Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের রেশ: চীন এখন ইউরোপের দিকে ঝুঁকছে

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে প্রযুক্তি এবং শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিনিয়োগের দিক দিয়ে ব্যাপক প্রতিযোগিতা ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এটা ছাড়াও চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বৈরি মনোভাব, চীনের পণ্যদ্রব্যের উপর অতিরিক্ত টারিফ প্রয়োগ ইত্যাদি নানান কারণে চীন থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নম্রভাব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছিলো না। হয়তো সেই কারণেই ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, চীন তাদের বিনিয়োগ মাত্রা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে ইউরোপে বাড়িয়ে দিয়েছে।

লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, চীনের যুক্তরাষ্ট্র সাথে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমশ কমে যাচ্ছে। অনেকেই এই ব্যাপারটা আগে থেকে অনুমান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু চীন যে ইউরোপের দিকে তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিবে সেটা সম্পর্কে তেমন কথাবার্তা শোনা যায়নি। এই বছরের অর্ধেক যাওয়ার পর ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, বিগত ৬ মাসে চীনের সরাসরি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে এই ‘সরাসরি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ’ কী, সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরি সম্পর্ক: ইউরোপের দিকে চীনের নজর; Image Source: nl.dreamstime.com

অর্থনীতিতে ‘সরাসরি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ’ কে ইংরেজি পরিভাষায় বলা হয় ‘Financial Direct Investment’। সংক্ষেপে FDI (এফডিআই)। যখন একটি দেশের কোনো একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান কিংবা ফার্ম অন্য একটি দেশে তাদের ব্যবসায়িক আগ্রহ দেখায়, তখন সেখানে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটানোর জন্য যে অর্থ বিনিয়োগ করা হয় সেটাই হচ্ছে এফডিআই।

একটি দেশের কোন একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যখন অন্য দেশে বিনিয়োগ করে, তখন সেখানকার স্থানীয় বাজারে যদি তা প্রভাব বিস্তার করে এবং সেই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে তাহলেই কেবল এই এফডিআই এর কার্যকারিতা বোঝা যায়। এই এফডিআই এর মাধ্যমেই আসলে একটি দেশের বিনিয়োগ ক্ষমতা কেমন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক লাভ-লোকসান সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

বিশ্ব অর্থনীতির নতুন জুটি চীন এবং ইউরোপে; Image Source: Financial Times

বিগত কয়েকমাসে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বাণিজ্যিক দ্বৈরথের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রীতিমতো একটি ঝড় বয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, চীন তাদের ব্যবসা উত্তর আমেরিকার এই দেশ থেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়ে ইউরোপের দিকে ঝুঁকছে। গত ছয় মাসের এফডিআই পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আগে যে পরিমাণে সরাসরি বিনিয়োগ করা হতো, ইউরোপে তার তুলনায় নয় গুণ বেশী বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বেশী বিনিয়োগ করা হচ্ছে সুইডেনে যার পরিমাণ ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। এরপরই আসছে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ যথাক্রমে – যুক্তরাজ্য (বিনিয়োগ- ১.৬ বিলিয়ন ডলার), জার্মানি (বিনিয়োগ- ১.৫ বিলিয়ন ডলার) এবং ফ্রান্স (বিনিয়োগ- ১.৪ বিলিয়ন ডলার)। চীন যেসব পণ্যদ্রব্যের মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে সেগুলো হলো অটোমোবাইল, বায়োটেকনোলজি, স্বাস্থ্য, সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্য দ্রব্য, রিয়েল এস্টেট ইত্যাদি খাত।

 চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আগে যে পরিমাণে সরাসরি বিনিয়োগ করা হতো, ইউরোপে তার তুলনায় নয় গুণ বেশী বিনিয়োগ করা হচ্ছে; Image Source: Bunkerist

যুক্তরাষ্ট্রে গতবছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চীন থেকে যেখানে বিনিয়োগ ছিল প্রায় চব্বিশ বিলিয়ন ডলার সেখানে এই বছর তা নেমে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারে চলে এসেছে। প্রায় বিরানব্বই শতাংশ এফডিআই কমে গিয়েছে। কিছুদিন আগেই চীন থেকে একটি ঘোষণা এসেছে যে, ইউরোপে তারা প্রায় বাইশ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ২.৫ বিলিয়ন ডলার। বিগত ছয় মাসের মধ্যেই ইউরোপে করা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কাজ শেষ হয়েছে। চীনের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে প্রতিযোগিতা চলছিলো তাতে তাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্যতায় কিছুটা নাড়া লাগলেও ধীরে ধীরে চীন সেটা কাটিয়ে উঠছে।

সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে- চীন খুব দ্রুত তাদের বিনিয়োগ লক্ষ্য পরিবর্তন করে খুব দক্ষতার সাথে ইউরোপে নিজেদের জন্য আলাদা একটি অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। এর আগে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে চীন একই ধরনের এবং একই পরিমাণ পণ্যদ্রব্য রপ্তানি করতো এবং সেখানকার ব্যবসায় বিনিয়োগ করতো। কিন্তু ইদানীং তাদের লক্ষ্যবস্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে ইউরোপের দিকেই বেশি তৈরি হয়েছে। এরকম হওয়ার জন যুক্তরাষ্ট্রকে দোষ দিতেই হবে। গত সপ্তাহতেই ট্রাম্প চীনের পণ্যদ্রব্যের উপর আগের টারিফের সাথে আরও দু’শো বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দিয়েছে।

চীন তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক সামঞ্জস্যতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। চীনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এরকম ব্যবহারের ফলে ব্যবসায়িক খাতে বড়ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমনকি এর ফলে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে। যেসব পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন ঘোষণা এসছে সেগুলো হচ্ছে চীনের তৈরি খাদ্যদ্রব্য, তামাক, রাসায়নিক দ্রব্য, কয়লা ইত্যাদি। এছাড়া সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য নিত্য দৈনন্দিন জিনিসপত্র যেমন আসাবাবপত্র, কাঠের তৈরি দ্রব্যাদি, হাতের ব্যাগ, সুটকেস, সাইকেল, টয়লেট পেপার, সৌন্দর্যবৃদ্ধির মেকআপ ইত্যাদি পণ্যের উপর বেশি করে টারিফ বসানো হয়েছে।    

বৈরি সম্পর্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষ দিতেই হবে; Image Source: Blacknews.ro

তবে এটা ঠিক যে, চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন কিছুটা চাপের মধ্যে আছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় মুদ্রানীতি অনেক দৃঢ় এবং কড়া-ধাঁচের। সেখানে বিনিয়োগ ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য চীনকে বিভিন্ন সময়ে তাদের বিনিয়োগক্ষেত্রের বিভিন্ন পর্যায়কে বার বার নিরীক্ষণ করতে হচ্ছে। একেক দেশের জন্য এক একবার বিনিয়োগ নীতি পরিবর্তন করতে হচ্ছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮ বার বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রস্তাবনা বাতিল হওয়ার পর এবং অন্যান্য কিছু দেশ থেকেও একইভাবে বাতিল হওয়ার পর চীনের উপর চাপটা একটু বেশি পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। তবে ইউরোপের সাথে বাণিজ্যিক দিকে একটি সমঝোতায় আসার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে চীন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে চীনে নিজেদের ব্যবসায়িক অঞ্চল গড়ে তোলার দিকটাও চীন সরকার দেখছে। আমদানি-রপ্তানি দুইদিক বিবেচনা করেই চীন এগোচ্ছে।

Image Source: vi.rfi.fr

পৃথিবীর মোট অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, চীনের ব্যবসায়িক অঞ্চল নিঃসন্দেহে অনেক বড় এবং প্রভাবশালী একটি বাজার। কোনো কারণে যদি এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবাহে বাঁধা আসে, তাহলে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও তার বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে সাংহাই, জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া – এসব দেশের অর্থনৈতিক সূচকে বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছে।

আরও ভালো করে বললে বড় ধরনের ধ্বস নেমেছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এশিয়ার এই অঞ্চলে কি ধরণের অবস্থার সৃষ্টি হবে সেটা সরাসরি বোঝা যাচ্ছে না, তবে এখানকার অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা লাগবে সেটা মোটামোটি নিশ্চিত। চীন এখন তাদের অর্থনীতিকে পুনরায় গোছানোর জন্য ইউরোপের দিকে যেভাবে বিনিয়োগ করছে এবং সেখানে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার চেষ্টা করছে তাতে কতটুকু লাভ হবে সেটা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু চীনের এমন প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। দুই অঞ্চলের মধ্যেকার অর্থনৈতিক অবস্থা কতটুকু দৃঢ়তা লাভ করবে সেটা সামনের দিনগুলোই বলে দিবে।   

ফিচার ইমেজ – nineoclock.com                                                       

Related Articles