আবির আল জানাবি: মার্কিন সেনাদের নৃশংসতার শিকার এক ইরাকি কিশোরী

১.

১২ মার্চ, ২০০৬। বাগদাদ থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দক্ষিণের গ্রাম ইউসুফিয়া। অন্যান্য দিনের মতোই ক্বাসিম হামযা রহিম এবং ফখরিয়া ত্বহা মুহসিন দম্পতি তাদের দিনের কাজ শুরু করেন। ফখরিয়া ছেলে-মেয়েদের জন্য নাস্তা তৈরি করেন। ক্বাসিম তার দুই পুত্র মুহাম্মাদ এবং আহমাদকে স্কুলে যেতে তৈরি হতে সাহায্য করেন। তাদের বড় মেয়ে জানাবিকে নিরাপত্তাজনিত কারণে স্কুলে যেতে দেয়া হয় না।

ক্বাসিম-ফখরিয়া দম্পতি স্বপ্ন দেখতেন, দ্রুত এ অস্থিরতা কেটে যাবে, তারা আবার তাদের মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে পারবেন। সেদিন সকালে তাদের ছোট মেয়ে হাদিল বাড়ির প্রাঙ্গনের বাগানে খেলছিলো। মেয়েটার অভ্যেস ছিল ফুল কুড়ানো, গাছ নিয়ে খেলা করা। অন্যদিকে মুহাম্মাদ এবং আহমাদ বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা হয়। কে জানতো যে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেদিনই তাদেরকে পরিবার থেকে চিরতরের জন্য আলাদা করে দেবে!

আবির আল জানাবি; Image Source: Geneva International Centre for Justice

জানাবিদের ঘর থেকে মাত্র দু’শ মিটার দূরেই ছিল আমেরিকান সেনাদের নিরাপত্তা তল্লাশি চৌকির অবস্থান। ইরাকে মার্কিন সেনারা কী করছে এর উত্তর খুঁজতে যেতে হবে একটু পেছনে। ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসবাদ এবং অবৈধ রাসায়নিক অস্ত্র মজুদের অভিযোগ এনে গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের সাথে জোট গঠন করে ইরাক আক্রমণের ঘোষণা দেন।

যৌথ এই বাহিনী ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটায়। সাদ্দামের একনায়কতন্ত্র থেকে ইরাকিদের মুক্তি দিয়ে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও মার্কিন বাহিনী ইরাকেই থিতু হয়। জায়গায় জায়গায় বসানো হয় নিরাপত্তা তল্লাশি চৌকি। জানাবিদের বাড়ির কাছেই স্থাপিত চেকপয়েন্টটি ছিলো সেরকমই একটি।

চেকপয়েন্ট থেকে জানাবিদের বাড়ি দেখা যাওয়ার দরুন সৈন্যরা জানাবিকে দেখতে শুরু করে। মেয়েটিকে নিরাপত্তাজনিত কারণে তার বাবা-মা কখনও ঘর থেকে বের হতে দিত না। বাগানে ছোটাছুটি করা কিংবা ছোট বোনটির সাথে খেলা করা, মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করাই ছিলো তার কাজ। তারপরও সে চেকপয়েন্টের সৈন্যদের চোখ এড়াতে পারেনি।

২.

জানাবিকে দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করার ফল বের করে আনতে আমেরিকান সৈন্যরা মরিয়া হয়ে ওঠে। সেই দলে ছিল স্টিভেন গ্রিন, পল কর্টেজ, জেমস বার্কার এবং স্পেইলম্যান। হঠাৎ হঠাৎই কোনো কারণ ছাড়া চেকপয়েন্টের সৈন্যরা জানাবিদের বাড়িতে হানা দিত রাসায়নিক সরঞ্জাম এবং অস্ত্র খোঁজার অজুহাতে। আসলে উদ্দেশ্যে ছিল ভিন্ন। সেটা পরিষ্কার হয় একদিন যখন এক সেনাসদস্য জানাবির গায়ে হাত দেয়। ততদিনে সৈন্যদের তার প্রতি অশোভন ইঙ্গিত যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। জানাবির বয়স মাত্র ১৪ বছর। লজ্জা, হীনম্মন্যতায় কুঁকড়ে ওঠে সে। আহত চোখে সে এই মানুষরুপী পশুদের নিষ্ঠুরতা সহ্য করে।

