Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইউক্রেন-রাশিয়া সঙ্কট (পর্ব | ১)

সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। রাশিয়ার কর্মকাণ্ডে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তারা ইউক্রেনে হামলা করতে চায়। কিন্তু এ উত্তেজনা আসলে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের অধীনে থাকা ক্রিমিয়া দখল করার পর থেকেই চলে আসছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জেমস ভেরিনি গত বছরের (২০২১) আগস্টে ইউক্রেনের ৩০ তম স্বাধীনতা বার্ষিকীর সময় সেখানকার ফ্রন্ট লাইনগুলো ঘুরে আসেন।

সেখানকার অভিজ্ঞতাগুলো, যুদ্ধের দুই পক্ষের বিভিন্ন লোকের সাক্ষাৎকার, আর আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে নিজের প্রত্যক্ষ ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমেসের ম্যাগাজিনে একটা আর্টিকেল লিখেছেন। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য আট পর্বে এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হলো। এখানে জানা যাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সৈনিকদের হারানোর গল্প, সাধারণ মানুষদের বৈষম্য আর নির্যাতনের গল্প, এমনকি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ প্রসঙ্গও চলে আসবে। যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি আসলে কতটা জটিল থাকে, তা বোঝা যাবে পুরো লেখা পড়লে।    

ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার এক ট্যাঙ্ক; Image Source: RUSSIAN DEFENCE MINISTRY

ইউক্রেনের পিসকি গ্রামের অবস্থান যেন ভুল এক জায়গায়। কারণ গোটা গ্রামই একটা ফ্রন্টলাইন। এটা ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ড ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দোনেৎস্ক পিপল রিপাবলিককে (ডিপিআর) আলাদা করেছে। রাশিয়ার সমর্থনে থাকা ডিপিআর ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের সাথে ৮ বছর ধরে যুদ্ধাবস্থায় আছে। তাদের যোদ্ধারা ইউক্রেনীয় সেনাদের ওপর আক্রমণ করে। ইউক্রেনীয়রা তখন পাল্টা আক্রমণ করে। কখনো উল্টোটাও ঘটে।

কোনো ভূখণ্ডই দখল করাও হয়নি, কেউ ছেড়েও দেয়নি। যোদ্ধাদের মধ্যে খুব কম সময়ই চোখাচোখি হয়েছে। রকেটগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে না পারলে পিসকিতে এসে পড়ে। বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে আগেই ছিন্নভিন্ন হয়ে থাকা বাড়িগুলোর কিংবা একসময়ের চার্চের কাঠামোগুলোতে। চার্চের যাজক অনেক বছর আগেই পালিয়েছেন। গ্রামবাসীদেরও তা করতে হয়েছে।

কিছু রকেট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। গত আগস্টের (২০২১) শুরুতে এক সকালে পিসকিতে অবস্থান করা ইউক্রেনীয় আর্মি কোম্পানির দুই সৈনিক ভ্লাদিমির ভেরিয়োভকা ও ইয়ারোস্লাভ সিমিনইয়াকাকে নির্দেশ দেওয়া হয় মালবাহী ট্রাক নিয়ে লেনিন রোড দিয়ে যাওয়ার জন্য। রাস্তাটা পিসকির মধ্য দিয়ে গ্রামের একটা সেতু পর্যন্ত গিয়েছে।

ডিপিআর বাহিনী গ্রীষ্মের প্রতিদিনই বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। রাস্তায় তৈরি হওয়া নতুন নতুন গর্তগুলোর মধ্য দিয়ে ট্রাক চালাতে হচ্ছিল। ভ্লাদিমির ও ইয়ারোস্লাভ যে রাস্তা ধরে এগোচ্ছিলেন, তার পুরোটা গাছে ঢাকা ছিল না। তারা জানতেন যেকোনো সময় শত্রুশিবিরের আক্রমণের মুখে পড়তে পারেন। এটা নিয়ে তাদের করারও খুব বেশি কিছু ছিল না। ট্রাকে রাখা ছিল একটি ক্রেন। ইয়ারোস্লাভের পক্ষেও ট্রাকের গতি খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব ছিল না।

