Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোভিড–১৯ মহামারী এবং প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরেশিয়া অঞ্চলে ১৫টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে এগুলো থেকে আরো কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বৃহৎ রুশ ফেডারেশন, পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র ইউক্রেন, বেলারুশ ও মলদোভা, বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া ও এস্তোনিয়া, দক্ষিণ ককেশীয় রাষ্ট্র আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও জর্জিয়া এবং মধ্য এশীয় রাষ্ট্র তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান– প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসাবশেষের ওপর এই ১৫টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীতে আজারবাইজান থেকে আর্তসাখ (প্রাক্তন নাগর্নো–কারাবাখ), জর্জিয়া থেকে দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া, মলদোভা থেকে প্রিদনেস্ত্রোভিয়া এবং ইউক্রেন থেকে দনেতস্ক ও লুগানস্ক বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থলে বর্তমান স্বীকৃত, অস্বীকৃত বা স্বল্পস্বীকৃত মোট ২১টি রাষ্ট্র রয়েছে। এবং ২০২০ সালে বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতো এই সুবৃহৎ ভূখণ্ডেও আঘাত হেনেছে করোনাভাইরাস বা কোভিড–১৯ মহামারী।

কোভিড–১৯ মহামারীর আবির্ভাবের পর থেকেই একটি কথা বারবার শোনা যাচ্ছে। সেটির সারমর্ম হলো– মহামারীটি হয়তো শেষ হবে, কিন্তু মহামারীর আগে পৃথিবী যেমন ছিল, তেমন অবস্থাতে পৃথিবী আর কখনোই ফিরে যাবে না! স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, কর্মস্থল, শিক্ষা– প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই উক্তিটি প্রযোজ্য। একইভাবে উক্তিটি প্রযোজ্য ভূরাজনীতির ক্ষেত্রেও। আর ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রখ্যাত ব্রিটিশ ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ স্যার হালফোর্ড ম্যাকিন্ডারের ভাষ্যে, যে বিশ্বের হৃদভূমি (heartland) নিয়ন্ত্রণ করবে, সে-ই পৃথিবী শাসন করবে। পৃথিবীর হৃদভূমি হচ্ছে সুপ্রশস্ত ইউরেশিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চল, যেখানে প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলো অবস্থিত।

এই রাষ্ট্রগুলোতে কোভিড–১৯ মারাত্মক আঘাত হেনেছে। রাশিয়ায় মোট কোভিড–১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭ লক্ষাধিক, এবং সরকারি হিসাব অনুযায়ী সেখানে কোভিড–১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। বর্তমান রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন এবং রুশ রাষ্ট্রপতির ঘনিষ্ঠ সহযোগী দিমিত্রি পেশকভ উভয়েই কোভিড–১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন, যদিও বর্তমানে উভয়েই সুস্থ। প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোভিড–১৯ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বেলারুশ, যেখানে প্রায় ৬৫,০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। কাজাখস্তান ও ইউক্রেনে এই সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানে ২০,০০০–এর বেশি, মলদোভা ও উজবেকিস্তানে ১০,০০০–এর বেশি এবং অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রে এই সংখ্যা ১০,০০০–এর কম। কেবল তুর্কমেনিস্তানে কোনো কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগী নেই, কারণ তুর্কমেনিস্তানি সরকার কোভিড–১৯ এর অস্তিত্বই স্বীকার করতে নারাজ

মানচিত্রে প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রসমূহ; Source: The Guardian

প্রতিটি প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভূরাজনীতিতেই এই মহামারী তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে বা নিয়ে আসবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোতে কোভিড–১৯ মহামারীর কারণে প্রত্যক্ষভাবে যে ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। মহামারীর আগেও এই রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষভাবে সুবিধাজনক ছিল না, এবং মহামারীর কারণে তাদের দুর্দশা আরো বৃদ্ধি পাবে বলেই অর্থনীতিবিদদের ধারণা।

