জাপান বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য দেশগুলোর মধ্যে একটি। প্রযুক্তিখাতে প্রচন্ড উন্নতি লাভ করা কয়েকটি দেশের নাম এলে অবধারিতভাবেই জাপানের নাম আসবে। প্রায় প্রতিবছরই জাপানের বিজ্ঞানীরা নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। অটোমোবাইল ও ইলেক্ট্রনিক্স খাতে জাপানি কোম্পানিগুলো বিশ্বে রীতিমতো নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই তো ক'দিন আগেই ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পরও জাপানী সমর্থকরা স্টেডিয়াম ছাড়ার আগে গ্যালারি পরিস্কার করে পুরো বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশই জাপানকে সভ্যতা ও উন্নতির মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু এই জাপানেই এক শ্রেণীর মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে শত শত বছর ধরে। জাপানের মতো একটি দেশের ক্ষেত্রে এটি রীতিমতো বিস্ময়কর। একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ, যাদেরকে 'বুরাকুমিন' হিসেবে অভিহিত করা হয়, যুগ যুগ ধরে তাদের পরিকল্পিতভাবে পশ্চাৎপদ করে রাখা হয়েছে।
২০১৫ সালের শেষ দিকে জাপানের একটি জেলার প্রায় শতাধিক অধিবাসীর কাছে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভাষায় লেখা ই-মেইল (যেগুলোকে হেট মেইলও বলা হয়) ও হাতে লিখিত চিঠি আসতে থাকে। "আমরা সবাই তোমাদের ঘৃণা করি", "কতগুলো শতাব্দী পার হয়েছে তা আমাদের ধর্তব্য নয়, আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য চালিয়ে যেতে চাই"- এ ধরনের তীব্র ঘৃণা ছড়ানো ভাষায় লেখা এসব হেট মেইল ও চিঠি অধিবাসীদের রীতিমতো আতংকিত করে তোলে। যাদের কাছে এই চিঠি ও ই-মেইলগুলো এসেছিল, তাদের সবাই 'বুরাকুমিন' শ্রেণীর মানুষ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বুরাকুমিন আসলে কারা?
বুরাকুমিন শব্দটির অর্থ 'গ্রামের মানুষ'। বুরাকুমিনরা জাপানে দলবদ্ধভাবে যে ঘরগুলোতে থাকে সেটিকে বলা হয় 'বুরাকু'। আর 'মিন' অর্থ মানুষ। বুরাকুমিন শব্দটির মাধ্যমে আদতে 'গ্রামের মানুষ' বোঝানো হয়। এটি তূলনামূলক একটি ভদ্রতাসূচক শব্দ। বুরাকুমিনদের 'এটা'ও (Eta) বলা হয়। 'এটা' শব্দের অর্থ নোংরা বা অপবিত্র।
বুরাকুমিনদের সামাজিক অবস্থান অনেকটা ভারতের 'দলিত' সম্প্রদায়ের মতো। ভারতের দলিতরা যেমন যুগ যুগ ধরে ভারতের বর্ণব্যবস্থায় নির্মমভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে, বুরাকুমিনদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক একই রকম।
সতেরো শতকে তোকুগাওয়া যুগে জাপানি বৌদ্ধ ও শিন্তো ধর্মের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস অনুসারে বুরাকুমিনদের 'অপবিত্র' ও 'অস্পৃশ্য' হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এটার কারণ বুরাকুমিনরা চামড়া ব্যবসা, প্রাণী জবাই ও কাটাকাটি, মৃতদেহ সৎকার, ময়লা পরিস্কারের মতো যে কাজগুলো করে থাকে, সেগুলো শিন্তো ও বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী 'অপবিত্র ও নোংরা'। বাস্তবে বুরাকুমিনদের মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ এসব কাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
বুরাকুমিনরা জাপানের মোট জনসংখ্যার ১.৫% - ২%, প্রায় ৩০ লাখ। পুরো জাপানেই তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। জাপানের সবচেয়ে কম আয়ের পেশাগুলোতে তারা নিয়োজিত। ময়লা পরিস্কার, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, মৃতদেহের সৎকার- যে পেশাগুলোকে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে নিচু ও অপবিত্র মনে করা হয়, সেসব পেশার প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে বুরাকুমিনরা। এর কারণও রয়েছে। বুরাকুমিনদের মাঝে শিক্ষার হার খুবই কম। তাদের এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বুরাকামিন তরুণদের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় তিনগুণ বেশি।
একসময় বুরাকুমিনদের সম্পর্কে খুবই প্রচলিত একটি তত্ত্ব ছিল যে, তারা জাপানের বাইরে থেকে আসা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই অযৌক্তিক অনুমানের মাধ্যমে তাদের পশ্চাৎপদ করে রাখার প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, তারা জাপানের স্থানীয় মানুষ, যারা অনেক আগে থেকেই সমাজের সবচেয়ে নিচের পেশাগুলোতে নিয়োজিত। তোকুগাওয়া শাসনামলের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় তাদেরকে একদম নিচের পেশাগুলোয় নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হতো এবং পেশা পরিবর্তন করার কোনো উপায় ছিল না।
বুরাকুমিন ও সাধারণ জাপানীদের মধ্যে দৈহিক অবকাঠামোয় কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু তোকুগাউয়া শাসনামলে বাহ্যিক সাজগোজের ভিত্তিতে তাদের খুব সহজেই আলাদা করা যেত। কারণ সেসময় তাদের জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক, বিশেষ ধরনের চুলের ছাঁট দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এছাড়াও তাদের জমির মালিকানা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর পূর্বেই বলা হয়েছে, একজন বুরাকুমিন কোনো উচ্চতর পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতো না। এমনকি কোনো পেশায় একবার নিয়োজিত হলে সেটা পরিবর্তন করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না।
