Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সম্পদের অভিশাপেই কি পিছিয়ে পড়েছে আজকের আফ্রিকা?

ফসিল রেকর্ড ধরে হিসাব করলে আফ্রিকাতেই পাওয়া যাবে মানবজাতির সবচেয়ে আদি বসতভূমির সন্ধান। ধীরে ধীরে মানবজাতি এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। খনিজ, বনজ কিংবা অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান পড়বে আফ্রিকাতেই। মূল্যবান হীরার সবচেয়ে বড় খনিগুলো ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা জুড়ে। সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন এলাকয় আছে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আর খনিজ তেলের ভান্ডার। উত্তর আফ্রিকার খনিজ সম্পদের তালিকায় আছে স্বর্ণ, তামা সহ মূল্যবান সব ধাতু। কিন্তু এই অঞ্চলে কাচামালের তুলনায় শিল্পায়ন মোটেই এগিয়ে যায়নি।

আফ্রিকার প্রতিটি দেশেই আছে এই মহাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ কর্মক্ষম তরুণেরা। এই মহাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। কিন্তু এত সম্পদের মাঝেও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে আফ্রিকা। গরীব মহাদেশের তালিকায় পড়ে ধুকে ধুকে যেন এগিয়ে চলছে আফ্রিকার উন্নয়ন। গৃহযুদ্ধ যেন জড়িয়ে আছে এই মহাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার আর মহামারী কেড়ে নিচ্ছে লক্ষ প্রাণ। ইউরোপিয়ান আর আমেরিকান ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিড়ে বেরোলেও জাতিগত বিদ্বেষ আর নড়বড়ে অর্থনীতির বেড়াজালে কোথায় যেন আটকে আছে আফ্রিকার উন্নয়ন আর এই মহাদেশের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা। মানবজাতির আদি এই বাসভূমি কেন এত পিছিয়ে পড়ে আছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিতে?

ঔপনিবেশিক শাসন, দাস ব্যবসা আর শিক্ষার ব্যবস্থা

আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়ের সূচনা হয় ১৪০০ সালের দিকে, যখন দলে দলে ইউরোপীয় পর্তুগীজ বণিকেরা আসতে থাকে। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে এই বণিকেরা শুরু করে আখ চাষাবাদ। শক্ত সামর্থ্য আফ্রিকানদের শুরুতে কাজ দেওয়া হয় আখের ক্ষেতগুলোতে। কঠোর পরিশ্রমী আর প্রভু-ভক্তির খ্যাতিই কাল হয়ে দাঁড়ায় আফ্রিকার অধিবাসীদের জন্য। আফ্রিকার নিরক্ষর আর সরল মানুষগুলোর স্বাধীন পরিচিতি যেন কোথায় হারিয়ে যায়। দলে দলে বন্দী করে দাস হিসাবে ইউরোপে পাঠানো শুরু হয় তাদের।

১৭৬৯ সালে দাস ব্যবসার এক বিজ্ঞাপন; ছবিসূত্রঃ commons.wikimedia.org

পর্তুগীজ, ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ কিংবা ওলন্দাজ- সবাই দলে দলে শক্ত সামর্থ্য আফ্রিকানদের ধরে এনে তাদের কাজে লাগাতে শুরু করে। আফ্রিকানদের রক্ত-ঘামে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে ইউরোপীয় আর আমেরিকান শিল্প-সভ্যতার ভিত। ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের নিজেদের দাস ব্যবসা আর অবাধ শ্রমিকের সরবরাহ খনি হিসাবে আফ্রিকাকে ব্যবহার করতে এই এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। এরপর কেটে গেছে অনেক বেলা, দাস ব্যবসা এখন বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ, ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিড়ে মুক্ত আফ্রিকান দেশগুলো কি এখনো নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে পেরেছে নিজেদের মতো করে?

