Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আন্না হাজারে ও জন লোকপাল বিল: দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই (শেষ পর্ব)

জন লোকপাল বিল যদি আইনে পরিণত হতো, তাহলে তা সাধারণ মানুষকে কীভাবে সহায়তা করতো? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক এবার। ধরুন, ভারতের কোনো নাগরিক মামলা করতে গিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ সবকিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও মামলা নিচ্ছে না। কিংবা কোনো নাগরিক রেশন কার্ড বা পাসপোর্টের আবেদন করেছে, সরকারি অফিস থেকে তা সময়মতো দেওয়া হচ্ছে না। এই ধরনের কোনো সাধারণ সরকারি সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার হওয়া ব্যক্তি যদি লোকপালের কাছে আবেদন করে, তবে আইনানুযায়ী এক মাসের মধ্যেই তা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

এখন একটি বিষয় হচ্ছে, যদি এমন হয় যে দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের বাঁচাতে সরকার এমন সব লোকদের লোকপাল কমিটিতে নিয়োগ দিল যাদের আসলে তদন্ত পরিচালনা করার মতো সাহসই নেই? কিংবা তারা সরকারের অনুগত লোকজন? বাস্তবে এই ধরনের কিছু হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। কারণ জন লোকপাল আইনানুযায়ী, কোনো রাজনীতিবিদ বা সরকারি কর্মচারীর হাতে লোকপাল কমিটির সদস্য নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা থাকবে না। শুধুমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপ্রিমকোর্টের বিচারক, সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ ও নাগরিক প্রতিনিধিরা লোকপাল বা লোকযুক্ত কমিটির সদস্য নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা রাখবেন। সেই সাথে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, সদস্যদের একেবারে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

ততহজৃ
ভারতের দুর্নীতি সমস্যার বিরুদ্ধে এই আইনটি ছিল একেবারে মোক্ষম একটি আইন; image source: newsfirst.lk

এবার একটু অন্যদিকে যাওয়া যাক। যদি এমন হয়, লোকপাল বা লোকযুক্ত কমিটিতে থাকা কোনো সদস্য নিজেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেন? সেক্ষত্রে বিধান কী? এরকম কি হতে পারে না যে কোনো সদস্য দুর্নীতিবাজ কর্মচারীকে আইনের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নিলেন? আইনানুযায়ী, কোনো লোকপাল সদস্যের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ আসে, তবে দুই মাসের মধ্যে সেই অভিযোগের তদন্ত শেষ করতে হবে এবং অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত লোকপাল কমিটির সদস্যদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই, কারণ লোকপাল সদস্যদের প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হতো।

এই বিলের আগে কখনোই দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যেত না। কারণ একজন বিচারকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে গেলেও প্রধান বিচারপতির অনুমতি প্রার্থনা করতে হতো। কিন্তু এই বিলের মাধ্যমে লোকপাল বা লোকযুক্ত কমিটির সদস্যদের উপর কারও অনুমতি প্রার্থনা ছাড়াই অভিযোগ সাপেক্ষে তদন্ত পরিচালনা ও শাস্তির সুপারিশ করতে পারতো। অর্থাৎ বিচারকদের বিরুদ্ধেও এভাবে দুর্নীতি অভিযোগে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার এখতিয়ার স্বাধীন ভারতে আগে কখনও কারও ছিল না।

দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিবিআই ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকপালের ও লোকযুক্ত কমিটির অধীনে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল এই বিলে। এর ফলে যেকোনো রাজনীতিবিদ কিংবা সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারতো লোকপাল কিংবা লোকযুক্ত কমিটি। সিবিআইকে নিজে থেকে তদন্ত করতে বিভিন্ন বিভাগীয় বাধার সম্মুখীন হতে হতো, যেটি লোকপালের অধীনে গেলে আর হতো না। আর এই আইনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল যে, আগে যেখানে তদন্ত, বিচারকার্য পরিচালনা ও অন্যান্য গতানুগতিক কাজের জন্য বছরের পর বছর পার হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল, সেখানে এই আইনে বলা হয়েছিল যে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পর থেকে সমস্ত কিছু দুই বছরের মধ্যে শেষ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচারবিভাগের দীর্ঘসূত্রিতার যে সমস্যা এতদিন ধরে বিদ্যমান ছিল, তা এই আইনের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যেত।

তগহজকৃচচ
বেসামরিক প্রতিনিধিদের সাথে সরকারি প্রতিনিধিদের বৈঠকের চিত্র; image source: outlookindia.com

