Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে জমে উঠেছে বলিউডি প্রোপাগান্ডা

প্রোপাগান্ডা; বহুল প্রচলিত একটি ইংরেজি শব্দ। আভিধানিকভাবে এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক স্বার্থ বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের উদ্দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট বা বিকৃত কোনো পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য। গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আর এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের যে উপাদানটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তা হলো চলচ্চিত্র।

বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব দেশেই, বিশেষত যেসব দেশে বাক-স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার চর্চা করা হয়, সেখানে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা প্রচারের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বলিউডের চলচ্চিত্রে যেভাবে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে, তা রীতিমতো অভূতপূর্ব একটি বিষয়। চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে এত বৃহৎ পরিসরে ব্যবহারের দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আগামী ১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত মোট সাতটি ধাপে ভারতের অনুষ্ঠিত হবে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া। আর তার মাত্র দিন ছয়েক আগে, ৫ এপ্রিল মুক্তি পাবে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জীবনকাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত ছবি ‘পিএম নরেন্দ্র মোদি’। ইতিমধ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে ছবিটির ২ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের ভিডিও ট্রেইলার, যা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে সমগ্র ভারতজুড়ে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি তো সরাসরিই অভিযোগ তুলেছে যে, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নাকি “নগ্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে” বড় পর্দায় নিয়ে আসছে এমন একটি ছবি।

মোদির ভূমিকায় বিবেক ওবেরয়; Image Source: Getty Images

তবে কাগজে-কলমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপির কোনো যোগসূত্র নেই এই ছবি নির্মাণের সাথে। কেবল এটুকু সকলেরই জানা যে, ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করা বিবেক ওবেরয় মোদির খুব বড় সমর্থক। ছবিটির ট্রেইলার উন্মোচনী অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছেন বিজেপির নির্বাচনী স্লোগান, “মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় (মোদি থাকলে সব সম্ভব)”।

এমনকি বিজেপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র রাজনীতিবিদও ছবিটির প্রচারণামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারতের নির্বাচন কমিশন সন্দেহ প্রকাশ করেছে, এই ছবিটির মাধ্যমে কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হয়নি তো। তবে ছবিটির প্রযোজকরা নির্বাচন কমিশনকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ছবিটি নির্মাণে কেবল তাদের ব্যক্তিগত তহবিলের অর্থই ব্যয় করা হয়েছে, ফলে ছবিটির কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা হওয়ার সুযোগ নেই।

এদিকে ছবিটির অন্যতম প্রযোজক ও লেখক সন্দ্বীপ সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি কেবল একজন “মহামানব”-এর গল্প বলতে চেয়েছেন, যা “ভারতের মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।”

“রাজনীতি, রাজনীতিবিদ কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে আমার লেনাদেনা নেই। যদি বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা এই ছবিটির ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে থাকেন, তার মানে কি এই দাঁড়ায় না যে তারা দেশের ও নিজ নিজ রাজ্যের জন্য যে কাজ করেছেন সে ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী নন?”

অবশ্য ছবিটির নির্মাতাগোষ্ঠী যতই বড় মুখ করে দাবি করুক না কেন যে ছবিটি কোনো রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হয়নি, তাতে মন গলছে না ভারতের অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকের। যেমন- হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার চলচ্চিত্র সমালোচক রাজা সেন প্রশ্ন তুলছেন ছবিটির মুক্তির সময়কাল নিয়ে।

“(ছবি মুক্তির) সময়টা খুবই সন্দেহজনক। ছবিটির শ্যুটিং শুরু হয়েছিল জানুয়ারিতে, আর এপ্রিলেই এটি মুক্তি পাচ্ছে! নির্বাচনের ঠিক আগে এত তড়িঘড়ি করে ছবিটি মুক্তি দেয়া থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, এই ছবিটির মাধ্যমে মোদির ভাবমূর্তি পরিষ্কার করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।”

পিএম নরেন্দ্র মোদি ছবিটিতে উঠে এসেছে শিশু বয়সে মোদির ট্রেনে চা বিক্রির সময়কাল থেকে শুরু করে ডানপন্থী হিন্দু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অংশ হিসেবে তার দিনগুলো এবং ১৩ বছর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের কাহিনী। বিজেপির জনপ্রিয়তার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে ব্যক্তি মোদির জনপ্রিয়তা। ট্রেইলার দেখে বোঝা যাচ্ছে, মোদিকে এই ছবিতে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে দেখানোর পাশাপাশি, তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ও তার বিরুদ্ধে থাকা বিভিন্ন অভিযোগ খন্ডনের চেষ্টা করা হয়েছে।

২০০২ দাঙ্গার উপস্থিতি আছে ছবিটিতে; Image Source: YouTube

অনেক সমালোচকের মতেই, ছবির ট্রেইলারটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যেখানে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা চলাকালীন মোদিকে প্রচন্ড দুঃখিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছে। ওই দাঙ্গায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম। দাঙ্গাটি হয়েছিল মোদির ঠিক নাকের ডগায়, অথচ অভিযোগ আছে মোদি নাকি ওই দাঙ্গা থামানোর জন্য তেমন কোনো চেষ্টাই করেননি। কিন্তু ট্রেইলার দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, এই ছবির মাধ্যমে মোদির ওই সময়কার ভূমিকার ব্যাপারে সাফাই গাওয়া হবে।

কংগ্রেসসহ অন্যান্য দল নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে, নির্বাচন চলাকালীন সময় যেন এই ছবিটি মুক্তি দেয়া না হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, তাতে নির্ধারিত তারিখেই হয়তো মুক্তি পেয়ে যাবে ছবিটি।