(উপরে বাঁ থেকে ঘড়ির কাঁটার দিক ধরে) পল কর্টেজ, জেমস বার্কার, স্টিভেন গ্রিন এবং জেসি স্পেইলম্যান; Photo Courtesy: Macmillan

এর মধ্যে জানাবির বাবা ক্বাসিমকে তার প্রতিবেশীরা মেয়ের ব্যাপারে সৈন্যদের থেকে সাবধান থাকতে বলেন। ক্বাসিম এহেন সাবধানবাণীকে পাত্তা না দিয়ে বলেন, “ও এখনও বাচ্চা মেয়ে। ওকে কিছু করবে না।” ক্বাসিমকে বিস্মিত করে এরপর যা হলো তা বর্ণণা করা দায়। পরে অবশ্য জানাবির প্রতি সেনাসদস্যদের কুরুচিপূর্ণ আচরণ বেড়ে গেলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে তার প্রতিবেশী আঙ্কেলের বাড়িতে পাঠাবার। এরপর থেকে জানাবি সেখানে ঘুমাত। চেকপয়েন্টের সৈন্যরা এটা দেখতে পায়। তখন তারা পরিকল্পনা করে, যখন জানাবির দু’ভাই স্কুলে যাবে, তখন বাবা-মাসহ জানাবির উপর হত্যাযজ্ঞ চালাবে। 

৩.

১২ মার্চের সকালবেলা আর্মি নিরাপত্তা তল্লাশী চৌকির সদস্য স্টিভেন গ্রিন, পল কর্টেজ, জেমস বার্কার, স্পেইলম্যান কার্ড খেলছিল। গ্রিন এবং কর্টেজ তখন জানাবিকে ধর্ষণ এবং পুরো পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনার কথা বলে। যেহেতু পুরুষ মাত্র একজন, জানাবির বাবা, তাদের ভাষায় এটা একটা সহজ টার্গেট। অন্যান্য দিন থেকে তারা বেশি মাত্রায় অ্যালকোহল পান করে। মদ্যপ অবস্থায় তারা বিক্ষিপ্ত আচরণ শুরু করে। এর মধ্যে বার্কার বলে, “চলো, ঐ মেয়েটাকে (জানাবি) ধর্ষণ করি এবং কিছু ইরাকি মারি।” এই বলে তারা উঠে আসে এবং নিনজা সাজ নেয়। 

নিরাপত্তা চৌকির আরেক সৈন্য ব্রেন হাওয়ার্ড মনে করেছিল তারা মজা করছে অন্যান্য দিনের মতো। সে তাদের কথায় সায় না দিলেও তাদের বাধাও দেয়নি। হয়তো কিছুক্ষণ পরই ঘটতে যাওয়া নৃশংসতার কথা তার কল্পনাতেও ছিল না।

দুই ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে ক্বাসিম বাগানে তার ছোট মেয়ের সাথে গল্প করছেন। জানাবি ও তার মা রান্নাঘরে ছিল। এর মধ্যে তারা দেখতে পায় অদ্ভুত পোশাক পরিহিত চারজন লোক তাদের বাড়ি ঘিরে ধরেছে। তারা যে চেকপয়েন্টের আর্মির লোক তা বুঝতে অসুবিধা হল না। এরই মধ্যে স্টিভেন গ্রিন ও স্পেইলম্যান ক্বাসিম ও তার ৬ বছর বয়সী ছোট মেয়ে হাদিলকে বাগান থেকে ডেকে ঘরে নিয়ে যায়। জানাবির কাছ থেকে তাদের আলাদা করে ফেলে। গ্রিন তাদের মাথায় গুলি করে তাদের হত্যা করে। অন্যদিকে কর্টেজ এবং বার্কার পালাক্রমে জানাবিকে ধর্ষণ করে। 

