Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যালিনা মোর্স: তের বছর বয়সী এক মাল্টি-মিলিয়নিয়ার

চকলেট এমনই এক জিনিস, যার আবেদন কখনোই অগ্রাহ্য করা যায় না। যদি স্বাস্থ্যগত কোনো কারণে চিকিৎসকের বারণ না থাকে কিংবা কেউ অতিরিক্ত স্বাস্থ্যসচেতন না হন, তাহলে বয়সের কথা ভুলে মিষ্টি এ জিনিসটিকে মুখে পুরতে চান সকলেই। তবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি আর একটি শিশুর চকলেট খাওয়ার মাঝে পার্থক্য আছে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন জানেন, চকলেটের মতো মিষ্টিদ্রব্যের সাথে দাঁতের শত্রুতার কথা। তাই জিনিসটি তার যতই প্রিয় হোক না কেন, তিনি একটি লাগাম পরাতে জানেন নিজের মুখে। অন্যদিকে শিশুরা এটা বোঝে না বলে অনেক বাচ্চাকাচ্চাই এর ফাঁদে পড়ে অল্প বয়সে তাদের দাঁতের ভয়াবহ ক্ষতি করে ফেলে।

ললিপপের কথাই ধরা যাক, যা অনেক শিশুই খুব পছন্দ করে। সাধারণ চকলেটের তুলনায় অনেক বেশি সময় ধরে মুখে রেখে চুষে খেতে হয় বলে এর আবেদনও হয়ে থাকে অন্যরকম। তবে এর ক্ষতিকর দিকও আছে। দাঁতের জন্য ক্ষতিকর ক্যান্ডিগুলোর মাঝে ললিপপ অবস্থান করছে তৃতীয় স্থানেই। এতে থাকা চিনির পরিমাণই শুধু নয়, সেই সাথে শক্ত এ ক্যান্ডিটি দীর্ঘ সময় ধরে মুখে রাখার ফলে এর চিনি দাঁতের এনামেলের ক্ষতি করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়, যার ফলে সৃষ্টি হয় দাঁতের ক্ষত।

Image Source: Ali Express

এজন্যই ছোটবেলায় যখন আমরা অতিরিক্ত বা ঘন ঘন চকলেট খেতে চাইতাম, তখন বাবা-মায়েরা আমাদের ভালোর জন্যই শাসন করে খেতে নিরুৎসাহিত করতেন, দেখাতেন ‘দাঁতের পোকা’ নামক অদেখা এক পোকার ভয়। আর সেই পোকার কথা শুনে আমাদের মনেও কিছুটা ভয় কাজ করতো বিধায় আমরাও চকলেট খাওয়ার চিন্তা কম করতাম। এভাবেই কেটে গেছে আমাদের অধিকাংশের শৈশব।

কিন্তু সবার পথে হাঁটেনি বাচ্চা একটি মেয়ে। তার অনুসন্ধিৎসু মনে জন্ম নিয়েছিল একগাদা প্রশ্ন, যেগুলোর উত্তর খুঁজে সমাধান বের করতে গিয়ে সে এমন একটি কাজ করে ফেলেছিল, যার জন্যই তাকে নিয়ে আজ লিখতে বসা।