আরো মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতাসীন দল বিজেপির হাতে তুরুপের তাস হিসেবে কিন্তু কেবল এই ছবিটিই নেই। তাদের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা প্রচারের জন্য মোদির জীবনীভিত্তিক একটি ওয়েব সিরিজও রয়েছে মুক্তির অপেক্ষায়। ‘মোদি: জার্নি অফ এ কমন ম্যান’ নামক দশ পর্বের ওয়েব সিরিজটি এপ্রিল থেকেই এরস নাউ-তে স্ট্রিমিং শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার ছবিতে অনুপম খের; Image Source; Times of India

রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা প্রচারের ছবি আরো রয়েছে। জানুয়ারিতেই মুক্তি পেয়েছে মোদির পূর্বসূরী মনমোহন সিংয়ের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ছবি ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। এই ছবিটি নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল, এবং অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধাই দাবি করেছিলেন এই ছবিটির মাধ্যমে কংগ্রেস আইকন মনমোহন সিংকে আক্রমণ করা হয়েছে।

এ বছর মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের আরেকটি ব্যাপক আলোচিত ছবি হলো ‘উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’, যেখানে কাল্পনিক উপস্থাপন ঘটেছিল পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মিরের একটি আর্মি বেজে জঙ্গী হামলা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় মিলিটারি অ্যাকশন কাহিনীর। দেশপ্রেমমূলক এই ছবিটিও মোদির জাতীয়তাবাদী সুনামকে মজবুত করায় অবদান রেখেছে। জানুয়ারি মাসে এই ছবিটি মুক্তির ছয় সপ্তাহ পর সত্যি সত্যিই কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের উপর আক্রমণের পর ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়।

এই ছবিটির কল্যাণেই এখন ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ শব্দযুগল পরিণত হয়েছে বিজেপি সমর্থকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নির্বাচনী স্লোগানগুলোর একটিতে। এমনকি মোদি নিজেও তার একটি নির্বাচনী প্রচারণায় বলেন, কেবল তারই “সাহস ছিল ভূমিতে, আকাশে, এমনকি মহাশূন্যেও সার্জিকাল স্ট্রাইক চালানোর।”

এই ছবির কল্যাণে জনপ্রিয় হয়েছে সার্জিকাল স্ট্রাইক শব্দযুগল; Image Source: Livemint

এতক্ষণ তো কেবল ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের পক্ষে নির্মিত প্রোপাগান্ডামূলক চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজের কথাই বলা হলো। তবে থেমে নেই বিপক্ষ শিবিরও। এপ্রিলে দেশব্যাপী মুক্তির অপেক্ষায় ‘মাই নেম ইজ রাগা’ নামক একটি ছবিও, যেখানে উঠে এসেছে মোদির প্রধান প্রতিপক্ষ, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর “অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের কাহিনী”।

ভারতীয় চলচ্চিত্রে এমন রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার প্রচারণা একদমই অভূতপূর্ব একটি ব্যাপার। যুগের পর যুগ ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে সেন্সরশিপ বোর্ড, যে কারণে আগাগোড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছবি নির্মাণ ছিল খুবই বিরল। কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে যেভাবে একের পর এক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে, তা পুরোদস্তুর বিস্ময়জাগানিয়া।

আসছে রাহুল গান্ধীর বায়োপিকও; Image Source: Scroll.in

অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, চলচ্চিত্র আর কতটাই বা প্রভাবিত করতে পারবে সাধারণ মানুষের মনকে। এ কথা অন্য কোনো দেশের বেলায় খাটলেও, ভারতের বেলায় তা খাটার সম্ভাবনা নেই। ভারত হলো সেই দেশ যেখানে ক্রিকেটার ও চলচ্চিত্র তারকাদেরকে ভগবানের সাথে তুলনা করা হয়। শিক্ষিত, শহুরে দর্শক রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও, এসব ছবি বদলে দিতে পারে অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত, গ্রাম্য দর্শকদের মানসিকতা। এখনো যারা কোন দলকে ভোট দেবে তা নিয়ে দোলাচলে রয়েছে, প্রোপাগান্ডামূলক ছবিগুলো দেখে অভিভূত হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে। আর সেক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে ক্ষমতাসীন বিজেপিই।

তবে খ্যাতিমান পরিচালক প্রকাশ ঝা, যার ‘রাজনীতি’ নামক ছবিটির গায়েও লেগেছিল প্রোপাগান্ডার তকমা, মনে করছেন যে প্রোপাগান্ডামূলক ছবিগুলো নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করবে না। তিনি বলেন, “মানুষ ছবিকে যা খুশি বলে ডাকতে পারে। তারা তো আমার রাজনীতি দেখেও আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টারে কী এমন প্রোপাগান্ডা রয়েছে? এসব প্রোপাগান্ডা নির্বাচনের ফলাফলে কোনো প্রভাবই ফেলবে না।”

আসলেই নির্বাচনের ঠিক আগে প্রোপাগান্ডামূলক ছবিগুলো মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের গতিপথ কতটুকু বদলে দেয়া যাবে, কিংবা আদৌ যাবে কি না, সে উত্তর সময়ই বলে দেবে। তবে এতটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বলিউড ইন্ডাস্ট্রি এখন আর কেবল বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতেই সীমাবদ্ধ নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এটি মূল্যবান গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বিশ্বের অন্যান্য চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কাছে ঈর্ষণীয় মনে হতে পারে।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about how Bollywood films are being used as political propaganda ahead of India Election 2019. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Karan Johar/Instagram

Related Articles