Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উত্তম কুমার: মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরেও বাঙালির মনের সম্রাট

পশ্চিমবঙ্গের আপামর চলচ্চিত্রপ্রেমীর কাছে ২৪ জুলাই দিনটি বিষণ্ণতার প্রতীক। ১৯৮০ সালের এই তারিখেই তার ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে পরলোক গমন করেন বাঙালির মহানায়ক উত্তম কুমার। চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হলো ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির শুটিং করতে করতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যুর পর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এবং তার বাইরের বাঙালির কাছে উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তা আজও অটুট। বাঙালি চলচ্চিত্র শিল্পে নায়কের আগমন কম হয়নি উত্তমের আগে ও পরে, কিন্তু যখন তুল্যমূল্য বিচার করা হয়, তখন যেন দ্বিতীয় স্থান থেকেই পদমর্যাদার বিন্যাস শুরু হয়। প্রথম স্থানটি উত্তম কুমারের জন্যেই বাঁধা থাকে চিরকালের মতো।

তার এই অশেষ জনপ্রিয়তা- তার মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরেও- অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়। উচ্চমানের কলাকুশলী উত্তম কুমারের আগে যে তার সমকালে বা পরে কম এসেছে তা বলা চলে না কিন্তু তাদের অনেকেই আজ বিস্মৃত। তাহলে উত্তমকুমারের বিশেষত্ব কী?

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে উত্তম কুমার; Source: Twitter handle of Film History Pics @FilmHistoryPic c

উত্তম কুমারের মধ্যে বাঙালিয়ানার সেই চির প্রতীক

উত্তম কুমারের এই চিরকালীন জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ তার বাঙালিয়ানার প্রতীক। বাঙালিয়ানার প্রতীক বলতে যে তার সুদর্শন চেহারা বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব তা-ই শুধু নয়, উত্তম কুমার ছিলেন বাঙালি সত্তার এক সম্পূর্ণ ‘প্যাকেজ’। তার সমকালীন সময়ে তৈরি হওয়া বাংলা ছবিতে তিনি দারুণভাবে মিশ খেয়ে যেতেন- তার ব্যক্তিত্ব, হাসি, উচ্চারণ- তার সম্পূর্ণ ভাবমূর্তিই। সাবেকি বাঙালি দর্শকের কাছে ছবিতে বৈষয়িক আতিশয্যের আবেদন ছিল না সেভাবে। বরং তাদের বেশি ভালো লাগত সহজ জীবন দর্শন এবং যাপন; মেধার কদর; সরল রোম্যান্টিকতা; শ্রুতিমধুর গান এবং দৃষ্টিমধুর অভিব্যক্তি। এই সমস্ত জোগান তখনকার দিনের পরিচালকরা দিলেও তা পর্দায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি দুর্দান্ত মাধ্যমের আর সেই কাজটিই উত্তম কুমার করতেন অনায়াস ভঙ্গিতে।

উত্তম কুমার ছিলেন বাঙালি সত্তার এক সম্পূর্ণ ‘প্যাকেজ’; Image Source: ThePinsta

এক চিরকালীন সাংস্কৃতিক আইকন

উত্তম কুমারের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক আইকনও ছিল পুরোদস্তুর। অবশ্য সেই সময়ে যে তিনি একাই সেইরকম আইকন ছিলেন তা বলা যায় না, কারণ তখন বাঙালি চলচ্চিত্রে বড় নামের ছড়াছড়ি ছিল। কিন্তু উত্তম কুমারের ভদ্র-নম্র আবেদন দর্শকের কাছে ছিল বিশেষ প্রিয়। তাকে কোনোদিন চিৎকার করে বা খলনায়ককে পিটুনি দিয়ে নিজের নায়কোচিত পৌরুষ ফলাতে হয়নি আর অনেকের মতো সেসব না করেও সহজভাবে তিনি ঢুকে গিয়েছেন তার চরিত্রের অন্তরে। এর কারণ, তিনি অভিনয়ের সূক্ষ দিকগুলিকে ওস্তাদের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আর সেই ওস্তাদি শুধুমাত্র প্রতিভা থাকলেই রপ্ত হয় না; তার জন্যে প্রয়োজন অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা, যা উত্তম কুমারের ছিল।

বেঁচে থাকলে দিতে পারতেন আরও অনেক কিছু

উত্তম কুমারের দুর্ভাগ্য যে তিনি চুয়ান্নরও কম বয়েসে চলে গিয়ে পরবর্তীকালে জনপ্রিয় হওয়া চরিত্রধর্মী ছবি করতে পারেননি। পাশাপাশি, একথাও সত্যি যে ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকতে থাকতেই তার প্রয়াণ মানুষের মনে তার ভাবমূর্তিকে এক অমরত্ব দান করেছে যার জন্যে তার জনপ্রিয়তা আজও আকাশচুম্বী।

উত্তম কুমারের ভদ্র-নম্র আবেদন দর্শকের কাছে ছিল বিশেষ প্রিয়; Image Source: Pinterest