বাবার সাথে ব্যাংকে গিয়েছিল সাত বছরের ছোট্ট অ্যালিনা মোর্স, সেটা আজ থেকে বছর ছয়েক আগের কথা। অমন সুন্দর একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখে ব্যাংকটির এক কর্মচারী তাকে একটি চকলেট দিতে চায়। কিন্তু তার বাবা টম মোর্স বিনয়ের সাথে সেটি ফিরিয়ে দিয়ে অ্যালিনাকে বলেছিলেন, “এটা খেলে তোমার দাঁতের ক্ষতি হবে”, ঠিক যেমনটা আমাদের বাবা-মায়েরাও এককালে বলতেন। কিন্তু মজার কথা হলো, বাবার এই নিষেধাজ্ঞা শুনে অ্যালিনা চকলেট খেলো না ঠিকই, কিন্তু উল্টো বাবাকে প্রশ্ন করে বসলো, তারা কেন এমন একটি ললিপপ বানাচ্ছে না, যেটা দাঁতের কোনো ক্ষতি করবে না। বিষয়টি যদি এমন হতো যে ক্ষণিকের জন্য তার মনে এমন চিন্তা এসেছে, তাহলেও কথা ছিলো। কিন্তু অনবরত বাবাকে একই প্রশ্ন করে পাগল করে তুললো অ্যালিনা। অবশেষে মেয়েকে হতাশ না করে তিনি পরামর্শ দিলেন বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য এবং দাঁতের ডাক্তারের সাথে আলাপ করে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ললিপপে কী কী উপাদান থাকতে পারে সেটা জানতে।

Image Source: The Virtuous Girl

টম হয়তো ভাবেননি যে, অ্যালিনা বিষয়টিকে এতটা গুরুত্বের সাথে নেবে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি ঠিকই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে নেয়, এবং দাঁতের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ললিপপ বানাতে কী উপাদান দরকার তা জানতে ডাক্তারদের কাছে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। বেশ কয়েকজন ডাক্তারই তাকে জাইলিটল (Xylitol) উপাদানটির কথা বলেন। মেয়ের এমন উৎসাহ দেখে টম নিজেও বসে থাকতে পারেননি। তিনি নিজেও কিছুটা খোঁজখবর নিয়ে এরাইথ্রিটল (Erythritol) সম্পর্কে জানতে পারেন, যে উপাদানটিও দাঁতের জন্য ভালো।

জাইলিটল দাঁতে খনিজ পদার্থের অভাব মেটায় এবং কোনো কিছু খাওয়ার পর মুখে যে অম্লীয় অবস্থা তৈরি হয় তা প্রশমনে সাহায্য করে (অম্লীয় অবস্থা দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে)। অপরদিকে এরাইথ্রিটল মুখের pH এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং দাঁতের জন্য এটি জাইলিটলের থেকেও বেশি উপকারী।

প্রয়োজনীয় উপাদান তো পাওয়া গেলো। এবার তাহলে দাঁতের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত চকলেট বানানোর মিশন শুরু হয়ে যাক। বিভিন্ন সময় দাদী-নানী গোত্রীয় মুরব্বীদের কাছ থেকে পাওয়া ডলার জমিয়ে রেখেছিলো অ্যালিনা, যা ততদিনে সাড়ে ৭ হাজার ডলারের মতো হয়ে গিয়েছিলো। সেই অর্থ বিনিয়োগ করেই নিজেদের বাড়ির রান্নাঘরে চকলেট বানাতে লেগে যায় অ্যালিনা। স্টেভিয়া (চিনির বিকল্প), জাইলিটল, এরাইথ্রিটল, খাবার রঙিন করার জন্য ব্যবহৃত প্রাকৃতিক রঙসহ দরকারি সবকিছুই কেনা হলো।

প্রথমবার উপাদানগুলো মিশিয়ে ছাঁচে ঢেলে চকলেট বানানো শুরু করেছিল অ্যালিনা। কিন্তু অনভিজ্ঞতার দরুন সেবার সেই মিশ্রণটি পুড়ে যায়। এরপর শুরু হলো মেয়েটির আসল গবেষণা। বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে মিশিয়ে চলতো তার চকলেট তৈরির মহাযজ্ঞ। একটা সময় গিয়ে সে বুঝতে পারলো, মিশ্রণটিকে ঘন করার জন্য কিছু দরকার। সাথে সাথে আবারও পড়াশোনা; এবার আসলো আইসোমল্টের (Isomalt) নাম।

