খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সময়টি ২০১৮ সালের জুলাই মাসেরই একটি দিন। ভোর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের টার্গেট অ্যারেনা স্টেডিয়ামে জনে জনে ভীড় করছে হাজারো মানুষ, যাদের বেশিরভাগই ইথিওপীয় প্রবাসী। নতুন প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলীকে একনজর সামনে থেকে দেখার সামান্য বাসনা যেন কেউ হারাতেই চাচ্ছেন না। আবি আহমেদ যখন ভাষণ দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন তখন বুঝতেই পারছিলেন আফ্রিকার সেসব প্রবাসীর মনের আকুলতাকে। আর কেনই বা সেই আকুলতা থাকবে না? আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যে উদার রাজনীতির প্রচলন তার দেশে চালানো শুরু করেছেন, তার প্রতিফলন তো সবাই দেখতে পাচ্ছে। ভাষণ দিতে দাঁড়িয়েই তিনি বলতে লাগলেন তার মনের কথা। একে একে ওরোমো, আমরাহা, টাইগারি, সোমালি, ইংরেজি সব ভাষাতেই তিনি বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। তার দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষায় তিনি পারদর্শী তো বটেই। আর তিনি ভাল করেই জানেন, নিজস্ব জাতিসত্ত্বার ভাষা দিয়ে খুব সহজভাবেই জয় করে নেয়া যায় স্ব-দেশীয় মানুষের মন।
এ বছরের নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাওয়ার সম্মানে ভূষিত হলেন ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়া এই আবি আহমেদ আলী। ইথিওপিয়ার বেসাসা শহরে ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগস্ট জন্ম নেন তিনি। দরিদ্র কৃষক মুসলিম পিতা এবং খ্রিস্টান মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া আলী ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যকে দেখে আসছেন খুব কাছ থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার হর্ন নামে খ্যাত এই দেশে বাস করে তিনি বুঝতে শিখেছেন যে, যুদ্ধ শুধু ধ্বংসাত্মক এক লীলাখেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। শান্তি আর সৃষ্টির উল্লাসে যে কী অপরিসীম আনন্দ তা হয়তো তিনি বাল্যকাল থেকেই খুঁজে চলেছিলেন। আর তাই তো ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডাতে যান। পড়ালেখায় ভালই ছিলেন আবি। একইসাথে দক্ষ ছিলেন ওরোমো, আমরাহা, টাইগারি এবং ইংরেজি ভাষায়। এসব ভাষা ইথিওপিয়ার নৃ-গোষ্ঠীদের। তিনি নিজেও ওরোমো গোত্রের ছিলেন। রাজনীতির পদযাত্রা শুরু হয় ওরোমো ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন সদস্য হিসেবেই। পরে ২০১০ সালে ইথিওপিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচিত সদস্য হন।
ইথিওপিয়া দেশটি শুরু থেকেই যেন রণক্ষেত্র ছিল, যার বেশিরভাগ দ্বন্দ্বই প্রতিবেশী দেশ ইরিত্রিয়ার সাথে। ১৯৫২ সালে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ইরিত্রিয়া হয় ইথিওপিয়া ফেডারেশন রাষ্ট্রের অধীনে একটি বিশেষ অঙ্গরাজ্য। কিন্তু তখন থেকেই ইথিওপিয়ার রাজার দুর্নীতি এবং কঠোর শাসনব্যবস্থা অতিষ্ট করে তুলে দেশের জনগণকে। প্রায় ৩০ বছর ধরে দু'দেশের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হয়। এরপর ১৯৯৩ সালের গণভোটের মাধ্যমে ইরিত্রিয়া আলাদা হয়ে যায় ইথিওপিয়া থেকে। যদিও বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এই গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্তু সবকিছুর মোড় যেন পাল্টে যায় ঠিক এর পর থেকেই। ১৯৯৮ সালে দুই দেশই দাবী করে বসে দুই দেশের সীমান্তে থাকা শহর বাদমের মালিকানা। অর্থনৈতিকভাবে যদিও এই শহরের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই, তবুও এই শহরকে নিয়েই শুরু হয় টান টান উত্তেজনা। এই শহরের মালিকানা পেতে দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। সংঘর্ষে প্রায় এক লক্ষের মতো মানুষের নিহত হয় এবং অনেক বেসামরিক নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়। শরণার্থী সমস্যা বিকট আকারে ধরা দেয় দুই দেশেই।
পরে বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত গড়ালে একটি কমিশন গঠিত হয়। ২০০২ সালে সেই কমিশন রায় দেয় যে, বাদমে শহরটি ইরিত্রিয়াকেই হস্তান্তর করা উচিত। কিন্তু ইথিওপিয়া সেই দাবী মেনে নেয়নি। সে দেশের সরকার পুনরায় বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য আদালতে আবার আবেদন করতে থাকে। কিন্তু ইরিত্রিয়া সে দাবী আবার নাকচ করে দেয়। আর সেই কারণেই সীমান্তের এই সমস্যার আর কোনো সুরাহা হয়নি। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে সেই বিবাদপূর্ণ অবস্থার কোনো সন্তোষজনক সমাধান দেখেনি বিশ্ব মোড়লবৃন্দ।
এদিকে ইথিওপিয়াতেও চলছিল রাজনৈতিক সংকট। সংবাদপত্রগুলো হারিয়েছিল তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের অতিমাত্রায় দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব এবং বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য যেন ডেকে আনতে চাচ্ছিলো সরকারের পতনকেই। ঠিক সেটিই হলো। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী হেলেমারিয়াম দেসালেগন তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপরেই এপ্রিল মাসে ক্ষমতায় আসেন ৪১ বছর বয়সী আবি আহমেদ আলী। এই প্রথম দেশটির সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নৃ-গোষ্ঠী ওরোমো থেকে একজন প্রতিনিধি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন।
