আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম কৃত্রিম মানবিক সংকট হলো ফিলিস্তিন সমস্যা। প্রায় সত্তর বছরেরও অধিক সময় ধরে একটি জাতিকে (ফিলিস্তিন) তার ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর এই সংকটের মূলে রয়েছে জায়নিজম বা ইহুদিবাদ। পৃথিবীতে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা খুবই কম। উপরন্তু তারা কোনো একক জায়গার পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। ফলে বিশ্বে ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো দেশ নেই। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে কতিপয় ইউরোপীয় ইহুদিদের মধ্যে জায়নিজমের বিস্তার ঘটতে থাকে। জায়নিস্টদের মতে, ইহুদি একটি ধর্মের পাশাপাশি জাতিগত পরিচয়ও। জায়নিস্টরা বিশ্বাস করে যে, ফরাসি কিংবা জার্মান ও অন্যান্য জাতির যেমন যথাক্রমে ফ্রান্স ও জার্মানির মতো নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রয়োজন তেমনি ইহুদিদেরও তাদের পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি ইসরায়েলে তাদের নিজস্ব দেশ গঠনের অধিকার রয়েছে। জায়নিস্টদের দাবি ছিল ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত জায়গাটি ইহুদিদের ঐতিহাসিক বাসভূমি, এবং এখানে ইহুদিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দিতে হবে।
১৮৯৬ সালে, এক অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক থিওডোর হার্জেল তার প্রকাশিত "দ্যা জুইশ স্টেইট" বইয়ের মাধ্যমে ইহুদিদের এই ইচ্ছাকে আন্তর্জাতিক আন্দোলনে রূপ দেন। ইউরোপে ক্রমবর্ধমান ইহুদিবিদ্বেষের প্রেক্ষিতে হার্জেল উপলব্ধি করেন যে, ইহুদিরা একটি নিজস্ব রাষ্ট্র ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না। এজন্য তিনি ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গঠনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকেন। তার বিভিন্ন প্রবন্ধ ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডের ফলে ইউরোপীয় ইহুদিদের মধ্যে জায়নিজমের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জায়নিজমের বিভিন্ন ফেডারেশন গড়ে উঠতে থাকে। তারা ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা শুরু করে। তখন থেকেই ইউরোপ থেকে ইহুদিরা ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনের দিকে আসতে থাকে। জায়নিজমের বিস্তারের সাথে সাথে এই সংখ্যাও অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
১৮৮৩ সালে ২৫ হাজার ইহুদি রাশিয়া থেকে ফিলিস্তিনে আসে। এটি ছিল ফিলিস্তিন অভিমুখে ইহুদি অভিবাসীদের প্রথম স্রোত। এই সময়ই পারস্য ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইহুদি জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনে আসে।
থিওডোর হার্জেল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের কাছে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচারণা চালান। সেই সময় অনেক ইহুদিও জায়নিজমের বিরোধীতা করতো। কিন্তু হার্জেল ইউরোপীয় ক্ষমতাসীন ইহুদিদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হন। তার প্রচেষ্টায় ইউরোপে অনেকগুলো জায়নিস্ট সংগঠন গড়ে ওঠে। ইউরোপীয় দেশগুলোর বিভিন্ন জায়নিস্ট সংগঠন জায়নিজম ও ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন আদায়ে সেই দেশগুলোর প্রশাসনে শক্তিশালী লবি গঠন করে। ইউরোপে ইহুদিরা অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে থাকায় তাদের এই প্রচেষ্টা সহজেই সফল হয়। যুক্তরাজ্যে ও ইউরোপব্যপি রথসচাইল্ড পরিবারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছে।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালিন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর যুক্তরাজ্যের ইহুদি কমিউনিটির নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে এক চিঠি লিখেন এবং এই চিঠিটি যুক্তরাজ্যের জায়নিস্ট ফেডারেশনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান। একেই ঐতিহাসিক বেলফোর ডিক্লারেশন বা বেলফোর ঘোষণা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৯১৭ সালের ৯ এপ্রিল বেলফোর ঘোষণাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মূল ঘোষণাটি ছিল মাত্র ৬৭ শব্দের। এই ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদিদের জন্য একটি "জাতীয় আবাসভূমি" প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সেইসঙ্গে বলা হয় যে, সেখানে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসমূহের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হবে না। বেলফোর ঘোষণার ভাষা খুবই অস্পষ্ট। ধারণা করা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবেই এর ভাষাকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছিল। এতে স্পষ্ট করে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়নি বরং "জাতীয় আবাসভূমি" শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়েই প্রথম ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
মূল ঘোষণাটির বঙ্গানুবাদ এইরকম,
"মহান সরকার ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে এবং এ উদ্দেশ্য পূরণে তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যবহার করবে, এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, এমন কিছু করা হবে না যার ফলে ফিলিস্তিনে অবস্থানরত অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার অথবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিরা যে অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে, তার কোনো হানি হয়।"
তবে ব্রিটিশ প্রশাসন থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের এই সমর্থন আদায় খুব সহজ ছিল না। কয়েক দশকের নানান পরিকল্পনার আর শক্তিশালী লবির মাধ্যমে এই স্বীকৃতি আদায় করা হয়। এটি ইহুদিদের প্রতি শুধু সমবেদনা নয়, এতে ব্রিটিশ প্রশাসনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত ছিল। অনেকগুলো কারণ বিবেচনায় ব্রিটিশ প্রশাসন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়।
সর্বপ্রথম যখন ইহুদিরা একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা প্রকাশ করে তখন ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিন ছাড়া আরো অনেকগুলো জায়গায় বসতি স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। আলাস্কা, অ্যাঙ্গোলা, লিবিয়া, ইরাক, দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনাসহ অন্তত ৩৪টি ভিন্ন ভিন্ন স্থানের পরিকল্পনা আলোচিত হয়। এমনকি ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া উগান্ডায় ইহুদি বসতি স্থাপনের প্রস্তাব থিওডোর হার্জেলসহ অনেক ইহুদি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েকজনের প্রচেষ্টায় এই প্রস্তাব বাতিল করা হয়।
বেলফোর ঘোষণা বা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি সেই মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম একজন হলেন ড. চেইম ওয়াইজম্যান। তিনি ছিলেন একজন রসায়নবিদ। রুশ বংশোদ্ভূত ওয়াইজম্যান জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে পড়াশোনার পর রাশিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে চলে যান। অত্যন্ত মেধাবী ওয়াইজম্যান সেখানে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। সেসময় ওয়াইজম্যান জায়নিজমের প্রচারণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর ওয়াইজম্যানকে দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি করা হয়। ১৯০৬ সালে একবার ওয়াইজম্যান ও বেলফোরের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথোপকথন হয়েছিল। সেদিন ওয়াইজম্যান, ১৯০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বেলফোরের জায়নবাদীদের উগান্ডা দেওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে কথা বলেন। উগান্ডায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে ওয়াইজম্যান বলেন,
ধরুন মিস্টার বেলফোর আমি আপনাকে লন্ডনের বদলে সাসকাচোয়ানে (কানাডার একটি প্রদেশ) থাকার প্রস্তাব করছি, আপনি কি তা নেবেন? বেলফোর বলেন, ব্রিটিশদের লন্ডন আছে। তখন ওয়াইজম্যান জবাব দিলেন, ঠিক বলেছেন, আমরাও জেরুজালেমে বাস করতাম, তখন লন্ডন ছিল জলাভূমি।