প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সৃষ্ট সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র রুশ ফেডারেশন কোভিড–১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এই মহামারীর কারণে রাশিয়া বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। চীনের উহান শহরে কোভিড–১৯ মহামারী দেখা দেয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাশিয়া চীনের সঙ্গে তার বিস্তৃত সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল, এর ফলে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে যে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য চলতো তাতে ব্যাঘাত ঘটে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতেই রুশ–চীনা বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার ফলে প্রতিদিন রাশিয়া ১০০ কোটি (বা ১ বিলিয়ন) রুবলের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল। মহামারীর কারণে পর্যটন খাত প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০২০ সালের মার্চেই রাশিয়ার এই খাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ২,৭০০ কোটি (বা ২৭ বিলিয়ন) রুবল। তদুপরি, মহামারীর ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা হ্রাস পায় এবং এই প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস নিয়ে রাশিয়া ও ওপেকের (Organization of Petroleum Exporting Countries, ‘OPEC’) মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ফলে সৌদি আরবের সঙ্গে রাশিয়ার ‘মূল্য যুদ্ধ’ (price war) শুরু হয় এবং এর ফলে রাশিয়া আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সর্বোপরি, মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য রাশিয়া জুড়ে লকডাউন জারি করার ফলে বাণিজ্যিক খাতে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে (ও হচ্ছে) এবং মহামারী মোকাবেলায় রুশ সরকারকে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, এর ফলে রুশ অর্থনীতিতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ণীত হয়নি। এক কথায়, কোভিড–১৯ মহামারী রাশিয়াকে একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

কোভিড–১৯ মহাকারীর কারণে রাশিয়ার অর্থনৈতিক দুর্যোগ (এবং এর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা) রুশ ভূরাজনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।প্রথমত, কোভিড–১৯ মহামারীর পূর্বেই পশ্চিমা বিশ্বের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ ও ব্যবস্থাগত দুর্বলতার জন্য রুশ অর্থনীতির পরিস্থিতি এমনিতেই তেমন ভালো ছিল না এবং মহামারীর ফলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে রাশিয়া যে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত, তাতে পিছিয়ে না থাকতে হলে রাশিয়ার একটি শক্তিশালী অর্থনীতি প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সঙ্কট রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতকে দুর্বল করে ফেলবে এবং বিদেশে রুশ হস্তক্ষেপের সামর্থ্য হ্রাস করবে।

মস্কোর রাস্তায় কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের ভিড়; Source: Anadolu Agency

দ্বিতীয়ত, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই রাশিয়া মধ্য এশিয়াকে নিজস্ব প্রভাব বলয় হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। এখন পর্যন্ত মধ্য এশিয়ায় রুশ সামরিক প্রভাব অপ্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীন মধ্য এশিয়ায় বিপুল বিনিয়োগের পাশাপাশি সেখানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিরও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোও কোভিড–১৯ মহামারীর ফলে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য তাদের বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন হবে। কিন্তু দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে রাশিয়া তাদেরকে খুব বেশি সাহায্য করতে পারবে না, স্বভাবতই এই রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য চীনের (এবং ক্ষেত্রবিশেষে পশ্চিমা বিশ্বের) মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হবে, যার ফলে মধ্য এশিয়ায় একচ্ছত্র প্রভাব বজায় রাখা মস্কোর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

তৃতীয়ত, একইভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি বেলারুশ, মলদোভা ও আর্মেনিয়া কোভিড–১৯ পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সহায়তা লাভ করবে না। ইতোমধ্যেই বেলারুশ ও মলদোভা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য আইএমএফ–এর (International Monetary Fund, ‘IMF’) দ্বারপ্রান্ত হতে বাধ্য হয়েছে। বেলারুশ রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্র (এবং রুশ–বেলারুশীয় ইউনিয়ন স্টেটের অংশ), আর্মেনিয়া রাশিয়ার চুক্তিবদ্ধ সামরিক মিত্র এবং মলদোভায় বর্তমানে একটি রুশপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন। কিন্তু তাদেরকে সহায়তা করতে না পারায় এই রাষ্ট্রগুলোতে রুশ প্রভাব হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

