২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় 'আমেরিকা ফার্স্ট' পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
একটি রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে রূপরেখা অনুসরণ করে, সেটাই হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি। ডোনাল্ড ট্রাম্প 'আমেরিকা ফার্স্ট' পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে অন্যান্য দেশের সাথে বিদ্যমান সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করেছেন, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন চুক্তি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে দেশটিকে সরিয়ে নিয়েছেন।
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর অভিষেক ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প 'আমেরিকা ফার্স্ট' পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কয়েকটি দেশের সাথে বিদ্যমান মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করা এবং মিত্র দেশগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক দায়িত্বের দিকটি পুনর্মূল্যায়ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ২৩ জানুয়ারি এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে তিনি এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২টি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি ‘ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ (টিপিপি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন।
এরপর ২৭ জানুয়ারি এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে তিনি প্রথমে ছয়টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের উপরে নব্বই দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পরবর্তীতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আরও কয়েকটি দেশকে যুক্ত করা হয়। এই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলে বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আইনি লড়াই চলে। একই সপ্তাহে জারি করা আরও এক নির্বাহী আদেশে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিবাসীদের আগমন প্রতিহতকরণে যুক্তরাষ্ট্র–মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের লক্ষ্যে তহবিল ছাড়ের নির্দেশ দেন। সেই বছরের ৭ এপ্রিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে দেশটির জনগণের উপর রাসায়নিক অস্ত্র সারিন গ্যাস প্রয়োগের অভিযোগ তুলে ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সরকারি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত শায়রাত বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে মিসাইল হামলা পরিচালনা করে। ২০১৭ সালের ১৮ মে তার নির্দেশনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেশটির সাথে কানাডা এবং মেক্সিকোর মধ্যে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা ‘উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ (নাফটা) এর পরিবর্তে নতুন একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে পর্যালোচনা করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
সেই বছরের ২০ মে সৌদি আরব সফরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম বৈদেশিক সফর শুরু করেন। উক্ত সফরে ২৭ মে-র মধ্যে তিনি ইসরায়েল, দখলকৃত পশ্চিম তীর ভূখণ্ড, ভ্যাটিকান সিটি, ইতালি এবং বেলজিয়াম সফর করেন। সেই সফরে ট্রাম্প সৌদি আরবের সাথে বিপুল অঙ্কের সামরিক অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা দেন। ২১ মে পঞ্চাশটিরও বেশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার’