Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্যারিস্টার আমাল ক্লুনি: সময়ের এক লড়াকু আইনজীবী

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, দেবী দুর্গা শক্তির মাতৃরূপ। তিনি দুর্গতি নাশ করেন, তাই তিনি দুর্গতিনাশিনী। আমাদের বাস্তব দুনিয়ায়, আসলেই কি কেউ এমন দুর্গতিনাশিনীর গুণে গুণান্বিত হয়ে উঠতে পারেন? অসুরদের বিরুদ্ধে স্বর্গের দেবতাদের লড়াইয়ের মতোই ধূলো-মাটি-কাদার এই পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নিয়ে কি কেউ লড়াই করে যেতে পারেন- নিতান্তই একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে?

পারেন। এমনই একজন রক্ত-মাংসের মানুষের কথা আজ আমরা বলব। তার নাম আমাল ক্লুনি।

আমাল রামজি আলামুদ্দিন ক্লুনি ১৯৭৮ এর ৩ ফেব্রুয়ারি লেবাননের বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ও একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক। আর মা ছিলেন একজন সাংবাদিক। তিনি জন্মসূত্রে আরব। তার বাবা রামজি আলামুদ্দিন একজন আরব দ্রুজ, দ্রুজরা মধ্যপ্রাচ্যের একটি একেশ্বরবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়। তার মা বারিয়া মিকনাস আরব সুন্নি মুসলমান। আমাল আরবি শব্দ, এর মানে হচ্ছে ‘আশা।’

আমাল ক্লুনি; Image Source: Business Wire

সত্তরের দশক থেকেই লেবাননে একটি গৃহযুদ্ধ চলছিল। আমালের বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখন তার বাবা-মা তাকে নিয়ে লেবাননে থেকে পালিয়ে যান। ১৯৮০-তে, আমালের নতুন ঠিকানা হয় যুক্তরাজ্যের লন্ডন।

মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে, ১৯৯৬ এর শুরুর দিকে, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি পান। সেখানেই মানবাধিকারের ব্যাপারে তার আগ্রহ জন্মে। ২০০০ সালে তিনি আইনে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর আমাল নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল স্কুলে মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে ভর্তি হন। ২০০২ এ তার পড়াশোনা শেষ হয়। তিনি সেবছরই যোগ দেন নিউ ইয়র্ক স্টেট বারে।

বার পাশ করার পরে আলামুদ্দিন নিউ ইয়র্ক সিটি-ভিত্তিক সুলিভান অ্যান্ড ক্রমওয়েলে যোগদান করেন, যেটি পৃথিবী বিখ্যাত আইনী ফার্মগুলোর একটি। সেখানে তিনি কিছুদিন আইনচর্চা করেন। এর ডিফেন্স গ্রুপের সদস্য হিসেবে, আদালতে এনরন এবং আর্থার অ্যান্ডারসনের মতো নামজাদা ক্লায়েন্টদের পক্ষে লড়েন, যখন তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তদন্ত চলছিল।

আইনী দুনিয়ায় আমাল ক্লুনি এখন অন্যতম বিখ্যাত নাম; Image Source: AP Photo/Christian Lutz

২০০৫ সালে আমালের ক্যারিয়ারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে। সেবছর তিনি লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরকে প্রসিকিউট করতে জাতিসংঘ যে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করেছিল, তার অংশ হন। এসময় থেকেই ক্লুনি আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

২০১০ এ আমাল লন্ডনে ফিরে আসেন ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সের জন্য একজন ব্যারিস্টার হিসেবে কাজ করতে। তিনি পাবলিক আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, এবং মানবাধিকার নিয়ে বিশেষ পড়াশোনা করেন। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় আদালত ছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) এবং মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপিয়ান আদালতে তার মক্কেলদের পক্ষে আইনী লড়াই লড়েছেন। চেম্বার্স অ্যান্ড পার্টনারস লিগ্যাল ফাইভহান্ড্রেড এর মতো শীর্ষস্থানীয় আইনী ডিরেকটরিগুলো তাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রধান আইনজীবী হিসেবে উল্লেখ করেছে। আমাল ইংরেজি, ফরাসি ও আরবি- এই তিনটি ভাষা জানেন।

২০১৪ সালে তিনি মার্কিন অভিনেতা জর্জ ক্লুনিকে বিয়ে করেন, স্বামীর পদবি গ্রহণ করায়, তার নতুন নাম হয় আমাল ক্লুনি। পারিবারিক জীবনে তিনি দুই সন্তানের জননী। তার মেয়ের নাম এলা, ছেলের নাম আলেক্সান্দার।

আমাল ক্লুনি ও জর্জ ক্লুনি; Image Source: Getty Images

কলাম্বিয়া ল স্কুলে আমাল একজন ভিজিটিং প্রফেসর, এছাড়াও জীবনের বিভিন্ন সময় পড়িয়েছেন লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস, সোয়াস, নিউ স্কুল, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা ইত্যাদিতে।

এটুকু পড়ে পাঠক ভাবতে পারেন, হতে পারে তিনি অ্যাকাডেমিক বিষয়ে মেধাবী মানুষ, হতে পারে নিজের জায়গায় তিনি অত্যন্ত দক্ষ; কিন্তু তাকে সময়ের এক দুর্গতিনাশিনীর শক্তিতে বলীয়ান মানুষরূপে কেন দেখা যেতে পারে? ভালো আইনজীবী তো ইতিহাসে অনেকেই ছিলেন, এখনো আছেন; আমাল ক্লুনির কী এমন বিশেষত্ব!

সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে তার ক্যারিয়ারের দিকে তাকাতে হবে।

কসভো, ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের দায়ে স্লোবোদান মিলোসেভিচের যে বিচার হয়েছিল, তাতে আমাল বিচারক প্যাট্রিক রবিনসনের জুডিশিয়াল অ্যাসিসেন্ট ছিলেন।

আর্মেনীয় গণহত্যা অস্বীকার করার দায়ে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালতে আর্মেনিয়া যখন তুরস্কের বিরুদ্ধে মামলা করে, তিনি তাতে আর্মেনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন।

আর্মেনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন জিওফ্রে রবার্টসন এবং আমাল ক্লুনি; Image Source: AFP

সুইডেন বনাম অ্যাসাঞ্জ মামলায় আমাল উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করেন, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো গুরুতর অভিযোগ থাকলেও, জাতিসংঘের একটি দক্ষ প্যানেল ২০১৫ সালে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, যুক্তরাজ্য ও সুইডেন তাকে জবরদস্তিমূলকভাবে আটক করে রেখেছে।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করেন আমাল ক্লুনি; Image Source: John Phillips/Getty Images

তার শেষ দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা জানা যাক।

রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক, ওয়া লোন এবং ক্যায়াও সো উ, রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতন নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলেন। তাই মিয়ানমার রাষ্ট্র তাদেরকে জেলে পুরে রেখেছে, তাদেরকে ৭ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমাল এই দুই সাংবাদিকের জন্যও আইনীভাবে লড়ছেন

২০১৮ সালে শান্তিতে যে দুজন যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের একজন নাদিয়া মুরাদ, এই খবরটি ইতোমধ্যেই সবার জানা। যেটা অনেকেই জানেন না, সেটা হচ্ছে, নাদিয়ার মতো যেসব ইয়াজিদি নারী তথাকথিত ইসলামিস্ট স্টেটের (আইএস) জিহাদিদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছিলেন, তাদের জন্য ন্যায়বিচার আদায় করতে অক্লান্তভাবে লড়ছেন ব্যারিস্টার আমাল ক্লুনি। তিনি বিরতিহীনভাবে দেখা করেছেন ইরাক সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সাথে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে এবং সর্বোপরি আইএসের ভিকটিমদের সাথে। তার কাজের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে এবং যার ফলে ইরাকে ইসলামিক স্টেটের করা অন্যায়সমূহের প্রমাণ সংগ্রহ করতে একটি তদন্ত দল তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে যেদিন এই প্রস্তাব পাশ হয়, সেদিন নাদিয়া আর আমাল পাশাপাশি বসে ছিলেন। প্রস্তাবের পক্ষে সবগুলো হাত উঠতে দেখে তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন। এটি ছিল নিপীড়িত ইয়াজিদি নারীদের জন্য এক বড় বিজয়, যদিও এখনও আসল কাজটা বাকি রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে আইএসের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা।

জাতিসংঘের সদরদপ্তরে একটি সম্মেলনে আমাল ক্লুনি Image © Reuters

২০১৭ সালে টিম দুগান বুকস-কর্তৃক পাবলিশড হয় নাদিয়া মুরাদের দ্য লাস্ট গার্ল: মাই স্টোরি অফ ক্যাপটিভিটি, অ্যান্ড মাই ফাইট অ্যাগেইনস্ট দি ইসলামিক স্টেট। এই বইটির ভূমিকা লেখেন আমাল ক্লুনি। সেখানে তিনি বলেন,

একজন মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে, প্রায়শই আমার কাজ তাদেরকে ভাষা দেওয়া, যাদেরকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে: জেলে পচে মরছেন যে সাংবাদিক বা যুদ্ধাপরাধের সেইসব ভিকটিম, যারা আদালতে নিজেদের জন্য ন্যায়বিচার পেতে লড়ছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই আইএস নাদিয়াকে চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছে, যখন তারা তাকে অপহরণ করেছিল এবং দাস বানিয়েছিল, তাকে ধর্ষণ করেছিল এবং অত্যাচার করেছিল তার ওপরে, এবং একই দিনে তার পরিবারের সাতজন সদস্যকে খুন করেছিল। কিন্তু নাদিয়া চুপ হয়ে যেতে অস্বীকার করেছেন। জীবন তার গায়ে যেসব লেবেল এঁটে দিতে চেয়েছে তিনি তার সবগুলোই অস্বীকার করেছেন: অনাথ-ধর্ষিতা-দাস-শরণার্থী। এসবের জায়গায় তিনি তৈরি করেছেন নতুন পরিচয়: সার্ভাইভার। ইয়াজিদি নেতা। নারী অধিকারকর্মী। নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়নপ্রাপ্ত। জাতিসংঘের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর। এবং এখন, একজন লেখক।

মল্লিকা সেনগুপ্তর কন্যাশ্লোক নামে একটি কবিতা আছে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, নর্মদা বাচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটেকর, বা গুজরাট গণহত্যার ভিকটিমদের জন্য আইনী লড়াই চালানো তিস্তা সেতলাবাদরাই তার দুর্গা।

এই অর্থে আমালকে নিশ্চয়ই দুর্গতিনাশিনী রূপে দেখাই যায়?

Featured Image Source: The Independent

Related Articles