চতুর্থত, সম্প্রতি অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে উত্তর রাশিয়ায় অবস্থিত নেনেৎস স্বায়ত্তশাসিত জেলাকে পার্শ্ববর্তী আর্খানজেলস্ক প্রদেশের সঙ্গে একীভূত করার জন্য অঞ্চল দুইটির গভর্নর রাজি হয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেনেৎস স্বায়ত্তশাসিত জেলায় একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ‘নেনেৎস’রা রুশ উত্তর মেরু অঞ্চলে বসবাসকারী একটি ‘আদিবাসী’ (indigenous) জাতি এবং সোভিয়েত শাসনামলে তাদের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের অংশ হিসেবে তাদের জন্য ‘নেনেৎস স্বায়ত্তশাসিত জেলা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যেটির আয়তন প্রায় ১,৭৬,০০০ বর্গ কি.মি., যা বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। অঞ্চলটির জনসংখ্যার মাত্র ১৮% জাতিগত নেনেৎস এবং ৬৬% জাতিগত রুশ। কিন্তু অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসন বাতিলের আশঙ্কায় জেলাটিতে বসবাসকারী নেনেৎস ও রুশ উভয় জাতির মানুষই মহামারীকে উপেক্ষা করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে, যার ফলে গণভোটটি স্থগিত রাখতে রুশ সরকার বাধ্য হয়েছে।

এটি মস্কোর জন্য একটি অশনিসংকেত স্বরূপ। ১৯৯১ সাল থেকে মস্কো ছলে-বলে-কৌশলে বিশাল রাশিয়ার দূর-দূরান্তের বিভিন্ন প্রদেশের ওপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। রাশিয়ার যেসব অঞ্চলে জাতিগত রুশরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, এতদিন পর্যন্ত সেসব অঞ্চলেই কেন্দ্রবিরোধী মনোভাব সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু নেনেৎস জেলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী জাতিগত রুশরাও মস্কোর প্রতি ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে, যার অন্যতম কারণ হচ্ছে কোভিড–১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের অপর্যাপ্ত (ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত) পদক্ষেপ। এটি মস্কোর জন্য মারাত্মকভাবে বিপজ্জনক, কারণ এ ধরনের অসন্তোষ রাশিয়ার অন্যান্য প্রান্তীয় অঞ্চলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সঠিকভাবে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে রাশিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।

নেনেৎস স্বায়ত্তশাসিত জেলার একজন অধিবাসী অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসন বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসূচক ব্যানার প্রদর্শন করছেন; Source: Vk.com via Radio Free Europe/Radio Liberty

সর্বোপরি, কোভিড–১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য সঙ্কটের কারণে রুশ জনসাধারণের মধ্যে রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আস্থা হ্রাস পেয়েছে। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে এই বিপর্যয় থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করেছেন, যাতে মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যর্থতার দায় তার কাঁধে এসে না পড়ে। পুতিনের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে (যদিও তার জনপ্রিয়তা এখনো ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে)। সামগ্রিকভাবে, কোভিড–১৯ মোকাবেলায় রুশ সরকারের বেশকিছু ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেটি রাশিয়ার অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। এবং পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ভেতরে যেকোনো অস্থিশীলতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, এটা তো বলাই বাহুল্য।

রাশিয়া বাদে অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতেও কোভিড–১৯ মহামারীর নেতিবাচক ভূরাজনৈতিক প্রভাব লক্ষণীয়। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের রুটির ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত ইউক্রেন এই মহামারীর আগে থেকেই ভঙ্গুর অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে টালমাটাল অবস্থায় ছিল। কোভিড–১৯ মহামারীর আঘাতে রাষ্ট্রটির অর্থনীতি মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে এবং রাষ্ট্রটি আইএমএফের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ইউক্রেনীয় সরকারের ধারণা ছিল, কোভিড–১৯ মহামারীর ফলে রাশিয়ায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট মস্কোকে পূর্ব ইউক্রেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা প্রদান বন্ধ করতে বাধ্য করবে, কিন্তু মস্কো সেরকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পূর্ব ইউক্রেনের দনেতস্ক ও লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র দুইটিতেও কোভিড–১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও মস্কো তাদেরকে সহায়তা করছে। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কি পশ্চিমা বিশ্বের ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হতে ইচ্ছুক না হলেও কোভিড–১৯ মহামারী ইউক্রেনকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ওপর আরো নির্ভরশীল করে তুলবে (যেটি রাশিয়ার জন্য নেতিবাচক)।