তাদের এই আলোচনা ফলপ্রসূ না হলেও এটি ছিল কোনো শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সাথে ওয়াইজম্যানের প্রথম আলোচনা। পরবর্তীতে ওয়াইজম্যান ব্রিটিশ ইহুদি কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওয়াইজম্যান ব্রিটিশদের পক্ষে বিজ্ঞানী হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখেন। ধারণা করা হয়, যুদ্ধে ওয়াইজম্যানের অবদানের কৃতজ্ঞতাসরূপ ইহুদিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ সদয় হয়েছিলেন।
ইহুদিদের অর্থনৈতিক সাফল্য ও মেধা অনেক ব্রিটিশ প্রশাসকদের সম্মোহিত করে। রথসচাইল্ডের মতো ইহুদি পুঁজিপতিদের কিংবদন্তিসম সম্পদ, অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রাসাদ ও আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে অনেক উচ্চশ্রেণীর ইউরোপীয় বিস্মিত হতো। ইহুদিদের এই প্রভাব উচ্চপদস্থ ইউরোপীয়দের মধ্যে জায়নিজমের প্রতি সমর্থন আদায়ে অবদান রাখে। এছাড়া যুদ্ধকালীন রাশিয়ায় ইহুদিদের উপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় দুর্দশাগ্রস্ত ইহুদিদের প্রতি ব্রিটিশ নেতাদের সহানুভূতি সৃষ্টি হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনো চলমান। মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে জার্মান ও অটোমানদের সাথে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের চুড়ান্ত লড়াই চলছে। এমতাবস্থায় ব্রিটিশরা জানতে পারে যে, জার্মানরা তাদের নিজস্ব জায়নবাদী পরিকল্পনা প্রকাশের কথা ভাবছে। জায়নিজম ছিল মূলত একটি জার্মানভিত্তিক ধারণা। অনেক বছর পর্যন্ত বার্লিনকে কেন্দ্র করে জায়নিস্টদের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। ফলে জার্মানিতে জায়নবাদীদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রভাব ছিল। এমনকি কয়েকজন অটোমান প্রশাসকও ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের পক্ষে অবস্থান নেয়। অটোমান সামরিক নেতা জামাল পাশা ১৯১৭ সালে বার্লিন সফরকালে জার্মান জায়নবাদীদের সাথে সাক্ষাত করেন। অটোমান প্রধানমন্ত্রী তালাত পাশাও ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনে রাজি হয়েছিলেন। জার্মান ও অটোমানদের জায়নিজমের প্রতি সমর্থনের খবরে ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হয়ে উঠে।
ব্রিটিশরা আশঙ্কা করছিল যে জার্মান ও অটোমানরা বিশ্বের ইহুদিদের সমর্থন লাভ করে ফেলবে। আর ইহুদিরা জার্মান ও অটোমানদের সহযোগিতা করলে যুক্তরাজ্য যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে না। ফলে বিশ্বের ইহুদিদের বন্ধুত্ব যুক্তরাজ্যের জন্য অপরিহার্য ছিল। ইহুদিরা যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে গেলে তাদের যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশদের সফলতার পেছনে ইহুদিদের অবদানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে বিশেষ করে লয়েড জর্জ ও বেলফোরের মধ্যে ধারণা জন্মায় যে, যুক্তরাজ্যকে যুদ্ধে জয় পেতে জায়নবাদীদের সহযোগিতা অপরিহার্য। এ সময় ব্রিটিশ প্রশাসনের অনেকেই জায়নিস্ট হয়ে উঠেন। মূলত এই কারণেই ব্রিটিশ প্রশাসন জায়নবাদীদের প্রতি সমর্থন প্রদানে উদগ্রীব হয়ে উঠে।
মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে এবং সুয়েজ খালে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সেখানে একটি ব্রিটিশ অনুগত রাষ্ট্র প্রয়োজন ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে কিছুদিন আগে অথবা পরে তাদেরকে ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা দিতেই হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনে যদি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে সেখানকার ভূরাজনীতিতে ব্রিটিশ আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখা যাবে এই বিবেচনায় ব্রিটিশ প্রশাসন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়।
তারপরও মন্ত্রীসভায় এ নিয়ে দ্বিমত তৈরি হয়। এমনকি ভারতসচিব অ্যাডউইন মন্টেগু এবং গোল্ডস্মিথ মন্টেফিওরির মতো আরো অনেক ইহুদি প্রথমদিকে এর বিরোধিতা করেন। মন্টেগু বলেন, এতে ইহুদিবিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের সাবেক ভাইসরয় ও হাউজ অব লর্ডসের নেতা লর্ড কার্জন এর বিরোধিতা করে স্থানীয় জনগণের কী হবে বলে জানতে চান। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ বলেন আরবদের চেয়ে ইহুদিরা আমাদের বেশি সাহায্য করতে পারবে।