তারা সেদিনই প্রথম একজন আরেকজনের সাথে পরিচিত হন। ৩৪ বছর বয়সে ভ্লাদিমির সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন একজন রেলওয়ে প্রকৌশলী। তিনি যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “এটা করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।” বয়স যতই হোক, ইউক্রেনের তখন প্রয়োজন ছিল যত বেশি সংখ্যক যোদ্ধার। তিনি অফিসার পদেও কমিশন পেয়েছিলেন। তার ইউনিফর্মে থাকার সময় স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েক মাস।

ইউক্রেনের মারিনকা শহরের নিকটবর্তী এক ফ্রন্টের ছবি  ©Paolo Pellegrin

তার তিন বছরের ছোট ইয়ারোস্লাভ ছিলেন ঝানু সৈনিক। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ডিপিআর ও তাদের প্রতিবেশি লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক (এলপিআর) ইউক্রেন থেকে নিজেদের আলাদা ঘোষণা করে। ইয়ারোস্লাভ তখন থেকেই ফ্রন্টে যোগ দেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী এই যুদ্ধ দ্রুতই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনানুষ্ঠানিকভাবে এই অঞ্চলকে বলা হয় দোনবাস। এরপর পশ্চিমের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। ইয়ারোস্লাভের মতো ইউক্রেনীয়রা তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েন তাদের মাত্র দুই দশক বয়সী দেশটি আদৌ টিকে থাকতে পারবে কিনা।

তার বাবা স্নায়ুযুদ্ধের সময় পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত পদাতিক বাহিনীর হয়ে দায়িত্ব পালন করেন, যা খুব একটা আকর্ষণীয় কাজ ছিল না। তিনি ইয়ারোস্লাভকে যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহ দেখান না। ভ্লাদিমিরের বর্তমান সময়ের দেশপ্রেমের মতো একই আবেগ তখন উঠে আসে ইয়ারোস্লাভের মাঝে। তিনি বাবাকে জিজ্ঞেস করেন, “যদি আমি না যাই, তাহলে কে যাবে?

তিনি ছিলেন তখনকার হাজারো তরুণ-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ ইউক্রেনীয়দের একজন, যিনি দেশকে রক্ষা করতে নেমে পড়েন। তখন থেকে তিনি ফ্রন্টেই আছেন। এর মাঝে বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন।

প্রায় ১৩,০০০ ইউক্রেনীয় সেনা ও বেসামরিক জনগণের প্রাণ গিয়েছে এ যুদ্ধে। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধ একটা অচলাবস্থার মধ্যে আছে। কয়েক বছর ধরে ফ্রন্টের অবস্থানের তেমন পরিবর্তন হয়নি। ইউক্রেন কোনো নমনীয়তা দেখাচ্ছিল না। একইসাথে হারানো ভূখণ্ডগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য আগ্রাসী কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। একইসাথে অপরপক্ষও নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। কিন্তু ইয়ারোস্লাভ ও অন্য যারা এই যুদ্ধ নিয়ে খোঁজখবর রাখছিলেন, তাদের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, রাশিয়া ডিপিআর বা এলপিআরের জন্য খুব একটা কাজ করছে না। রাশিয়া এদেরকে পুরোপুরি দখল করে নেয়নি। বরং ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে এই অঞ্চলকে জাতিগত পরিচয়ের দিক থেকে একটা নরক বানিয়ে রেখেছে রাশিয়া। এই অঞ্চলটা হয়ে গেছে আংশিকভাবে রুশ ও ইউক্রেনীয়দের মিশ্রণ।

দোনবাসের জনগণ যখন তাদের পরিণতি জানার অপেক্ষায় ছিল, তখন ২০১৯ সালে নির্বাচিত হওয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি আশ্বাস দেন দোনবাসকে ইউক্রেনের সাথে যুক্ত করবেন। কিন্তু তিনি পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেননি। বর্তমানে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে পড়ছেন দেশটিতে। ইউরোপীয় দেশগুলো, যারা যুদ্ধের ব্যাপারে রাশিয়ার ওপর নিন্দা জানাচ্ছিল, তারা এ ইস্যু নিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে এখন। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকার সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে কথা বলতেন। ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠানো বন্ধ করার চেষ্টাও করেছিলেন। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইউক্রেনীয়রা আশা করছিল, তিনি হয়তো ট্রাম্পের চেয়ে উত্তম পদক্ষেপ নেবেন। গ্রীষ্মের শুরুতে বাইডেন আর পুতিনের সাক্ষাতের সময় জেলেনস্কি যুদ্ধ নিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তাকে সেভাবে গুরুত্ব দেননি।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি বর্তমানে অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছেন; Image Source: Getty Images