এবার ভারতের বহুল আলোচিত আন্না হাজারেকে নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণের পর এই মানুষটি গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। কিন্তু এই চাকরি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। স্বামী বিবেকানন্দের লেখাগুলো তাকে আকৃষ্ট করে এবং সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর স্থানীয় জনগণের উন্নয়নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন।

সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর তিনি তার গ্রামের উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেন। রেলগান সিদ্ধি নামের সেই গ্রামে অপরাধ, দারিদ্র্য, খরা, বেকারত্ব– এমন কোনো নাগরিক সমস্যা নেই যা ছিল না। প্রাথমিকভাবে তিনি পানি সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা চালান, প্রচুর বৃক্ষরোপণ করেন। তার এই প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখে। এরপর কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে তোলেন, বেকারত্ব শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পর তার নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করে। একেবারে সাধারণ একটি গ্রামকে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে আদর্শ গ্রামে পরিণত করার জন্য তার সুনাম মহারাষ্ট্র ছাড়িয়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মহারাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তারা সেই রাজ্যের অন্যান্য গ্রামেও আন্না হাজারের মতো প্রকল্প গ্রহণ করেন।

আতহজক্্ক
আন্না হাজারে ভারতের জাতীয় সংগ্রামে পা রাখার আগে আঞ্চলিক পর্যায়ে নিজেকে সফল প্রমাণ করেই এসেছিলেন;
image source: indiatoday.in

রেলগান সিদ্ধি গ্রাম নিয়ে যখন কাজ করতে শুরু করেন, তখনই দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে। তার বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগের জন্য সরকারের বিভিন্ন অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হতো এবং তিনি তখন দুর্নীতির কালো থাবা সম্পর্কে ধারণা পান। মহারাষ্ট্রের অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির প্রতিবাদে তিনি ‘পিপলস মুভমেন্ট অ্যাগেইনস্ট করাপশন’ নামে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু যথারীতি সরকারে তার দাবিদাওয়ার প্রতি উদাসীন থাকায় তিনি আমৃত্যু অনশনের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাপক জনরোষের মুখে সরকার হাজারের দাবিগুলো মেনে নিতে বাধ্য হয়, শতাধিক সরকারি কর্মচারী দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হন। ২০০৩ সালে তথ্য অধিকার আইনের দাবিতে তিনি আবার অনশন শুরু করেন। বারো দিন অনশনের পর সরকার তার দাবি মেনে নেয়, ভারতের প্রথম তথ্য অধিকার আইন (২০০৩) পাশ হয় মহারাষ্ট্রে এবং পরবর্তীতে এই আইনের অনুসরণে পুরো ভারতের জন্য পার্লামেন্টে তথ্য অধিকার আইন পাশ হয়। এসব ঘটনা তার জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।

২০১১ সালের দিকে জন লোকপাল বিলকে আইনে পরিণত করার জন্য তিনি আবার আন্দোলন শুরু করেন। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী তার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসলে সরকার বাধ্য হয় বিলটি পার্লামেন্টে পাশ করতে। প্রাথমিকভাবে সরকার পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে পরবর্তীতে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো অনশনে বসার হুমকি দেন। তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ভারতের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন চরম মাত্রা লাভ করে। অবশেষে সরকার পার্লামেন্টে জরুরি সেশন ডেকে তার মৌলিক দাবিগুলো মেনে নেয়। ২০১৩ সালে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই বিল দুই কক্ষেই পাশ হয়।

তগজককক
মহাত্মা গান্ধী ঘরানার নেতা হওয়ার কারণে তার আলাদা খ্যাতি রয়েছে; image source: rediff.com

ভারতবাসী দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ করার জন্য নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না। আঞ্চলিক পর্যায়ে সফলতা পাওয়ার পর জাতীয় পর্যায়েও আন্না হাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, যা ভারতের বিশাল মধ্যবিত্ত জনগণকে রাস্তায় নেমে আসতে নৈতিকভাবে বাধ্য করে। সরকার প্রথমদিকে নিজেদের সুবিধা মতো খসড়া প্রণয়ন করলেও পরবর্তীতে আন্না হাজারের প্রবল প্রতিবাদের মুখে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।

সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ গাড়িচালক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র হয়ে ওঠা– আন্না হাজারের উত্থান অবশ্যই মনে রাখার মতো। তার ও ভারতের সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত জন লোকপাল আইন যে ভারতের দুর্নীতি সমস্যা রুখে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে– এটা বোধহয় নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।

Related Articles