জেরুজালেম প্রশ্নে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল পরাজয়!

জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘ। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে বিপুল ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত ছিল ১৭২টি রাষ্ট্র, যার মধ্যে ১২৮টি রাষ্ট্রই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।

সাধারণ পরিষদের ভোটের ফলাফল; Source: AFP

এর আগে গত সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একই রকম একই প্রস্তাবের পক্ষে ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪টি রাষ্ট্রই ভোট দিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে তা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। তবে এবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলোর নাম লিখে রাখার হুমকি দেওয়ার পরেও অধিকাংশ রাষ্ট্রের ভোটে এই প্রস্তাব পাশ হলো।

নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো প্রস্তাবে স্থায়ী সদস্যদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা থাকলেও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে কেউ ভেটো প্রদান করতে পারে না। ফলে কোনো বাধা ছাড়াই এই প্রস্তাব পাশ হয়।যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলোও এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল ছেড়ে যারা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে অথবা ভোটদানে বিরত থেকেছে, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের অধিকাংশই অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র।

চলুন দেখে নিই কী ছিল সাধারণ পরিষদের এই প্রস্তাবে, কারা কারা পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দিয়েছে এবং কী হতে পারে এর তাৎপর্য।

কোন দেশ কিভাবে ভোট দিয়েছে?

কোন রাষ্ট্র কী ভোট দিয়েছে; Source: UN

  • ১২৮টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্য চার স্থায়ী সদস্য রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ছাড়াও এই তালিকায় আছে বিশ্বের প্রায় সবগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং সবগুলো মুসলিম রাষ্ট্র।
  • ৯টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এরা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মাইক্রনেশিয়া, নাউরু, পালাউ এবং টোগো।
  • ৩৫টি রাষ্ট্রে ভোটদানে বিরত ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কানাডা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, ভুটান।
  • এছাড়া বাকি ২১টি রাষ্ট্র অনুপস্থিত ছিল।

প্রস্তাবের বিষয়বস্তু

  • সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবটি অনেকটা গত সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের মতোই ছিল। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবটি প্রস্তুত করেছিল মিসর। তবে সাধারণ পরিষদের খসড়াটি প্রস্তুত করে তুরস্ক এবং ইয়েমেন।
  • প্রস্তাবে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করেই জেরুজালেমের মর্যাদা নিয়ে সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
  • এতে আরো বলা হয়, যেকোনো সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ, যা পবিত্র নগরী জেরুজালেমের চরিত্র, মর্যাদা বা জনসংখ্যার অনুপাত পরিবর্তন করতে চায়, তার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, তা অকার্যকর ও বাতিল এবং তাকে অবশ্যই এ সংক্রান্ত নিরাপত্তা পরিষদের বিধি অনুযায়ী বাতিল করতে হবে।

প্রতিক্রিয়া

সাধারণ পরিষদে বক্তব্য রাখার সময় নিকি হ্যালি; Source: EDUARDO MUNOZ ALVAREZ @ AFP

  • সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগেই জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিকি হ্যালি হুমকি দিয়েছিলেন, যারা তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিবে, তাদের নাম তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও হুমকি দিয়েছিলেন, যেসব রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়েও তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিবে, তাদেরকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হবে।
  • প্রস্তাব পাশের পর নিকি হ্যালি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই দিনটিকে মনে রাখবে, যেদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সবাই মিলে যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করেছে। তিনি আরো বলেন, যেদিন যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অনুদান দেওয়ার জন্য আবারও ডাকা হবে, অথবা অন্যান্য রাষ্ট্র যখন আর্থিক সাহায্যের জন্য বা নিজেদের স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাব খাটানোর জন্য অনুরোধ করবে, সেদিনও তারা এই দিনটির কথা স্মরণ করবেন।
  • ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জাতিসংঘকে ‘মিথ্যার ঘর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আবারো তার পদক্ষেপের জন্য ধন্যবাদ জানান।
  • ফিলিস্তিন এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের একজন মুখপাত্র একে ফিলিস্তিনের জন্য বিজয় হিসিবে আখ্যায়িত করেন।

প্রস্তাবের তাৎপর্য

সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী; Source: Justin Lan @ EPA

  • নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাবগুলো হয় বাধ্যতামূলক। কোনো রাষ্ট্র তা না মানলে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যগুলোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে সামরিক বা অর্থনৈতিক অবরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
  • কিন্তু সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবগুলো ‘নন বাইন্ডিং’। অর্থাৎ এটি মানতে কেউ বাধ্য নয়। তাই এই প্রস্তাব পাশের পর বাস্তবে কোনো প্রভাব পড়বে না।
  • তবে এই প্রস্তাবের মাধ্যমে জেরুজালেমের উপর ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের দাবির নৈতিক বিজয় ঘটেছে, বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে এবং এটি ভবিষ্যত কোনো সিদ্ধান্তের সময় উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে।

ফিচার ইমেজ- EDUARDO MUNOZ ALVAREZ @ AFP

Related Articles