আমি এখনো আমেরিকার ওপর আস্থা রাখি এবং সবসময় রাখব। আপনারাও যদি এমন হন, তাহলে আমাদের উচিত হবে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া এবং সামনের দিকে পথ চলা। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। তাকে আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাকে আমাদের খোলা মনে বিবেচনা করা উচিত এবং তিনি নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখেন। আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঐতিহ্য আছে। আমরা একে শুধু সম্মানই করি না, একে সযত্নে লালন করি।
-হিলারি ক্লিনটন
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হেরে যাওয়ার পর সমর্থকদের কাছে এভাবেই নতুন প্রেসিডেন্টকে শুভ কামনা জানিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। তার জন্য এটা খুব পীড়াদায়ক ব্যাপার ছিল। কারণ তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। কিন্তু ইলেকটোরাল ভোটে পিছিয়ে যাওয়ার কারণে ট্রাম্পই হন তখনকার প্রেসিডেন্ট।
হিলারি সেদিন হেরে গেলেও দারুণ বক্তব্য দিয়েছিলেন সমর্থকদের উদ্দেশ্যে। নির্বাচনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা তো আমেরিকান জনগণের জন্যই কাজ করেন। তাই কে ক্ষমতায় থাকল সেটা বড় বিষয় হওয়া উচিত নয়, জনগণ প্রেসিডেন্টদের কাছ থেকে প্রাপ্য সেবা পাচ্ছে কিনা সেটাই বড় বিষয়। তাই নির্বাচনে হেরে গেলেও পরাজয়ী প্রার্থীরা বিজয়ী প্রার্থীকে শুভেচ্ছা জানান। এটি ‘কনসেশন স্পিচ’ (Concession Speech) নামেই পরিচিত।
চার বছর আগে বিজয়ের হাসি হাসলেও ২০২০ সালে এসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হয়ে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে দ্বিতীয় মেয়াদে আর ক্ষমতা পাওয়া হচ্ছে না ট্রাম্পের। কিন্তু তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙ্গে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত জো বাইডেনকে কোনো শুভেচ্ছা জানাননি। শুভেচ্ছা জানানো দূরের কথা, তিনি এখন পর্যন্ত পরাজয়ই মেনে নেননি! বরং যখন তার পরাজয়ের খবর গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিল, তখন তিনি গলফ খেলছিলেন!
নির্বাচনে পরাজিত হলে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানাতেই হবে, এটা বাধ্যতামূলক কোনো নিয়ম নয়। তবে আমেরিকায় এটা দীর্ঘদিনের অলিখিত একটা নিয়মই বলা যায়। প্রতিপক্ষকে সৌজন্য দেখাতেই এটা করে থাকেন পরাজিত প্রার্থীরা। দুই পক্ষের সমর্থকরাও খুশি হন এটা দেখলে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কার্যক্রম প্রার্থীরা সাধারণত দুই বছর বা তারও আগে থেকে করে থাকেন। দীর্ঘ সময়ের প্রচার-প্রচারণা আর বিতর্কের পর পরাজয়ীদের বক্তব্যে নাটকীয়তার মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে।
১৮৯৬ সালের নির্বাচনের দুই দিন পর পরাজিত প্রার্থী উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান তার প্রতিপক্ষ উইলিয়াম ম্যাককিনলিকে টেলিগ্রামে দুই লাইনের শুভেচ্ছাবার্তা লিখে পাঠান। ধারণা করা হয় এটিই সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিয়ে জনসম্মুখে দেওয়া কোনো বার্তা। এরপর থেকে এটি আমেরিকার রেওয়াজে পরিণত হয়। হয়তো এটা জানানোর মাধ্যম পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এতে কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
আলফ্রেড স্মিথ ১৯২৮ সালে হারবার্ট হুবারের কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে রেডিওতে ভাষণ দেন। ১৯৫২ সালে ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের কাছে পরাজিত হয়ে অ্যাডলাই স্টিভেনসন টেলিভিশনে সরাসরি ভাষণ দেন। গত ১২০ বছরে ৩২ বার পরাজয়ী প্রার্থীরা ভাষণ দিয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি ভাষণ খুবই বিখ্যাত হয়ে আছে। তাদের ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশগুলো পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (১৯৯২)