উত্তরটা নেতিবাচক, মার্কিন গণমাধ্যম  সিএনএনের এক রিপোর্ট বলছে সেই ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে আফ্রিকার এখনকার প্রজন্ম। তৈরী হচ্ছে না দক্ষ মানবসম্পদ। জাতিসংঘ, পশ্চিমা দেশ কিংবা দাতা সংস্থা সবার সম্মিলিত প্রয়াস দিয়েও এই অঞ্চলের কোমলমতি শিশুদের আনা যাচ্ছে না ক্লাসরুমে। দরিদ্র বাবা-মা বেশিরভাগ সন্তানকে বাধ্য করছেন শিশুশ্রমে। সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে সাহারা মরুভূমির আশেপাশের দেশগুলোতে। এই এলাকার ৫-১৪ বছর বয়সী শিশুদের ৪০ শতাংশই শিশুশ্রমিক। সংখ্যার হিসেবে যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪.৮ কোটিতে। স্কুলে যাওয়া শিশুদের এক বড় অংশ ঝরে পড়ছে, যার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মেয়েরা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনেক উদ্যোগের পরও ঠেকানো যাচ্ছে না বাল্যবিবাহ। এই এলাকার নারীদের বেশিরভাগের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১২-১৩ বছর বয়সে। অতি সম্প্রতি ইউনেস্কোর করা এক পরিসংখ্যানে বেরিয়ে এসেছে- শুধু সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন দেশগুলোতে ৯.৪ কোটি নারীর কাছে পৌঁছায়নি শিক্ষার আলো। নিরক্ষরতার অন্ধকারে ডুবে আছে পুরো আফ্রিকার এক বড় অংশ।

দুর্নীতির অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো আফ্রিকা

আফ্রিকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে অন্যতম বাধা দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাব। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাব মতে প্রতি বছর পুরো আফ্রিকা জুড়ে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি হচ্ছে। কর ফাকি দেওয়া, ঘুষ দেয়া-নেয়া, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, মানি লন্ডারিং, দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে লাগাম টেনে ধরতে হিমশিম খাচ্ছে আফ্রিকার সরকার প্রধানেরা। এমনকি আফ্রিকার সাধারণ মানুষের অভিযোগ হলো সরকার ব্যবস্থা আর আমলা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বড় অংশ জড়িত দুর্নীতির সাথে। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন, স্বাস্থ্য কিংবা শিক্ষাখাতের উন্নয়নে আসা বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের বড় অংশ জনগণ পর্যন্ত পৌঁছানোর মাঝপথেই যেন হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।

প্রসাশনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে আফ্রিকার সাধারণ মানুষ; ছবিসূত্রঃ theguardian.com

দুর্নীতির কারণে আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশেই তৈরী হচ্ছে অর্থনৈতিক অস্থিশীলতা। এর ফলে আসছে না বৈদেশিক বিনিয়োগ, শিল্পায়নের চাকা স্থবির হয়ে আছে। উপযুক্ত শিল্পায়ন না হওয়ার ফলে কর্মক্ষম জনসংখ্যার এক বড় অংশ থেকে যাচ্ছে বেকার।

গৃহযুদ্ধ আর সন্ত্রাসের গৃহ হয়ে উঠছে আফ্রিকা

গৃহযুদ্ধ হয়ে পড়েছে আফ্রিকার নিত্যসঙ্গী। জাতিগত বিদ্বেষ থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘস্থায়ী এসব গৃহযুদ্ধের শিকার হয়েছে আফ্রিকার প্রায় সবকটি দেশ। সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে। সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, কেনিয়া, সুদান, মালি, কঙ্গো, সিয়েরা লিওন সহ মধ্য আর উত্তর আফ্রিকার বেশীরভাগ দেশে জাতিগত বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে। বেশীরভাগ দেশেই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী জাতিগত দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করছে। আফ্রিকার এসব গৃহযুদ্ধ নিরসনে চলছে কূটনৈতিক তৎপরতাও।

আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ আর তাতে হতাহতের পরিসংখ্যান; ছবিসূত্রঃ economist.com

তবে জাতিগত বিদ্বেষ ছাড়াও এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদও হয়ে উঠছে বিবাদের নতুন কেন্দ্র। ১৯৬০ সালের দিকে গিনি উপকূলে যখন বিপুল তেলের মজুদ পাওয়া যায়, তখন সেই অঞ্চলে বিনিয়োগ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপীয় অনেক বহুজাতিক কোম্পানি। স্থানীয় মানুষের দীর্ঘদিনের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করায় ধীরে ধীরে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এই এলাকা। শুধু গিনি উপকুল নয়, সারা আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণকে কেন্দ্র করে সংঘাত দেখা দিচ্ছে। হীরক সমৃদ্ধ এলাকার দখল নিয়ে সিয়েরা লিওনে হয়ে গেলো মারাত্মক এক গৃহযুদ্ধ।

হীরার খনি থেকে হীরা উত্তোলনের দৃশ্য; ছবিসূত্রঃ www.diamondrocks.co.uk

অভিযোগ আছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিবাদকারী দলগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করে উস্কে দিচ্ছে গৃহযুদ্ধগুলোকে। বিনিময়ে অস্থিতিশীল অঞ্চল থেকে কম দামে ডায়মন্ড পেয়ে যাচ্ছে তারা। খনি থেকে ডায়মন্ড উত্তোলনের পর সাধারণত তা যায় মধ্যস্থতাকারীদের হাতে। সেটি বিক্রি বাবদ প্রতি ক্যারেটে মাত্র ৩০ থেকে ৬০ ইউরো পান উত্তোলনকারী। আর হীরা যদি মানে ভালো হয়, দাম বেড়ে হয়ে যায় দুই থেকে তিন গুণ। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের গৃহযুদ্ধকবলিত অঞ্চলগুলোতে অস্ত্রের মুখে বিনামূল্যেই উত্তোলনকারীদের হীরা কেড়ে নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহীরা।

১৯৯৭ সালে সিয়েরা লিওনের রাস্তায় টহলরত এক বিদ্রোহী; ছবিসূত্রঃ telegraph.co.uk

পুরো আফ্রিকা জুড়ে তাই হীরকখনি এবং তার আশপাশের এলাকাকে গৃহযুদ্ধ আর রক্তক্ষয়ী এই সংঘাত থেকে উত্তরণ করতেই চালু করা হয় ‘কিম্বার্লি প্রসেস’। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে আসা সকল হীরার কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বাজারে সংঘাতপূর্ণ এলাকার ‘ব্লাড ডায়মন্ড’ এর কেনা-বেচা বন্ধ না হওয়ায় কিম্বার্লি প্রসেসের সফলতা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। তাই প্রাকৃতিক এই অমূল্য সম্পদ যে আফ্রিকার স্থিতিশীলতা আর শান্তিকে নস্যাৎ করছে তা বলাই বাহুল্য।

দারিদ্র্য আর মহামারী

দারিদ্র্য যেন আফ্রিকার কাঁধে জেকে বসেছে। আর দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ শিকার হচ্ছে নানা ধরনের রোগব্যাধির। এইডস, জিকা কিংবা ইবোলা- সবকটি মহামারীর বিস্তার ঘটেছে এই আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে। উপযুক্ত স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে এই রোগগুলোর বেশিরভাগই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে।

শুধুমাত্র এইডস মহামারীর আকার ধারণ করার কারণেই সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন দেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু কমে গেছে ২০ থেকে ৩০ বছর। তাই দারিদ্র্য আর মহামারীর দুষ্টচক্র যেন আফ্রিকার পায়ে যেন এক অদৃশ্য শিকল পড়িয়ে দিয়েছে।

ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিড়ে বেরোতে পারলেও আফ্রিকার উন্নয়ন যেন এখনো আটকে আছে অনুন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, দুর্নীতি, জাতিগত বিদ্বেষ, খনিজ সম্পদের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাব, দারিদ্র্য আর মহামারীর বেড়াজালেই।

Related Articles