Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উসমানীয় যুগের পাখির বাসা: মমতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক

তুরস্কের উসমানীয় যুগের বিস্তৃতি প্রায় ৬০০ বছরের (১২৯৯ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ)। এ সময় বিস্তৃত এ রাষ্ট্রজুড়ে নানাবিধ উন্নতি হয়। তাদের দালানকোঠা, রাজপ্রাসাদের স্থাপত্যশৈলী আজও মানুষের কাছে বিস্ময়। নৈতিকতায়ও উসমানীয়রা উন্নত চরিত্রের ছিলেন। স্রষ্টার অনুগত হওয়ার পাশাপাশি সৃষ্টির সেবাকে তারা দায়িত্ব মনে করতেন। সেই বোধ থেকে তারা নানা প্রশংসনীয় কর্ম করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ‘পাখির বাসা’ তৈরি।

পাখির প্রতি মমতাবোধ থেকে তারা নিজেদের বাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিদ্যালয়, অফিস, কফিহাউজ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ের দেয়ালে কৃত্রিমভাবে সুদৃশ্য পাখির বাসা বানিয়ে রাখতেন। উদ্দেশ্য- পাখিরা যেন বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় পায় এবং একই সঙ্গে সেখানে ডিম পাড়তে ও বাচ্চাদের লালন-পালন করতে পারে।

Image Courtesy: aa.com.tr

শুধু তা-ই নয়, প্রাচীনকাল থেকেই তুর্কিরা সৃষ্টির সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখাকে পরম্পরা মনে করতেন। আশেপাশে আনাগোনা করা প্রাণী ও পাখির জন্য তৈরিকৃত এসব বাসায় তারা নিয়ম করে খাদ্য ও পানীয় রেখে দিতেন, তাদের সুরক্ষার প্রতি খেয়াল রাখতেন। আদি তুর্কিরা আজও তাদের পূর্ববর্তীদের রীতি মেনে চলেন। কোনো তুর্কি শহরের রাস্তা ও গলিতে যদি আপনি হাঁটেন, তাহলে এখনও সেখানের ফুটপাত, গাছের ডাল ও ভবনের দেয়ালে পশু-পাখিদের জন্য খাবার ও পানি রাখার রকমারি পাত্র দেখতে পাবেন। সৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধের এই ধারা ও মহৎ কর্মের প্রতি গুরুত্বারোপ করে উসমানীয় সুফি কবি ইউনুস এমরের কবিতা ‘স্রষ্টার জন্যই সৃষ্টিকে ভালবাসি আমরা’। তার মতে, আনাতোলিয়ানদের সৃষ্টি করা হয়েছে পশু-পাখিদের প্রতি ভালবাসা, মমতা ও যত্নের জন্য।

প্রচলিত প্রাণী অধিকার সংক্রান্ত বিশেষ আইন প্রণয়নের বহু শতাব্দী আগেই উসমানীয় তুর্কিরা পশু-পাখির যত্ন ও সুরক্ষার জন্য অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। বিশেষত, প্রাকৃতিকভাবেই সংবেদনশীল ছোট্ট পাখিগুলোর প্রতি তাদের দয়া-মায়া পৃথিবীতে এক নবশিল্পের সূচনা করেছে; পাখিদের জন্য তারা তৈরি করেছে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত ও সৌকর্যময় অসংখ্য পাখির বাসা, যা এখনো প্রাচীন ইমারত ও ভবনসমূহের দেয়ালে কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। এগুলো স্থাপত্য ও নির্মাণশিল্পে উসমানীয়দের উন্নত রুচি ও গভীর দক্ষতার জানান দেয়। বয়সের ভারে জীর্ণ হয়ে পড়া কিছু বাসায় মেরামতের চিহ্নও দেখা যায়।

Image Courtesy: trtarabi.com

কৃত্রিম উপায়ে নির্মিত এসব বাসাকে তুর্কিরা আরবিতে ‘কুসুরুত তুয়ুর’ (পঙ্খী-প্রাসাদ) এবং ‘ মানাঝিলুল আসাফির’ (চড়ুই নিবাস) নামে ডাকে। উসমানীয় আমলে ষোড়শ শতাব্দী থেকে এর প্রচলন শুরু হয় এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ‘বাসা তৈরি’ শিল্প পূর্ণতা পায়। তখন থেকে যেখানেই তুর্কিরা নিবাস পেতেছে,সেখানেই সুরম্য দালানকোঠা, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ প্রায় সব জায়গাতেই ইট-পাথরে তৈরি এসব বাসা নজরে পড়ত। তবে দুর্ভাগ্যবশত কাঠের তৈরি বাসাগুলো বর্তমান পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি, ধসে পড়েছে।

উসমানীয় আমলের প্রাচীন বাসাগুলোর মধ্যে ষোড়শ শতকে তৈরিকৃত ইস্তাম্বুলের বালি পাশা মসজিদের দেয়ালের বাসা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা ১৫০৪ সালে স্থাপন করা হয়। তাছাড়া, শহরের সাইয়েদ হাসান পাশা মাদ্রাসার দেয়ালের বাসাগুলোও একই সময়ের বলে ধারণা করা হয়। একইসঙ্গে প্রাচীনতার দিক থেকে সুলতান তৃতীয় মুস্তফার সমাধি, সুলাইমানিয়া মসজিদ, এশীয় অঞ্চলের প্রাচীন দুটি মসজিদ, তোপকাপি প্রাসাদ, ঐতিহাসিক তাকসিম স্কয়ার, মসজিদ আইয়ুব সুলতান এবং ইহুদী ও খ্রিস্টানদের একাধিক উপাসনালয়ের দেয়ালে দৃশ্যমান বাসাগুলোও উল্লেখের দাবি রাখে।