Image Credit: Zollipops

চকলেট বানানোর ফর্মুলায় অ্যালিনা যখন নিজে সন্তুষ্ট হলো, এবং এর স্বাদটাও যখন ভালো মনে হলো, তখন তারা গেলো দুটো ক্যান্ডি প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে, যাতে এই ফর্মুলা ব্যবহার করে ফ্যাক্টরিতে চকলেট বানালে এর ফল কেমন হয় তা জানা যায়। দুটো ফ্যাক্টরিতে মোট ১৫ বার পরীক্ষামূলকভাবে চকলেট বানানো হয়েছিল। এখানেও বেশ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল অ্যালিনাকে। কারণ অধিকাংশ ফ্যাক্টরিই জাইলিটল নিয়ে কাজ করে না। আবার চকলেটগুলো যাতে কারো ফুড অ্যালার্জির কারণ না হয়, সেই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছিলো ছোট্ট এই মেয়েটিকেই। অবশেষে দীর্ঘ ১ বছর ধরে পরীক্ষানিরীক্ষার পরই চূড়ান্ত হয় তাদের চকলেট বানানোর রেসিপি।

কাঙ্ক্ষিত পণ্য তো বানানো হলো, এবার সেটি বিক্রি করা লাগবে। বাবা-মেয়ে মিলে এমন দোকানদারদের খুঁজতে লাগলো, যারা তাদের দোকানে দাঁতের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার রাখতে আগ্রহী। এভাবে একসময় তারা তাদের পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে জানাতে আমন্ত্রণ পায় হোল ফুডস মার্কেট (আমেরিকান সুপারমার্কেট চেইন) এবং মিডওয়েস্টের কাছ থেকে। চকলেটের নমুনা এবং প্রেজেন্টেশন নিয়ে শুরু হলো বাপ-মেয়ের ছোটাছুটি।

Image Credit: Zollipops

এর ছয় মাস পরের কথা। একদিন হুট করেই নিজের ইনবক্সে হোল ফুডস থেকে আসা একটি ইমেইল দেখতে পায় অ্যালিনা। সেখানে বলা হয়েছিলো, তারা অ্যালিনার ললিপপ নিয়ে আগ্রহী। প্রাথমিকভাবে তারা ৩৬ বাক্স চকলেট নিয়ে দেখতে চাচ্ছে, যেগুলো তাদের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া এবং হাওয়াই অঞ্চলের প্রতিটি দোকানএ রাখা হবে। টম ও অ্যালিনা দুজনই চাচ্ছিলো তাদের চকলেটগুলো যেন প্রাকৃতিক খাবারের সাথে রাখা হয়, আর হোল ফুডসও ঠিক সেটাই করেছিল। ফলে ৩৬ বাক্স চকলেট পাঠিয়ে তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো বিক্রি সন্তোষজনক হয়েছে কি না তা জানতে। আশ্চর্যজনকভাবে, চকলেটগুলো ক্রেতাদের মাঝে বিপুল সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। ফলে অল্পদিনের ভেতরেই হোল ফুডস কর্তৃপক্ষ আবারও চকলেট চেয়ে পাঠায়। ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার তাদের চকলেটগুলোর স্থান হয় একেবারে প্রথম সারিতেই।

হোল ফুডসের এই সাফল্যের ধারাকে কাজে লাগিয়ে আস্তে আস্তে অ্যালিনা ও তার বাবা অ্যামাজন, এইচইবি, মেজার, বিগ ওয়াই, জেট, বিভিন্ন ডেন্টিস্ট অফিস, টয়’স আর আস ইত্যাদি স্টোরে তাদের চকলেট পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। আজকের দিকে পুরো আমেরিকা জুড়ে ১০ হাজারেরও বেশি দোকানে শোভা পাচ্ছে অ্যালিনার জলিপপগুলো। উল্লেখ্য, নিজেদের তৈরি ললিপপের ব্র্যান্ডকে ‘জলিপপ’ নামই দিয়েছে অ্যালিনা।