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৮৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও দ্বিতীয় মেয়াদে হেরে যান। প্রেসিডেন্ট হিসাবে জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ যে ব্যর্থ ছিলেন, তা বলা যায় না। তার সময়ে বার্লিন দেয়ালের পতন হয়েছে, স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে, গালফ যুদ্ধেও জয়ী হয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আরকানসো (Arkansas) এর গভর্নর বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে যান। পরাজয় মেনে নিয়ে তখন বুশ বলেন,
“ঠিক আছে, আমি এটা এভাবে দেখি... জনগণ তাদের রায় দিয়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মহিমাকে সম্মান করি। আমি মাত্রই লিটল রকে (আরকানসো এর রাজধানী) অবস্থান করা গভর্নর ক্লিনটনের সাথে ফোনে কথা বলেছি এবং তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি দেশকে জানাতে চাই, আমাদের পুরো প্রশাসন তার দলের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করবে সহজভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করার জন্য। আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা বাকি। আমেরিকাকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। আমরা নতুন প্রেসিডেন্টকে সমর্থন জানাবো। তার জন্য শুভ কামনা করি।”
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো দ্বিতীয় মেয়াদে সফল না হলেও তার ছেলে জর্জ ডব্লিউ বুশ দুই মেয়াদই ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন।
জিমি কার্টার (১৯৮০)
জিমি কার্টারও এক মেয়াদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালের নির্বাচনে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে হেরে যান। পরাজয়ের পর তিনি বলেন,
“আমি চার বছর আগে আপনাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আপনাদের সাথে কখনো মিথ্যা বলব না। তাই আমি এখানে দাঁড়িয়ে বলতে পারছি না যে, আমার খারাপ লাগছে না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বাছাই করে নিয়েছে। আমি অবশ্যই জনগণের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে, চার বছর আগে জনগণের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার সময় যে উদ্যম ছিল এখন তা নেই। যা-ই হোক আমি এই সিস্টেমকে খুব কদর করি, যা জনগণকে স্বাধীনতা দেয় আগামী চার বছর কে তাদের নেতৃত্ব দেবে সেটা বাছাই করার জন্য।”
জন ম্যাককেইন (২০০৮)
২০০৮ সালের নির্বাচনে অ্যারিজোনার সিনেটর জন ম্যাককেইন বারাক ওবামার কাছে হেরে যান। তখন ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ওবামা। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ব্যক্তি হিসাবে বারাক ওবামাকে ম্যাককেইন খুব সম্মান করতেন। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার সমর্থকরা ওবামাকে নিয়ে খারাপ কিছু বললে তিনি সেখানে প্রতিবাদ করেন। নির্বাচনে পরাজয়ের পরও ওবামার প্রতি আরেকবার শ্রদ্ধা জানান। তখন ভাষণে বলেন,
“এটি একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন। আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং আজ রাতে এটা (ওবামার জয়ী হওয়া) তাদের জন্য অবশ্যই গর্বের ব্যাপার। একশ বছর আগে প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট যখন বুকার টি ওয়াশিংটনকে (আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষাবিদ) হোয়াইট হাউজের ডাইনিং রুমে আমন্ত্রণ জানান, তখন এটাকে চূড়ান্ত অবমাননা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। আমেরিকা সেই সময়ের বর্বরতা আর গোঁড়ামি থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এটা প্রমাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন আফ্রিকান-আমেরিকানকে নির্বাচিত করার চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।”
আল গোর (২০০০)
২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল আমেরিকার সবচেয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও বিতর্কিত নির্বাচন। নির্বাচনের রাতে পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে মনে করে টেক্সাসের গভর্নর জর্জ ডব্লিউ বুশকে ফোন করে অভিনন্দন জানান বিল ক্লিনটনের সময় ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা আল গোর। এরপর জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছিলেন আল গোর। কিন্তু ফ্লোরিডার ভোট নিয়ে অনেক নাটক হয় সেদিন।