উত্তম কুমারের অনেক সমসাময়িক বড় শিল্পী যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় বা রবি ঘোষকে বাংলা ছবির দুঃখের দিনে এমন সমস্ত চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে যা তাদের সুনামের প্রতি সুবিচার করেনি। উত্তম কুমারকে সে সমস্ত করতে হয়নি বলেও তিনি আজ অমর বলে তার অনেক অনুরাগীরই বিশ্বাস। ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত উত্তম অভিনীত ‘দেশপ্রেমী’ বলে একটি হিন্দি ছবিতে তার একটি তুচ্ছ ভূমিকা বেশ পীড়া দিয়েছিল তার অনুরাগীদের। একটি ছবিতেই মরণোত্তর যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন মহানায়ক, তাতে সেরকম ছবির সংখ্যা আরও বেশি হলে যে তার ভাবমূর্তি অবশ্যই ক্ষুণ্ন হতো, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আজকের তুলনায় তিনি ছিলেন মান্ধাতার আমলের মানুষ; কিন্তু হারিয়ে যাননি তাও

উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তার আরেকটি বিস্ময়কর দিক হলো, তিনি বাজার-অর্থনীতির পূর্ববর্তী সময়কার শিল্পী হয়েও আজকের বাজার-প্রযুক্তিনির্ভর কলাকুশলীদের কাছে জনপ্রিয়তার দৌড়ে হার মানেননি। আজকের চলচ্চিত্র শিল্প উত্তম কুমারের সময় থেকে এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই প্রযুক্তি-আবিষ্কার-এর নিরিখে; চলচ্চিত্র নিয়ে নানা নতুন চিন্তাভাবনা-গবেষণাও আজ হয়ে চলেছে; অমিতাভ বচ্চন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা পুরোনো জমানার লোক হয়েও এই নবযুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলেছেন অক্লান্তভাবে। এখানে তারা বিগত দিনের অভিনেতা-চলচ্চিত্র শিল্প থেকে অনেকটাই বেশি প্রাসঙ্গিক এবং জনপ্রিয়। কিন্তু এই উত্তম কুমার এমন এক অভিনেতা, যাকে যুগান্তরও হারাতে পারেনি। আরও কয়েক দশক বাঁচলে তিনিও অমিতাভ বা সৌমিত্রদের মতো নতুন যুগকে আলিঙ্গন করতে পারতেন; খুশিও হতেন তাতে। আরও নতুন স্তরে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারতেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েও তিনি হারিয়ে যাননি অতীতের অন্ধকারে। চব্বিশে জুলাই ফিরে আসে সংবৎসর।

উত্তম কুমারের আটত্রিশতম মৃত্যুদিবসে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের; তিনি ক্ষমতায় আসার পরে ২০১২ সালে ‘মহানায়ক সম্মান’ চালু করেন। এদিনও তিনি সেই পুরস্কার তুলে দেন বেশ কিছু অভিনয়কুশলীদের হাতে; Source: Mamata Banerjee twitter handle @MamataOfficial

উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ ছিল মানুষ হিসেবে তার সুনাম। অভিনেতা হিসেবে দম্ভ-দর্প নয়, উত্তম কুমার ভালোবাসতেন মানুষের কাছাকাছি থাকতে আর তাই মানুষও তাকে ভালোবাসতেন। সহকর্মীদের আর্থিক বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়াতেন নিঃস্বার্থভাবে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন একা, কিন্তু তিনি সেটাকে কোনোদিন তার শিল্পীসত্তা এবং বন্ধুসত্তার পথে অন্তরায় হতে দেননি। খুব বড় মাপের মনন এবং মানসিকতা না থাকলে এটা করা যায় না।

মানুষ উত্তম কুমারের জন্মের চেয়েও বেশি তার মৃত্যুর দিনটিকেই বেশি মনে রেখেছেন

উত্তম কুমারের একটি বৈশিষ্ট্য হলো যে তার জন্মতিথির থেকে মৃত্যুতিথিকেই মানুষ বেশি মনে রেখেছেন। খুব বেশি লোককে উত্তম কুমারের জন্ম তারিখ, অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায় না যা একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে বেশ আশ্চর্যজনকই।

অভিনয়ের সূক্ষ দিকগুলিকে ওস্তাদের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন; Image Source: Medium

কিন্তু উত্তম কুমারের ক্ষেত্রে এই আশ্চর্জনক ব্যাপারটি এটাই প্রমাণ করে যে তার মৃত্যু আদতে ছিল পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কাছে এক সাংস্কৃতিক অবসান। বাঙালির চলচ্চিত্রশিল্পের রসাস্বাদনে তার ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। সেই বাজার-পূর্ববর্তী সময়ে যখন শিল্পকলার কদরই ছিল শিল্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য, তখন উত্তম কুমারের রাজত্বই ছিল বাঙালির স্বর্ণময় স্বপ্নের বিচরণভূমি। সেটির আচমকা পতন বাঙালিকে এতটাই ধাক্কা দেয় যে ২৪ জুলাই দিনটিকে এক চূড়ান্ত ট্র্যাজেডির দিন হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।  

তবে শেষে একটা কথা না বলে শেষ করা ঠিক হবে না। উত্তম কুমারকে নিয়ে আমরা নস্টালজিয়ায় ভুগলেও তার লিগ্যাসি বাঁচিয়ে রাখার মতো কাজ ক’টা করতে পেরেছি তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তার অভিনীত প্রত্যেকটি ছবিকেই আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি কি? তার নামে একটি মিউজিয়াম বা গবেষণাকেন্দ্রের নাম আজ দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়া উচিত ছিল। সংরক্ষণের সংস্কৃতি আমরা যদি আজও না শিখি তবে আর কবে শিখব?

Featured Image Source: Scroll.in

Related Articles