Image Source: entrepreneur.com/David Yellen

এই সময়ে তাদের চকলেটগুলোও বেশ চমৎকারভাবে নিজেদের স্থান বদলেছে। শুরুর দিকে জলিপপগুলো বিক্রি করা হতো কেবল দাঁতের সমস্যায় আক্রান্ত বিভিন্ন রোগীর কাছে। তখন চকলেটগুলো টুথপেস্টের পাশে কিংবা বিভিন্ন ফার্মেসিতে শোভা পেত। আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন এগুলো ক্যাশ রেজিস্টার কিংবা দোকানের অন্যান্য সাধারণ চকলেটের সাথেই শোভা পায়। এ বছরের গ্রীষ্মে অ্যামাজনে জলিপপই ছিলো সর্বাধিক বিক্রিত চিনিমুক্ত ক্যান্ডি। আর ললিপপের হিসেবে ধরলে ছিলো দ্বিতীয় অবস্থানে।

নিয়মিত ক্রেতাদের মতামত গুরুত্বের সাথে নেয়া, বিভিন্ন ট্রেড শোতে অংশগ্রহণ, সেই সাথে নিত্যনতুন স্টোরের সাথে সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে বিক্রয়ের ক্ষেত্র বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো জলিপপের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে উল্লেখযোগ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে জলিপপ। সেই বছর মোট ৭০ হাজার ডলারের জলিপপ বিক্রি হয়েছিলো। ২০১৫ সালের শেষে এসে তাদের বিক্রিত জলিপপের সংখ্যা যেমন ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়, তেমনই সেই বছর বিক্রিও হয়েছিল ৩ লাখ ডলারের মতো জলিপপ। জলিপপ বিক্রি করে অর্জিত এই অর্থের পরিমাণ বিগত বছরগুলোতে ৩ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে তাদের আয় হয়েছিল ১০ লাখ ডলারের বেশি। আর এই বছর তাদের টার্গেট কত শুনবেন? ৫০-৬০ লাখ ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশের হিসেবে যা প্রায় ৪০-৫০ কোটি টাকা!

Image Source: entrepreneur.com/David Yellen

ভাবা যায়? অ্যালিনা মোর্স, যার বয়স কি না এখন মাত্র ১৩ বছর, সে-ই এখন একজন মাল্টি-মিলিয়নিয়ার!

অ্যালিনার বাবা-মাও এখন মেয়ের কোম্পানির সাথে যুক্ত। তার মা স্যু আছেন স্টাইলিস্ট ও শিডিউল ম্যানেজার হিসেবে। ওদিকে শুরুর সঙ্গী বাবা টম আছেন মেয়ের ম্যানেজার হিসেবেই। বাবা-মা দুজনের মতেই, তাদের মেয়ে আর আট-দশটা সাধারণ চাকরির স্বাদ কখনো পায়নি, যেখানে নানা ধরনের কঠোর নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে একজন চাকরিজীবিকে যেতে হয়। আর এই অনভিজ্ঞতাই মেয়েটির জন্য সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক দিক হিসেবে কাজ করেছে।

Image Source: entrepreneur.com/David Yellen

অর্থবিত্ত যতই থাকুক না কেন, অ্যালিনা কিন্তু তার পড়াশোনা ও বন্ধুবান্ধবদের সমানতালেই সামলাচ্ছে। যখন স্কুল চলে, তখন পড়াশোনা, নাচ, বাড়ির কাজ, নিজের ব্যবসাসহ সবকিছু একসাথেই দেখাশোনা করে মেয়েটি। কিন্তু যখন ছুটি পায়, তখন ব্যবসার কাজে অধিক মনোযোগী হবার সুযোগটা হাতছাড়া করে না সে। এভাবেই কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত জীবনের মাঝে ভারসাম্য রেখে রকেটের গতিতে ছুটে চলেছে এক কিশোরীর স্বপ্নগুলো, ছুটে চলেছে অনুসন্ধিৎসু মন থেকে জন্ম নেয়া তার মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।

This article is in Bangla language. It tells the story of Alina Morse, a 13 year old multi-millionaire. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: entrepreneur.com/David Yellen

Related Articles