(পর্ব ৬-এর পর)
'বেজমেন্ট' শব্দটা আপনি ইউক্রেনে প্রায়ই শুনে থাকবেন। এর দুটি অর্থ হতে পারে। একটা দিয়ে তারা বোঝাতে পারে যুদ্ধের সবচেয়ে বাজে সময়টায় তারা যখন বেসমেন্টে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। আরেকটি হচ্ছে ওলেকসান্দার যেটি বুঝিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে ডিপিআর ও এলপিআরের গোপন কারগার, যেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা, নির্যাতন কিংবা খুন করা হয়।
আমি সেখানকার এক সাবেক বন্দীর সাথে কথা বলি। তার নাম স্ট্যানিস্লাভ আসিভ। তিনি দোনেৎস্ক শহরের বাইরে মাকিয়িভকা অঞ্চলে থাকতেন। মাকিয়িভকা ২০১৪ সালে ডিপিআর বাহিনীর দখলে চলে আসে। এখনো তাদের দখলেই আছে। শহরের অন্যদের মতো তার মাঝেও ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবোধ কমই ছিল। তিনি রুশ ভাষায় কথা বলতেন, রুশ বই পড়তেন, রুশ টেলিভিশন দেখতেন। রুশ সংবাদমাধ্যম যখন বলছিল, ইউরোমাইদান আন্দোলন হচ্ছে আমেরিকার মদদে, তিনি তা বিশ্বাস করেছিলেন। দোনবাসের স্বাধীনতা আন্দোলনকে তারা যখন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বলে প্রচার করছিল, সেটাও তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। তার বন্ধুরা ডিপিআর বাহিনীতে যোগ দেয়। “ফ্যাসিস্টদের হত্যা করা”র ধারণাটা তাদের কাছে খুব রোমাঞ্চকর ছিল।
সেখানের নেতৃত্বে কারা ছিল কিংবা তাদের লক্ষ্য ছিল, তা জানা খুব মুশকিল ছিল। কিন্তু আসিভ তার নিজের চোখের সামনে রুশ এজেন্টদের মাইকিয়িভকাতে ঘুরঘুর করতে দেখেন। তারা কোনোপ্রকার চিহ্নবিহীন ইউনিফর্ম পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তখন তিনি খেয়াল করেন- ডিপিআরের সমালোচকরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তখন বেজমেন্টের গল্প শোনা করেন। সেখানে রাশিয়া বা ডিপিআর নিয়ে সামান্য ফেসবুক পোস্টের জন্যও ধরে নিয়ে যাওয়া হতো।
তিনি জানান, “আমার মতাদর্শ থেকে সরে আসতে আমার বেশ কিছুটা সময় লেগেছে।”
আসিভ তখন ছদ্মনামে এক ইউক্রেনীয় ওয়েবসাইটে আর্টিকেল লেখা শুরু করেন। এগুলোর পাঠক ছিল প্রচুর। রুশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাদের পাঠক গড়ে ওঠে। তিনি একসময় সাহস নিয়ে ছবিও পাঠানো শুরু করেন।
২০১৫ সালের একদিন তিনি দোনেৎস্কের সিটি সেন্টারের কাছে ছবি তুলছিলেন। তখন তাকে এক পুলিশ আটক করে। তখন তাকে গ্রেফতারের জন্য সাদা পুলিশের এজেন্টরা চলে আসে। তাকে একটা গাড়িতে উঠিয়ে পাটের ব্যাগ দিয়ে মাথা ঢেকে দেওয়া হয়। এক এজেন্ট তাকে বলছিল, “তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কত লোককে আমরা মেরেছি তোমাকে ধরেছি মনে করে।”
তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় এক সরকারি ভবনের বেজমেন্টে। কয়েক সপ্তাহ ধরে আসিভকে নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। বিদ্যুতের শকও দেওয়া হয়।
তিনি খেয়াল করেন, তাকে যারা বন্দী করে রেখেছে তারা ইউক্রেনীয়। কিন্তু তাদেরকে এক রুশ ব্যক্তি নির্দেশনা দিচ্ছে। তাকে ডিপিআর আদালতে দুবার গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মামলায় হাজির করা হয়। আদালতে তার বিচার মাত্র কয়েক মিনিট ধরে চলে। প্রতিটি মামলাতেই তাকে ১৫ বছরের করে সাজা দেওয়া হয়। পরবর্তী আড়াই বছর তাকে বিভিন্ন কারাগারে কাটাতে হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কারাগার আইজোলিয়াৎসিয়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক এক প্রতিবেদনে আইজোলিয়াৎসিয়াকে বর্ণনা করা হয়েছে স্ট্যালিন যুগের আদর্শ নিদর্শন হিসেবে। তাদের নির্যাতন করার কক্ষ আর সশ্রম কারাদণ্ডের সেলগুলো ছিল পারমাণবিক বোমার প্রতিরক্ষায় বানানো পুরনো শেল্টারগুলোতে। বন্দীদের সোভিয়েত সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করা হতো। আসিভ জানান, তাদের কমান্ড্যান্ট ছিল “সাইকোপ্যাথের ক্লাসিক উদাহরণ”। প্রায় রাতেই সে মাতাল হয়ে তর্জন-গর্জন করত, আর বন্দীদের পেটাত। অথবা বন্দীদের নির্দেশ দিত একজন আরেকজনকে মারার জন্য, আর সে বসে বসে দেখত। আসিভের ধারণা সে মহিলা বন্দীদের ধর্ষণও করেছে।