ইট-পাথরে নির্মিত এসব বাসায় শুধু নান্দনিকতা ও চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর বিষয়ই বিবেচনা করা হয়নি, বরং তা নির্মাণে আরো কিছু সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মাঝে অন্যতম হলো ভবনের বা দেয়ালের সম্ভাব্য এমন উঁচু স্থানে বাসা স্থাপন করা হতো যেখানে হিংস্র কোনো প্রাণী হানা দিতে পারে না। একইসঙ্গে রোদ-বৃষ্টির সুষম প্রাপ্তির পাশাপাশি মৌসুমী ঝড়-বাতাস থেকেও যাতে বাসাগুলো সুরক্ষিত থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা হতো।

মোটকথা, গোটা উসমানীয় শাসনকালে ইট-পাথরের পাখির বাসা একটি স্বতন্ত্র শিল্পে পরিণত হয়, ভবনাদি ও অন্যান্য স্থাপত্যকর্মে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়, ঠিক সেরকমই গুরুত্ব ছিল রকমারি বাসা নির্মাণে। কালের পরিক্রমায় দেয়ালের বাইরের দিকে নির্মিত এসব বাসা সত্যিকারের উসমানীয় ভবনসমূহের আকৃতি ধারণ করে। বাসাগুলো কখনো কোনো স্কুল, মাদ্রাসা, ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন প্রাসাদ কিংবা মসজিদের আদলেও তৈরি করা হতো। তৎকালীন স্থপতি ও প্রকৌশলীগণ তুলনামূলক সুন্দর ও আকর্ষণীয় পাখির বাসা নির্মাণে পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন এবং বাসা তৈরির এ স্থাপত্য সংস্কৃতিতে যার যার সেরা দক্ষতা উপস্থাপন করতেন।

উসমানীয়দের এ অনন্য নিদর্শন গোটা সাম্রাজ্যব্যাপী বিস্তৃত থাকলেও এর বেশি প্রচলন ছিল ইস্তাম্বুলে। শুধু তা-ই নয়, কৃত্রিম এ পাখির বাসাগুলো পরে পশ্চিমা দেশগুলোর গগনচুম্বী অট্টালিকা ও ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহের দেয়ালেরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। ইতালীয় লেখক এডমুন্ডো ডি আমিজি তার ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ ‘ইস্তাম্বুল জার্নি’তে পশু-পাখির প্রতি উসমানীয় তুর্কিদের বিশেষ মমতা, সহানুভূতিশীলতা এবং প্রচন্ড ভালবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। স্মৃতিচারণা করে তিনি লিখেছেন,

অগণিত প্রজাতির পাখি আর সেগুলোর প্রতি তুর্কিদের কী উষ্ণ সৌহার্দ্য ও ভালবাসা! মসজিদ, উদ্যান, পুরাতন ভবন, যেখানেই যাবেন শুধু পাখি আর পাখি। সেগুলোর কিচিরমিচির ডাক আর ডানা ঝাঁকুনির বিরামহীন শব্দ আপনার মনকে অবশ্যই আন্দোলিত করে তুলবে।

এডমুন্ডো ডি আমিজি তুর্কি ও পাখিদের পারস্পারিক সম্পর্কের ব্যাপারে আরো লিখেছেন, পাখিদের সঙ্গে তুর্কিদের এ সম্পর্ক অত্যন্ত আবেগ ও বিশেষ গুরুত্বের এবং তাদের সভ্যতাবোধে একেকটি পাখি সূক্ষ্ম অর্থবহ ভিন্ন ভিন্ন দিক ইঙ্গিত করে। কবুতর প্রেমের প্রতীক, আবাবিল নিরাপত্তার প্রতীক আর মানিকজোড় পাখি হজের মৌসুমে মক্কার অতিথি হয়। এজন্য মানুষ এসব পাখির সুরক্ষা দেয়, যত্ন করে এবং সারা বছর এদের দানাপানি খাওয়ায় যেন আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হন।

পাখিদের প্রতি উসমানীয়দের এতটাই ভালবাসা ছিল যে, রাষ্ট্রের তরফ থেকে পাখির চিকিৎসার জন্য বিশেষ ‘দাওয়াখানা’ও তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে পাখির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে নানা পরামর্শও দেওয়া হতো। কয়েক শতাব্দী কেটে গেলেও আজও তুর্কিদের মধ্যে পাখির প্রতি বেশ আগ্রহ দেয়া যায়; তুর্কি কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন বন বিভাগ পাখির সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিগত কয়েক বছরে সরকার দেশের রাস্তা-গলি, পার্ক-উদ্যান ও প্রাকৃতিক বিনোদন কেন্দ্রসমূহের বিভিন্ন গাছে অন্তত ৬ লক্ষ ৭০ হাজার কৃত্রিম পাখির বাসা স্থাপন করেছে। এ বাসাগুলোয় শুধু পাখিদের সুরক্ষাই নিশ্চিত হচ্ছে না, বরং এর মাধ্যমে বন-বনানী ও এর গাছপালা ক্ষতিকর পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ থেকেও রেহাই পাচ্ছে।

Related Articles