জানাবি নিজেকে বাচাঁনোর চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষরুপী জানোয়াগুলোর কাছে সে অসহায় হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে সে গুলির আওয়াজ শোনে এবং নিশ্চিত হয় যে তার বাবা আর বোনকে মেরে ফেলা হয়েছে। একদিকে গণধর্ষণের যন্ত্রণা, অন্যদিকে পরিবারের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো হারানোর শোক- জানাবির অবস্থা কেমন হয়েছিল তা বর্ণণাতীত। একে একে ধর্ষণের পর স্টিভেন গ্রিন জানাবির মাথায় কাছ থেকে গুলি করে। মগজ ছিটকে পড়ে দেয়ালে। নিথর জানাবি পড়ে থাকে মেঝেতে। তারা জানাবির মাকেও মেরে ফেলে। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা করেছিলেন যিনি।

সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্থানই দেখাচ্ছেন এই প্রতিবেশী; Image courtesy: AP

৪.

আমেরিকান সৈন্যরা জানাবিকে ধর্ষণের পর হত্যা ও তার পুরো পরিবারকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। প্রমাণ লোপাটের জন্য মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে দেয়। ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ সুন্নি অন্তর্ঘাতীদের কাজ বলে চালিয়ে দেয়। এত নিষ্ঠুর অমানবিক কাজ- তাদের এতটুকু অনুশোচনাও হয়নি। উপরন্তু ‘চিকেন উইংস’ পার্টি দিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ উদযাপন করে তারা। 

সত্য কখনও চাপা থাকে না। শুদ্ধ সুবাস নয়তো কদর্য দুর্গন্ধ হয়ে বেরিয়ে আসে। স্টিভেন গ্রিনদের ক্ষেত্রে পরেরটিই হয়। আমেরিকার আদালতেই স্টিভেন গ্রিনদের বিচার হয়। তাদের প্রত্যেককে পাঁচ থেকে একশো বছরের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ইতিমধ্যেই নিজের হাতে গড়া ভাগ্যের শিকেয় ঝুলতে হয় স্টিভেন গ্রিনকে, যে কি না ইরাকিদের মানুষই মনে করত না। 

২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অ্যারিজোনা সেলে গ্রিনকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, প্রচন্ড হীনম্মন্যতা ও মানসিক অবসাদগ্রস্থতায় ভুগে আত্মহত্যা করে সে। 

আদালতে গ্রিন; Image courtesy: Crime Scene Database

ইরাকের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার মধ্যেই জন্ম আবির আল জানাবির। যুদ্ধ-বিগ্রহ যেন তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে রেখেছিল। উপসাগরীয় যুদ্ধ সমাপ্তির বছরে তার জন্ম। দরিদ্র বাবা স্বপ্ন দেখতেন, মেয়ে একদিন বড় হবে। বাগদাদে যাবে পড়ালেখা করতে। সেই স্বপ্নে জল ঢালে ইরাক যুদ্ধ। ঐ বছরেই নিরাপত্তার কথা ভেবে জানাবিকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেন তার বাবা-মা। যে মেয়ের নিরাপত্তার জন্য এত কিছু, যাকে ঘিরে এত স্বপ্ন, তাকে শেষমেষ বরণ করে নিতে হলো এমন নিষ্ঠুর পরিণতি।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জানাবি, যারা যুদ্ধ-বিগ্রহের বলি হয়ে একাকী, হীনম্মন্য জীবনযাপন করছে কিংবা যাদের পৃথিবীর বর্বরতা বাঁচতে দেয়নি, তাদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

Related Articles

Exit mobile version