সেখানে যে শুধু দখলদারদের সমালোচকরাই ছিল এমন নয়। তার বন্দী সঙ্গীদের অনেকেই ছিল দখলদারদের সমর্থন দিয়ে ডিপিআর বাহিনীতে যোগ দেওয়া ইউক্রেনীয় লোক। কেউ কেউ ছিল স্বেচ্ছাসেবী রুশ নাগরিক। সেখানের শাসকরা এতই প্যারানয়েড হয়ে পড়ছিল যে, নিজেদের ভক্তদেরও গুপ্তচর ভাবা শুরু করছিল।
২০১৯ সালের শেষের দিকে এক বন্দী বিনিময়ের সময় আসিভ মুক্তি পান। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তাকে কিয়েভে ক'টা অ্যাপার্টমেন্ট উপহার দিয়েছেন। সম্প্রতি তার মা-ও সেখানে তার সাথে যোগ দিয়েছেন। তিনি বন্দী থাকা সময়েও তার মাকেও বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
আসিভ আমাকে বলেন,
সমস্যা হচ্ছে ইউক্রেন সরকারের ধারণাই নেই তারা কীসের বিপক্ষে লড়ছে। তাদের মাঝে যুদ্ধের সমাপ্তি টানার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায়। তারা মনে করে দোনেৎস্ক আর লুহানস্ককে তারা মুক্ত করে ফেলবে। এরকম কিছু আসলে হবে না। এই সংঘাত আরো কয়েক দশক স্থায়ী করার সামর্থ্য আছে রাশিয়ার।
ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত দোনবাসে এখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব প্রকট। ২০১৪ সালে যারা ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে সমর্থন দিয়েছিল, তাদের অনেকেই আছে এখনো। এর মাঝে কর্তৃপক্ষের লোকজনও আছেন। তাদের অনেকেই এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলেনস্কি সরকার দোনবাসে স্থানীয় নির্বাচন নিষিদ্ধ করেছে। গণতন্ত্রের পক্ষের লোকজন সরকারের এ পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
ইউক্রেনীয় প্রসিকিউটররা দোনবাসের শত শত ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করেন। মামলার আসামিদের কেউ কেউ রাশিয়ায় পালিয়ে গেছেন। কিন্তু বেশিরভাগই এখনো রয়ে গেছেন সেখানে। কারো কারো পুরো বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অল্প কয়েকজনকেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে কিয়েভের এক জুডিশিয়াল কর্মীর সাথে কথা বলেছিলাম। ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনি মনে করেন এর মূল কারণটা রাজনৈতিক। জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় বিচারকরা হয়তো চিন্তা করছেন পরবর্তী শাসক রুশপন্থী কেউ হবেন। তারা তাদের ক্যারিয়ারকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চাচ্ছেন না। একইসাথে তাদের জীবন নিয়েও চিন্তায় আছেন।
রাশিয়াকে দেওয়ার মতো খুব বেশি কিছু নেই দোনবাসের। এই অঞ্চলের কয়লা বা শিল্পের কোনো প্রয়োজন নেই রাশিয়ার। সম্ভবত ক্রেমলিন দোনবাসের সরকারি খাতের বাজেট কিংবা এখানকার মানুষজনের অবসর ভাতার বোঝা টানতে চায় না। ক্রিমিয়ার মতো এই অঞ্চল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো কৌশলগত গুরুত্বও বহন করে না রাশিয়ার জন্য। এখানে কোনো সমুদ্রসৈকতও নেই। এটা ইউক্রেনকে ভয় প্রদর্শন করার একটা ক্ষেত্র ছাড়া কিছুই না।
রাশিয়া তাহলে কী চায়? জনগণের মতামত থেকে পুতিনের চিন্তাভাবনা এতটাই দূরে সরে গিয়েছে, যে এই প্রশ্নের উত্তর কেবল অনুমান করেই দেওয়া সম্ভব। এটা ক্রেমলিনোলজি সম্পর্কে আপনার জ্ঞান কতটুকু, তার ওপর নির্ভর করে। এটা আবার নির্ভর করে তার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার অনুমান কেমন তার ওপর। দোনবাস নিয়ে তার আগ্রহের কারণ থাকতে পারে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে। পুতিন দোনবাসে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক সংযুক্তির বিষয়ে অস্বীকার করলেও, এখানে প্রায় ছয় লাখ রাশিয়ার ভোট আছে। যদি গত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্বাস করা হয়, তাহলে দোনবাসের জনগণ পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টিকে সমর্থন করে।
(পরবর্তী অংশ শেষ পর্বে)
This is a Bengali article written about Ukraine-Russia crisis and its impact. It is adapted from an article of New York Times Magazine.
Reference:
1. In the Trenches of Ukraine's Forever War
Featured Image: Stanislav Krasilnikov / TASS