এমন বিরোধীতার সম্মুখীন হওয়া স্বত্বেও ওয়াইজম্যান প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। এরপর তিনি রথসচাইল্ড ও মন্টেফিওরি সহ শীর্ষস্থানীয় ব্রিটিশ ইহুদিদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করে শেষ পর্যন্ত তাদের সমর্থন আদায়ে সফল হন। ব্রিটিশ ইহুদিদের মুকুটহীন সম্রাট লর্ড লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের সমর্থন লাভ ইহুদি রাষ্ট্র তৈরির পথকে প্রশস্ত করে। লয়েড জর্জ ও বেলফোর তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। বেলফোর, চেইম ওয়াইজম্যান ও লর্ড রথসচাইল্ডকে ঘোষণার খসড়া প্রণয়ন করতে বলেন। বেলফোরের অনুরোধে ইহুদিদের স্বার্থের সঙ্গে মানানসই একটি খসড়া ঘোষণা লিখেছিলেন ওয়াইজম্যান ও রথসচাইল্ড। কিছুদিন পরেই ঘোষণাটি চুড়ান্ত করা হয় এবং ২ নভেম্বর বেলফোরের কাছ থেকে রথসচাইল্ডের কাছে পাঠানো হয় এবং চিঠিটি জায়নিস্ট ফেডারেশনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এই ঘোষণার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ প্রশাসন ইহুদি রাষ্ট্র তৈরির জন্য যা যা করার সব করতে থাকে। এরপর থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসী আসার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। ১৯৩৫ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়।
বেলফোর ঘোষণা ছিল আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর একটি। ঘোষণাটি বিতর্কিত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, ইউরোপের বাইরের একটি এলাকার বিষয়ে ইউরোপীয় একটি শক্তি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। উক্ত এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর উপস্থিতি এবং ইচ্ছা বৃহৎ আকারে উপেক্ষিত হয়েছিল। এছাড়া এই ঘোষণা এমন একটি জায়গায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয় যেখানে দশ শতাংশেরও কম ইহুদি বসবাস করে। উপরন্তু যে অঞ্চলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেটি তখনো অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না।
বেলফোর ঘোষণার আগে ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশরা অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আরবদের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বেলফোর ঘোষণার অর্থ ছিল, ফিলিস্তিন ব্রিটিশ দখলদারিত্বের অধীনে চলে আসবে এবং ফিলিস্তিনি আরবরা কখনোই স্বাধীনতা পাবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আর্থার বেলফোর ১৯২৫ সালে ফিলিস্তিন সফর করেছিলেন। তখন সেখানকার ইহুদি অধিবাসীরা তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়। শেষ পর্যন্ত এই ঘোষণার ৩১ বছরের মাথায় পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমিতে জোরপূর্বক ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করা হয়। ইসরায়েলিরা বেলফোর ঘোষণাকে তাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখে। তারা বেলফোর ঘোষণাকে ইসরায়েল গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিন ও আরবদের কাছে এটি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হয়। মাত্র ৬৭ শব্দের মূল চিঠিটি একটি জাতির স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল। চিঠিটি খুব ছোট হলেও এটি ইতিহাসের এক দীর্ঘকালীন মানবিক সংকটের প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল। এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের ওই অঞ্চলটির ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। বেলফোর ঘোষণাই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল জাতিগত সংঘাতের সূচনা ঘটায়।
This article is in bangla language. It's about Balfour Declaration of 1917 that promised to make Jewish state in Palestine by British government.
References:
Image source: prc.org.uk