যুদ্ধের স্থিতিশীল অবস্থা যখন চলতেই থাকল, ইয়ারোস্লাভের কাছে মনে হচ্ছিল ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীও পরিণত হয়েছে তার মতো সাধারণ এক সৈনিকে। বাড়িতে আসার পর বাবাকে বলেন, তার যুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা মরে গেছে। তিনি একটি বাড়ি কিনে সাজিয়েছেন নতুন করে। দ্রুতই সেখানে উঠবেন আর সবজির বাগান করবেন।

ইয়ারোস্লাভ তার বাগদানের কথা ভ্লাদিমিরকে বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম রকেটটা আঘাত হানে। এটা ট্রাককে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়। পেছনের গাছগুলো এর আঘাতে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। ভ্লাদিমির বুঝতে পারেননি কী হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করার আগেই দেখেন ইয়ারোস্লাভ তার দরজা খুলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভ্লাদিমিরও একই কাজ করলেন।

দ্বিতীয় রকেটটাও ট্রাকে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। তবে এবার কিছু একটা লক্ষ্যভেদ করে। ভ্লাদিমির পেটের ওপর ভর দিয়ে এগোচ্ছিলেন। তিনি রাস্তার পাশে থাকা ঝোপগুলোর কাছে ছিলেন। তিনি কীভাবে এখানে এসেছেন তা নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না তার। ডান হাতার দিকে খেয়াল করে দেখলেন রক্তে ভিজে গেছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ইয়ারোস্লাভ তখনো দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি অবাক হয়ে গেলেন ইয়ারোস্লাভ কেন এমন অবস্থান নিয়েছেন।

তৃতীয় রকেটটা ট্রাককে লক্ষ্যভেদ করে। এবার যখন ভ্লাদিমির চোখ খুললেন, তিনি ট্রাকটি জ্বলন্ত অবস্থায় দেখলেন। তার পাশে থাকা ঝোপগুলোও পুড়ছিল। ইয়ারোস্লাভ পড়ে আছেন তার পেছনে।

কিয়েভের এক সামরিক হাসপাতালে ভ্লাদিমির ভেরিয়োভকা ©Paolo Pellegrin

ভ্লাদিমির বুকে ভর দিয়ে তার কাছে গেলেন। ইয়ারোস্লাভের শার্ট ধরে টান দিলেন। তিনি ইয়ারোস্লাভকে রাস্তা থেকে সরিয়ে আনতে চাইলেন। কিন্তু ইয়ারোস্লাভ অনেক স্বাস্থ্যবান ছিলেন। ভ্লাদিমির কেবল তার বাম হাতটাই ব্যবহার করতে পারছিলেন। ইয়ারোস্লাভের চোখ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।

তিনি ইয়ারোস্লাভকে জ্বলন্ত আগুন থেকে সরিয়ে আনতে পারেন। কিন্তু এর চেয়ে বেশি আর আনতে পারেননি।

আমি লেনিন রোডের অন্য প্রান্তে এক ট্রেঞ্চে ছিলাম একদল সৈনিকের সাথে। আমরা যখন রকেট বিস্ফোরণের শব্দ শুনি, তখন দেখতে পাই গাছের সারির ওপর দিয়ে কালো ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। আমরা দ্রুত সেখানে যাই। সেখানে দেখতে পাই ট্রাকটা তখনো আগুনে পুড়ছে। রাস্তা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।

কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে কমান্ডার আমাকে বলেন, ট্রাকের ওপর গাইডেড অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রকেট দিয়ে আক্রমণ করা হয়। ভ্লাদিমিরকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। আর ইয়ারোস্লাভের মৃতদেহ পাঠানো হচ্ছে মর্গে।    

(পরবর্তী অংশ পর্ব ২-এ)

This is a Bengali article written about Ukraine-Russia crisis and its impact. It is adapted from an article of New York Times Magazine.

Reference: 

1. In the Trenches of Ukraine's Forever War 

Featured Image:  REUTERS/Sergey Pivovarov

Related Articles