ক্ষমতায় এসেই আবি আহমেদ আলী পাল্টে দেন পূর্বের রাজনৈতিক অবস্থাকে। দেশটির সংকটমুহূর্তে যেন আশীর্বাদ হয়েই আসেন তিনি। আগের রাজনৈতিক শাসনামলে যারা বিক্ষোভ কিংবা ভিন্নমত প্রকাশ করার জন্য কারাবন্দী হয়েছিলেন, ক্ষমতায় এসেই তাদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে দেন তিনি। যেসব ওয়েবসাইট আগে সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ ছিল শুধু সরকারের সমালোচনার জন্য, তিনি সেগুলো আবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। শুধু তা-ই নয়, সেদেশে সে যে আগে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর উপর অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল, তিনি সেটা সাবলীলভাবে মেনে নিয়ে জাতির কাছে ক্ষমাও চান।
এসব কারণের ইথিওপিয়ার মানুষ যেন আলাদাভাবে এক নতুন রাষ্ট্রনায়ককে দেখতে পেল। আফ্রিকার দরিদ্র যে রাষ্ট্রে এতদিন ধরে সংঘর্ষ লেগেই থাকতো, যে রাষ্ট্রে দুর্নীতির কারণে দিনকে দিন অর্থনৈতিক বৈষম্য তুমুল আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, সেই রাষ্ট্রে এমন এক মহানায়কের আগমন যেন অনেকটা স্বর্গীয় বার্তাই নিয়ে এলো। মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হতে লাগলো। সবাই বুঝতে লাগলো, আফ্রিকার এই দেশে হয়তো এই মহানায়কের হাত ধরেই আগমন ঘটবে গণতন্ত্রের। যে গণতন্ত্রের জন্য তারা এতদিন আকাতরে প্রাণ বিলিয়ে আসছিলেন।
আরো মজার ব্যাপার হলো, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলী ২০০২ সালের সেই কমিশনের সীমান্তের জন্য দেয়া সেই রায়টিকেও মেনে নেন। বাদমে শহর থেকে প্রত্যাহার করে নেন ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী। এতদিন যে শহরের জন্য ইরিত্রিয়ার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল ইথিওপিয়া, সেই সংঘর্ষের সমাধান হয়ে গেল তিনি ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই। মাত্র এক বছরে তিনিই পেরেছেন দুই দেশের মধ্যে বিবাদমান প্রায় ২০ বছরের সংঘাতের সমাপ্তি টানতে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
ইথিওপিয়া যখন ঘোষণা দিল যে তারা তাদের সৈন্য সীমান্তের সেই শহর থেকে প্রত্যাহার করে নেবে, এরপরে ইরিত্রিয়া থেকেও ঘোষণা আসে যে তারা তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এভাবেই দুই যুগের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয় ভালবাসার মাধ্যমে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি সাক্ষাৎকারে আবি আহমেদ আলী বলেন, "এখন থেকে আর ইথিওপিয়া আর ইরিত্রিয়ার মাঝে কোনো বর্ডার থাকবে না, ভালবাসার সেতু সেই বন্ধনকে ভেঙে দিয়েছে।"
এই চুক্তিটি আফ্রিকায় একটি অসাধারণ প্রভাব ফেলবে। কেননা, এতদিন ইথিওপিয়া আর ইরিত্রিয়ার এ সংঘাতের সাথে সাথে আফ্রিকার প্রায় অনেকগুলো দেশেই প্রক্সি-ওয়ার চালাচ্ছিল এই দুটি দেশ। সেই কারণে সেসব দেশেও এখন মোটামুটি একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করবে। তাছাড়া এই দুটি দেশ আফ্রিকার মধ্যে এমনিতেই দরিদ্রতম দেশ। সংঘাতের জন্য তাদেরকে সামরিক খাতে ব্যয় করতে হত প্রচুর। এখন সেই ব্যয়ের পরিমাণটিও কমে যাবে। সেই অর্থ ব্যয় হবে নিজেদের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য।
আফ্রিকাতে বিনিয়োগ করার জন্য প্রস্তুত চীন, আরব আমিরাত ও সৌদি-আরব। এখন সেই বিনিয়োগের জন্যও একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে। তাছাড়া ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়ার মাঝে বাণিজ্যের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে যা তাদেরকে আরো সুসংগঠিত করে গড়ে তুলবে। দুই দেশের মানুষেরাও নিশ্চিন্তে দুই দেশে ভ্রমণ করতে পারবে। বর্ডারের কারণে অনেক পরিবার তাদের আপনজনদেরকে কাছ থেকে হারিয়েছিল। এখন সেই বাঁধা যেন আর থাকছে না। এভাবেই অনেক মানুষের মন নির্বিঘ্নে জয় করে নিলেন ইথিওপিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলী। আর সেই কারণেই তিনি এখন এতটাই জনপ্রিয়। আর কেনই বা হবেন না? বর্তমান এই সংঘাতময় বিশ্বে তার মতো কয়জন রাষ্ট্রনেতাই বা পারেন এভাবে কোনোরুপ বিশৃঙ্খলা ছাড়া ভালবাসা দিয়ে শান্তির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে? উদারীকরণের এই রাজনীতির এখন বড়ই এ অভাব এই বিশ্বে! তাই হয়তো নোবেল কমিটি যোগ্য ব্যক্তিকেই সম্মানিত করলেন!
শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি
This article is written in the Bengali language which contains information about Abiy Ahmed Ali, the PM of Ethiopia who won the Nobel peace prize in 2019. All authentic information is hyperlinked here.
Featured image: thecentralizer.com/hiviassa