁটাতারের বেড়া যে খুব কার্যকর, এমন নয়। কারণ একটি সুসংগঠিত চক্রের সদস্যের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা থাকে, যা দিয়ে সে অনায়াসে জাল কাগজপত্র বানিয়ে নিতে পারে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসী হামলাগুলো যদি খেয়াল করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, অন্য দেশ থেকে এসে হামলা চালিয়ে গেছে, এমন নজির বেশ কম। বাংলাদেশের হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলাকারীদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশী। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০১৬ সালে একটি বারে চালানো হামলাকারীও আমেরিকান নাগরিকই ছিলেন। প্যারিস, ব্রাসেলস সব জায়গাতেই একই চিত্র।

ফেলানীর কবরের পাশে শোকার্ত বাবা-মা, BDNews24

মূল উদ্দেশ্য হাসিল না হলেও এই কাঁটাতারের বেড়ার বলি হতে হয়েছে হাজারেরও বেশি মানুষকে। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে চালু আছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর বিতর্কিত ‘শ্যুট-অন-সাইট’ নীতি, যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করতে পারে। ২০১১ সালে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০ সালের পর থেকে ২০১১ পর্যন্ত বিএসএফের বিরুদ্ধে প্রায় ১,৫০০ সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৪৬ জন বাংলাদেশী খুন হয়েছে বলে জানা যায়। শুধু হত্যাই নয়, সম্প্রতি ফাঁস হয়ে যাওয়া বেশ কিছু ভিডিওতে বাংলাদেশীদের ওপর ভারতের সীমান্ত রক্ষীদের নির্যাতনের বিষয়টিও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে ফেলানি নামে ১৫ বছরের কিশোরী নিহত হন বিএসএফের হাতে, যা গোটা বিশ্বে নিন্দার ঝড় তোলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের এই আইনজীবি বলেন, নিহত এই মানুষদের বেশিরভাগই আসলে সীমান্তের খুব কাছে তাদের যেই আবাদি জমি, তাতে কৃষিকাজ করার সময় গুলিবিদ্ধ হন। নিহতদের একটা বড় অংশ আবার কোনো আর্থিক নয়, বরং আত্মীয়ের বাড়ি বেড়িয়ে এসে ফেরার পথে খুন হন।

এতো এতো ব্যর্থতা এবং অমানবিকতার ইতিহাস নিয়ে কিভাবে টিকে আছে সীমান্তের বেড়াগুলো?

কারণ একটাই, উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলেও রাজনীতির অব্যর্থ হাতিয়ার এগুলো। কাঁটাতারগুলো উগ্র জাতীয়তাবাদ উস্কে দেয়, যে জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করে জনগণের সমর্থন আদায় করে রাজনৈতিক দলগুলো। নেতারা বলে, কাঁটাতার দিয়ে আমরা তোমাদের সুরক্ষিত রেখেছি। সীমান্তে হত্যা হয়, কাঁটাতার ঘেরা মানুষেরা ভাবে, দেখো সরকার বাহাদুর না থাকলে কি সর্বনাশটাই না হতো!

ডোনান্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত ক্যাপ, Quora

আমেরিকার কথায় ফেরা যাক। গত শতাব্দীর শেষভাগ, বিশেষত নব্বই দশক থেকে সস্তা শ্রমের লোভে আমেরিকার বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা সরিয়ে নিয়ে গেছে চীন, মেক্সিকো, বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে। এতে আমেরিকার মাটিতে ‘ব্লু কলার জব’ বা স্বল্পশিক্ষিতদের জন্য নির্ধারিত চাকরিগুলো হয়ে পড়েছে অপ্রতুল। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের সস্তা শ্রমে পকেট ভারি হয়েছে মুষ্টিমেয় শিল্পপতির। আমেরিকার সরকার পারতো, ১% জনগোষ্ঠীর ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে সামাজিক কল্যাণমূলক খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়াতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাত শক্ত করতে। কিন্তু তা হয়নি। শোনা যায়, বারাক ওবামা একবার এক ডিনারে অ্যাপলের সিইওকে অনুরোধ করেছিলেন, অ্যাপলের কারখানাগুলো দেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনা যায় কি না। উত্তর ছিলো নেতিবাচক।

ইভাঙ্কা ট্রাম্পের নিজ নামের ফ্যাশন ব্র্যান্ড, Mirror

এখন এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলছেন, মেক্সিকানরা এদেশে আসছে, তোমাদের চাকরি নিয়ে যাচ্ছে, মুসলিমরা তোমাদের চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ভোট দাও, আমিই তোমাদের রক্ষা করবো। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানের ক্যাপগুলো, তার মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প ফ্যাশন ব্র্যান্ডের পোশাকগুলো সবই চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনামে তৈরি

এই ট্রাম্পই এবার দেয়াল তোলার রব তুলেছেন। সেই দেয়াল কি মেক্সিকানদের আটকে রাখবে, নাকি স্বল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের চোখে ঠুলি হিসেবে কাজ করবে, সেটা বলা কেবল সময়ের ব্যাপার।

Related Articles