১৮৭১ সালে জাপানের মেইজি সরকার সামাজিক বর্ণপ্রথা তুলে দিতে উদ্যোগী হয়। চার স্তরবিশিষ্ট বর্ণপ্রথা তুলে দেওয়ার পর বুরাকুমিনদের অন্য সবার মতোই সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বাস্তবে যে সামাজিক বৈষম্যের শিকার বুরাকুমিনরা হয়ে আসছিলো, সেটি অব্যাহত থাকে।
শিক্ষাক্ষেত্রে জাপানের শিক্ষামন্ত্রণালয় বর্তমানে বুরাকুমিন ইস্যুতে একইসাথে ইতিবাচক ও স্পর্শকাতর ভূমিকা পালন করছে। "যদি কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা না হয় তবে সেটা ঘটবেও না"- বুরাকুমিনদের ক্ষেত্রে এই নীতি গ্রহণ করেছে জাপানী শিক্ষামন্ত্রণালয় ও বুরাকুমিন সংগঠনগুলো। এই নীতি গ্রহণের পেছনে যুক্তি হলো, বুরাকুমিনদের নিয়ে আলোচনা শুরু হলে হয়তো অ-বুরাকুমিনরা তাদের মানসিক ও সামাজিকভাবে আলাদা ভাবতে শুরু করবে। জাপানী সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে এই বুরাকুমিন ইস্যু নিয়ে যাতে জাপানী সমাজে কোনো ধরনের আলোচনা না হয়।
২০০৯ সালে গুগল জাপানের পুরোনো মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে বুরাকুমিনদের বাসস্থান ও গ্রামগুলোকে লাল চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়। এর পরপরই জাপানের নাগরিক সংগঠনগুলো ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর তীব্র সমালোচনা ও এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে গুগল সেই মানচিত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। জাপানী প্রগতিশীল সমাজ বা সরকারের কেউই চায় না বুরাকুমিন ইস্যু সামনে আসুক, আলোচিত হোক।
জাপানের কর্পোরেট সেক্টর গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ব্যাপক সমালোচিত হয়। এর কারণ, জাপানের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যোগ্য প্রার্থীদের 'ব্যাকগ্রাউন্ড চেক' এর মাধ্যমে নিয়োগ দিত। এটি ছিল অত্যন্ত বৈষম্যমূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া। যোগ্য প্রার্থীদের কেউ যদি বুরাকুমিন পরিবার থেকে আসে তাহলে মেধা ও যোগ্যতায় এগিয়ে থাকলেও তাকে শেষমেশ আর চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হতো না। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝিতে জাপানের গোয়েন্দা ও বুরাকুমিন সংগঠনগুলো ৩৩০ পৃষ্ঠা দীর্ঘ একটি তালিকার সন্ধান পায়, যেখানে বুরাকুমিনদের সাধারণ নাম ও থাকার জায়গাগুলোর নাম ছিল। এই তালিকা ধরে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজ চালিয়ে দেখতো যোগ্য প্রার্থীটি বুরাকুমিন পরিবারের কি না বা তার পূর্বসুরীদের মাঝে কেউ বুরাকুমিন ছিল কি না।
সবচেয়ে বড় যে অপরাধচক্রটি জাপানের আন্ডারওয়ার্ল্ডে রাজত্ব করে, তার নাম নাম 'ইয়াকুজা'। এই অপরাধ সংগঠনের চার ভাগের তিনভাগই বুরাকুমিনদের দখলে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রকট সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে যখন বুরাকুমিনদের কোথায় যাওয়ার সুযোগ থাকে না, তখন ইয়াকুজা তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বুরাকুমিনরাও তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ইয়াকুজায় যোগ দেয়। অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যায়। তাই সাধারণ জাপানীরা একসময় বুরাকুমিন বলতে বুঝতো সারা শরীরে ট্যাটু আঁকা একদল সন্ত্রাসীদের, যারা দুধর্ষ সব অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত।
১৯২২ সালে বুরাকুমিনদের অধিকার আদায়ের সংগঠন 'সুইহেইসা' গঠিত হয়। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনটি কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জাপানে 'ন্যাশনাল কমিটি ফর বুরাকুমিন লিবারেশন' গঠিত হয়। পরবর্তীতে এটি নাম পরিবর্তন করে 'বুরাকু লিবারেশন লিগ' নামে পরিচিতি লাভ করে। সমাজতান্ত্রিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি এই সংগঠনটি বুরাকুমিনদের অধিকার আদায়ের মূল প্লাটফর্ম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। ধীরে ধীরে সংগঠনটি বুরাকুমিন ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থ বরাদ্দ ও চাকরির ক্ষেত্রে 'ব্যাকগ্রাউন্ড চেক' অবৈধ ঘোষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো তুলে ধরে এবং সরকারকে এসব দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে।
বর্তমানে জাপানে কাউকে 'এটা' (Eta) বলা বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। সম্প্রতি এক পোলে দেখা গিয়েছে, ৭৩% বুরাকুমিন জন্মের পর থেকে বৈষম্যের শিকার হননি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যের হার অনেক কমে এসেছে, তারপরও জাপানী সমাজে মিশে যেতে বুরাকুমিনদের আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
This is a bengali article about the japanese caste Burakumin, who suffer a lot in their day-to-day activities.
Reference:
1. Japan's hidden caste of untouchables
2. Who Are the Burakumin, Japan's 'Untouchables'?
3. Burakumin: Descendants of caste considered 'tainted' face new discrimination in Japan
4. Japan's Untouchables: The Burakumin
5. THE BURAKUMIN: JAPAN’S INVISIBLE RACE
6. Burakumin
7. BURAKUMIN