ইউক্রেন ও রুমানিয়ার মধ্যে অবস্থিত প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র মলদোভায় প্রায় ১৮,০০০ মানুষ কোভিড–১৯ এ আক্রান্ত এবং ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মলদোভার মস্কোপন্থী সরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য ইতোমধ্যে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা গ্রহণ করেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে মলদোভার ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে রাষ্ট্রটিতে মস্কোর প্রভাব হ্রাস পাবে। এজন্যই মলদোভার অভ্যন্তরস্থ বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রিদনেস্ত্রোভিয়া প্রজাতন্ত্রে রাশিয়া তাদের সামরিক ঘাঁটি এখনো মোতায়েন রেখেছে, কারণ রুশ সৈন্য মোতায়েনকৃত আছে এমন কোনো বিবদমান রাষ্ট্রকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করবে না।

কোভিড–১৯ গ্রস্ত ইউক্রেনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাকর্মীরা একটি শিশুর চিকিৎসা করছেন; Source: UNICEF/2020/Maloletka

রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র বেলারুশ এবং আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বেলারুশীয় রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কোর কোভিড–১৯ মোকাবেলার পদ্ধতি ছিল অভিনব। ‘ইউরোপের সর্বশেষ একনায়ক’ হিসেবে পরিচিত লুকাশেঙ্কো বেলারুশে কোভিড–১৯ এর বিস্তৃতি সত্ত্বেও লকডাউন জারি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এর ফলে প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাশিয়ার পরে বেলারুশেই কোভিড–১৯ আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেলারুশ রাশিয়ার মিত্র রাষ্ট্র হলেও মহামারীর আগে থেকেই রুশ–বেলারুশীয় সম্পর্কে নানাবিধ দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। বিশ্বব্যাপী কোভিড–১৯ মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব বেলারুশেও পড়েছে এবং এই অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য রাশিয়ার সহযোগিতা গ্রহণ করার পরিবর্তে বেলারুশ আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। ধারণা করা যায়, কোভিড–১৯ পরবর্তী কালেও বেলারুশের পশ্চিমামুখী যাত্রা অব্যাহত থাকবে, যেটি হবে রুশ ভূরাজনীতির জন্য একটি বড় পরাজয়

প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত রাষ্ট্র তিনটি অর্থাৎ লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া এবং এস্তোনিয়ার অবস্থা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে ভালো। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোতে কোভিড–১৯ তেমন বিস্তার লাভ করেনি, যদিও রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি মহামারীর কারণে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু মহামারীর ফলে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে বড় ধরনের কোনো ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা সীমিত, কারণ রাষ্ট্রগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোটের সদস্য এবং দৃঢ়ভাবে পশ্চিমা প্রভাব বলয়ের অন্তর্গত। মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে তাদের এই অবস্থান আরো শক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

কোভিড–১৯ মহামারীতে আক্রান্ত লাতভিয়ার রাস্তায় মাস্ক পরিহিত জনসাধারণ; Source: Baltic News Network

