Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের মানুষ এত সুখী কীভাবে?

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (SDSN) কর্তৃক প্রতি বছর প্রকাশিত হয় ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বা বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন। ২০১২ সালে বান কি মুন কর্তৃক গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করে আসছে। প্রতিষ্ঠার দশক ধরে রিপোর্টের উপরের দিকে বা টপ অবস্থানে থাকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ, যার প্রতিফলন দেখা যায় সর্বশেষ ২০২৩ সালের রিপোর্টেও। ভৌগলিকভাবে ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে ও সাংস্কৃতিকভাবে এই তিনটিসহ আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও ফারো দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ। এই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সুখের কারণ কী? জানতে হলে বুঝতে হবে কীভাবে তৈরি হয় এই রিপোর্ট।

কীভাবে তৈরি হয় ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট?

ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বা বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন  তৈরি হয় বিভিন্ন উৎস হতে সংগৃহীত তথ্য ও পরিচালিত জরীপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে। বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে তৈরি হয় প্রতিবেদনটি। মোটাদাগে দুটি সূচক ব্যবহৃত  হয়- সাবজেক্টিভ ও অবজেক্টিভ। অবজেক্টিভ সূচকের মধ্যে SDSN দেখে থাকে- ১) পার ক্যাপিটা জিডিপি (মাথাপিছু আয়), ২) স্বাস্থ্য বা সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল, ৩) সামাজিক সহযোগিতা, ৪) জীবন পছন্দ করার স্বাধীনতা, ৫) উদারতা, এবং ৬) দুর্নীতি নিয়ে মানুষের উপলব্ধি। সাবজেক্টিভ সূচকে SDSN সেই দেশের মানুষের নিজস্ব মূল্যায়নকে দেখার চেষ্টা করে। এই ক্ষেত্রে তারা গ্যালাপ ওয়ার্ড পোলের তথ্য নিয়ে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষকে তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে একটি সংখ্যাসূচক স্কেলে (০- ১০) তাদের জীবনের সন্তুষ্টির মাত্রা নির্ধারণ করে। তাছাড়া সংস্থাটি ওয়ার্ল্ড ভ্যালুজ সার্ভেসহ বিভিন্ন উৎস হতে তথ্য নিয়ে থাকে। তথ্যগুলো বিশ্লেষণের পর সাবজেক্টিভ ও অবজেক্টিভ স্কোর একত্রিত করে একটি র‍্যাঙ্কভিত্তিক তালিকা প্রকাশ করে।

প্রতিবছর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (SDSN) কর্তৃক প্রকাশিত হয় ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট;
Image: Apna Bharat News

অবজেক্টিভ সূচকের উপর সাবজেক্টিভ সূচক নির্ভর করে। কারণ সাবজেক্টিভ সূচকে মানুষ নিজে তার জীবন নিয়ে রেটিং দিয়ে থাকে। একজন মানুষ তার জীবন নিয়ে তখন উচ্চ আশাবাদী হবে যখন সে একটি সুস্থ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বসবাস করবে। সেজন্য আমাদের একটি দেশের মানুষের গড়পড়তা সুখ বেশি হওয়ার কারণ বুঝতে অবজেক্টিভ সূচকের উপর ফোকাস করতে হবে।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা এত সুখী কেন?

মানুষ কী কারণে সুখী হয়? মানুষ কোনো একক কারণে সুখী হয় না। ইউরোপের উত্তরের স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা সুখ সূচকে এগিয়ে বা এত সুখী হওয়ার রয়েছে বিভিন্ন কারণ। অবজেক্টিভ সূচকের ৬টি ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী আলোচনা করা হলো।

কল্যাণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা

এরিস্টটলের ভাষায় মানুষ রাজনৈতিক জীব। তার মতে, রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জনকল্যাণ। রাষ্ট্র সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে আদি হতে বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদ পাওয়া যায়। কেউ বলছেন ,রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। সেই সুখকে চিরস্থায়ী করতে, নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের জন্ম (জন লক, রুশো)। কেউ বলছেন, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল বর্বর, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। সম্পত্তির নিরাপত্তা ছিল না, রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে (থমাস হবস)।

আধুনিক রাষ্ট্র হচ্ছে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র; Image source: Dawn

কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র হচ্ছে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র। আধুনিক রাষ্ট্রকে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতীয়তা, গোত্র, ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হয়। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। এই অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের সংবিধান। একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামরিক সরকারের সময়ে সংবিধান মূলত অকার্যকর। সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকার। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহে সরকারব্যবস্থা সোশ্যাল ডেমোক্রেসি। উল্লেখিত ৬টি ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে বেশিরভাগ এই সরকারব্যবস্থার উপর নির্ভর করে।

আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা আমার আছে কিনা? আমার জাতীয়তা, ভাষা, জাতিভিত্তিক পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে কোনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছি কিনা? আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি? এসব বিষয় নিশ্চিত হয় গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায়। দুর্নীতি কম হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, কারণ সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। তাছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য দেশের অর্থনীতি ভালো কাজ করে, মানুষের আয় তুলনামূলক ভালো থাকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি থাকায় মানুষের সামাজিক সুরক্ষা অত্যন্ত শক্তিশালী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ফ্রিসহ মৌলিখ অধিকার নিয়ে চিন্তা করতে হয় না জনগণকে। অনেকে মনে করেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সমজাতীয় জাতির দেশ, সেজন্য সুখী। কিন্তু নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থাকলেও সুখ-প্রতিবেদনে তারা উপরের দিকে রয়েছে।  

সমাজব্যবস্থা মানুষের আচরণ ও মননে প্রভাব ফেলে; Image source: Inter-Parliamentary Union

সমতা ও নায্যতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা

SDSN এর ৬টি ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে কয়েকটি সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। সমাজ যদি সমতা ও নায্যতাকে প্রাধান্য না দেয়, তাহলে সেই সমাজের মানুষেরা কম সুখী হতে পারে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের সমাজব্যবস্থায় যা লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক সহযোগিতা, উদারতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ এগিয়ে। একটি শিশু যখন নর্ডিক দেশে জন্ম নেয়, তার দায়িত্ব সরকারও নেয়। ফ্রি স্কুল, ফ্রি চিকিৎসা পেয়ে থাকে দেশের সকল নাগরিক। সামাজিক সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে চ্যারিটি, অন্যের উপকার। একজন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান নাগরিক দিনশেষে চিন্তা করবে আমি কি চ্যারিটিতে দান করেছি? এই চ্যারিটির মাধ্যমে একজন মানুষ মানসিক শান্তি পেয়ে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে পরোপকারের মাধ্যমে তারা মানসিক শান্তি পেয়ে থাকে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য সরকারের সহযোগিতা থাকে। শিক্ষার পর কেউ যদি চাকরি চলে যায়, রাষ্ট্র তার সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে থাকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সমাজে সরকারের প্রতি মানুষের বিশ্বাস শক্ত। সেসব দেশের শহরের কোনো মানুষকে দেখা যাবে দরজায় তালা না দিয়েই রেখে যেতে। তাছাড়া মহিলারা মাতৃত্বকালীন ১ বছরের ছুটি পেয়ে থাকেন।

আয়বৈষম্য মানুষকে অসুখী করে তোলে; Image Source: Econilb

অর্থনীতি (আয়) 

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ মূলত কল্যাণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, যেখানে সামাজিক কল্যাণের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এবং সরকারের হস্তক্ষেপকে গ্রহণ করা হয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহে চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করার দরুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে থাকে, পাশাপাশি দেশসমূহ সামজিক কল্যাণ প্রোগ্রামের উপর জোর দেয়, যেমন- সার্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধা। যার ফলে সেখানে আয়বৈষম্য, বিভেদ কম। একজন অশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তান চাইলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে ফ্রিতে। রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে আয়বৈষম্য কম থাকার দরুন মানুষের মধ্যে হতাশা কম কাজ করে। তবে সেসব দেশে আয়বৈষম্য রয়েছে যা তুলনামূলক অন্য দেশের থেকে কম। দ্য গিনি কোএফিশিয়েন্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী আয়বৈষম্যের গড় হিসেবের নিচে অবস্থান করছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো।

স্বাধীনতার অনুভূতি মানুষকে সুখী করতে সহায়তা করে; Image: Success Consciousness

উদারতার সংস্কৃতি, স্বাধীনতার অনুভূতি

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর সংস্কৃতির অন্যতম বিশিষ্ট হচ্ছে বিশ্বাস, সমতা, উদারতা, উম্মুক্ততা ও স্বচ্ছতা ইত্যাদি। বাংলাদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান আমাদের দেশের মানুষের সরকারের প্রতি অবিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করতেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশের মানুষের মধ্যে তার উল্টো দেখা যায়। সংস্কৃতি মানুষের ভবিষ্যৎ আচরণ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় একটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিশু যে সংস্কৃতি রপ্ত করে তা তাদের সুখী জাতিতে পরিণত করে। তবে এই অবিশ্বাসের সম্পর্ক এশিয়ায় গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এখানকার নেতারা স্বাধীনতার সময় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে, স্বাধীনতার পর যখন ক্ষমতায় বসেন তারা দেশের জনকল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। ব্যহত হয় উন্নয়ন, জনমনে বাড়ে অবিশ্বাস।

তাছাড়া স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের মধ্যে স্বাধীনতার অনুভূতি (sense of freedom) রয়েছে। ৪ নাম্বার ক্রাইটেরিয়াতে যার কথা বলা হয়েছে। অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি ইত্যাদি স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের সুখী বোধ করতে সাহায্য করে। জনগণের নিরাপত্তা রয়েছে সর্বোচ্চ।

বিরুপ আবহাওয়ার পরও স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের মধ্যে সুখের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণ বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সামাজিক সহযোগিতা ও উদারতার উন্নত সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ইত্যাদি।

This article is written in Bangla. It is about the causes of Scandinavian people being so happy.
References are hyperlinked inside.
Feature image: Daily Scandinavian

Related Articles