একবার বলা হয় সেখানে আল গোর জিতেছেন, একবার বলা হয় বুশ। এতই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল যে, ফ্লোরিডায় যে জিতবেন তিনিই হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। আল গোর তখন অনিশ্চয়তা দেখে অভিনন্দন বার্তা ফিরিয়ে নেন। শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন সুপ্রিম কোর্টে গড়ায় মীমাংসার জন্য। পরে আদালতের রায় যায় বুশের পক্ষেই। ১৩ ডিসেম্বর পুনরায় পরাজয় মেনে নিয়ে আল গোর ভাষণে বলেছিলেন,
“কিছুক্ষণ আগে আমি জর্জ ডব্লিউ বুশের সাথে কথা বলেছি এবং তাকে আমেরিকার ৪৩তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি তাকে কথা দিয়েছি যে, এবার আর ফোন করে অভিনন্দন ফিরিয়ে নেব না। আমি তাকে প্রস্তাব দিয়েছি আমরা যেন দ্রুত সাক্ষাৎ করি, যেন বিগত নির্বাচনী প্রচারণা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়ে আমাদের মাঝে তৈরি হওয়া বিভেদগুলো দূর করতে পারি।
প্রায় দেড়শ বছর আগে সিনেটর স্টিফেন ডগলাস আব্রাহাম লিংকনের কাছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বলেছিলেন, "দেশপ্রেমের কাছে দলীয় অনুভূতি নত করা উচিত। আমি আপনার সাথে আছি মিস্টার প্রেসিডেন্ট। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।" আমি ঠিক এমনই উদ্যম নিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমাদের মাঝে যে দলীয় বিদ্বেষ অবশিষ্ট আছে, তা এখন একপাশে সরিয়ে রাখা উচিত। ঈশ্বরের কাছে তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের কল্যাণ কামনা করি।
আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার দ্বিমত থাকলেও আমি এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। এতে কোনো সন্দেহ রাখার অবকাশ নেই। আমি এই চূড়ান্ত ফলাফল মেনে নিয়েছি, যা সোমবারে অনুমোদন পাবে। আজ রাতে আমাদের জনগণের ঐক্যের স্বার্থে এবং আমাদের গণতন্ত্রের শক্তির কারণে আমি পরাজয় মেনে নিচ্ছি।”
বব ডল (১৯৯৬)
কানসাসের সিনেটর বব ডল ১৯৯৬ সালে বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে কৌতুক করে বলেন,
“আমি এলিভেটর দিয়ে আসার সময় চিন্তা করছিলাম, আগামীকালই হচ্ছে আমার জীবনের প্রথম দিন, যেদিন আমার কোনো কাজ নেই! আমি প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সাথে কথা বলেছি এবং তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি নির্বাচনী প্রচারণার সময় বারবার বলেছি, প্রেসিডেন্ট আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি আমার শত্রু নন। আমি তার শুভ কামনা করি এবং আমেরিকার কল্যাণের জন্য যেকোনো অবদান রাখতে আমি অঙ্গীকার করছি।”
এছাড়া রিচার্ড নিক্সন ১৯৬০ সালে জন এফ কেনেডির কাছে অল্প ব্যবধানে হারার পর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে আবার নিক্সন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নিক্সনের কাছে হেরে হুবার্ট হামফ্রেও অভিনন্দন জানান। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের হয়ে তার স্ত্রী ফার্স্ট লেডি বেটি ফোর্ড বক্তৃতা দেন।
নির্বাচনে পরাজিত হয়ে অভিনন্দন জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু এটা একটা প্রথা, ঐতিহ্য। বর্তমানের নির্বাচনগুলো দিন দিন অধিকতর নোংরা ও কদর্য রূপ নিচ্ছে। ভোটারদের মধ্যেও দূরত্ব বাড়ছে। বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তাই এই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ এটা শুধু প্রার্থীর জন্য পরাজয় মেনে নেওয়াই নয়, প্রার্থীর সমর্থকদেরও পরাজয় মেনে নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
This is a Bengali article written about concession speeches of US presidential elections. Necessary references are hyperlinked in the article.
References:
2. NPR
Featured Image: Carlos Barria / Reuters