দক্ষিণ ককেশাসে অবস্থিত প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্টগুলো কোভিড–১৯ মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে প্রায় একাকী হিসেবে আবিষ্কার করেছে। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আর্মেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং এই পরিস্থিতিতে তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে, কোভিড–১৯ এর আক্রমণ এবং যুগপৎ জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় আজারবাইজানের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জর্জিয়ায় এখন পর্যন্ত কোভিড–১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ১,০০০–এর কম, কিন্তু মহামারীর ফলে রাষ্ট্রটির ভঙ্গুর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো বেশি। আজারবাইজানের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রজাতন্ত্র আর্তসাখ আর্মেনিয়ার কাছ থেকে এবং জর্জিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রজাতন্ত্র দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সহায়তা লাভ করেছে, কিন্তু আর্মেনিয়া, আজারবাইজান বা জর্জিয়া সে তুলনায় কোভিড–১৯ মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য কোনো বৈদেশিক সহায়তা লাভ করেনি। রাষ্ট্রগুলো ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের জন্য আগ্রহী হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত তাদেরকে তেমন কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করেনি। এবং এর থেকে বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রগুলোর প্রান্তিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে কোভিড–১৯ মহামারী কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তানকে বেশ ভালোভাবে আঘাত করেছে এবং এর ফলে রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়েছে। বিশেষত উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তান থেকে প্রচুর মানুষ কাজের জন্য রাশিয়ায় যায় এবং তাদের প্রেরিত অর্থ এই রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতির অন্যতম একটি চালিকাশক্তি। মহামারীর ফলে এই চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এটি রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাজিকিস্তানের সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে কোভিড–১৯ মহামারীর বিস্তৃতির তথ্য গোপন করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে এবং তাদের অর্থনীতিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোভিড–১৯ মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রে তুর্কমেনিস্তান সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়েছে, কারণ তুর্কমেনিস্তানি রাষ্ট্রপতি গুরবাঙ্গুলি বের্দিমুহামেদভ তার রাষ্ট্রের করোনাভাইরাস বিস্তারের খবর সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এই মহামারীর খবর প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু নিউমোনিয়া এবং কোভিড–১৯ এর অন্যান্য লক্ষণ নিয়ে প্রচুর মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকায় তুর্কমেনিস্তানি সরকারের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থতার সম্মুখীন এবং অনেকের ধারণা, এই ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টা রাষ্ট্রটির একনায়ক বের্দিমুহামেদভের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে বরং আরো দুর্বল করে ফেলেছে।

একটি যৌথ সামরিক মহড়াকালে একজন চীনা ও একজন তাজিক সৈন্য; Source: Tajikistan Defense Ministry vis Eurasianet

মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলো প্রত্যেকেই কোভিড–১৯ মহামারীর কারণে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাদের বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন হবে। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত রাশিয়া এই সহায়তা প্রদানে সক্ষম হবে এরকম সম্ভাবনা কম, ফলে স্বভাবতই রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তার জন্য চীনের দ্বারস্থ হতে হবে। চীন ইতোমধ্যে মধ্য এশিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে এবং তাদের ওপর মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর নির্ভরতা এই প্রচেষ্টাকে আরো সাফল্যমণ্ডিত করবে। এমতাবস্থায় রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় তার ঐতিহ্যগত আধিপত্য ত্যাগ করে চীনের ‘জুনিয়র পার্টনারে’ পরিণত হবে, নাকি মধ্য এশিয়ার কতৃত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে নতুন একটি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে– সেটি দেখার বিষয়।

সামগ্রিকভাবে, কোভিড–১৯ মহামারী কেন্দ্রীয় ইউরেশিয়ায় রুশ ফেডারেশনের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ইউক্রেন, মলদোভা ও বেলারুশ অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে ক্রমশ পশ্চিমা বিশ্ব অভিমুখী হয়ে উঠবে, যদিও তাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত হয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে হয়ত সম্ভব হবে না। বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে দৃঢ়ভাবে পশ্চিমা বলয়ের অংশ হয়ে থাকবে। দক্ষিণ ককেশীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রান্তিক অবস্থানের কারণে কমবেশি একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে বাধ্য হবে। মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে চীনা অর্থনৈতিক প্রভাব ক্রমশ সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাবে রূপ নিয়ে সেখানে রুশ আধিপত্যকে হুমকির সম্মুখীন করবে। এভাবে কোভিড–১৯ মহামারী প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর ইতোমধ্যে পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক অবস্থানে আরো ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

This is a Bengali article about the upcoming geopolitical shifts in the post-Soviet states caused by the Covid-19 pandemic. Necessary sources are hyperlinked within the article.

Source of the featured image: RT Arabic

Related Articles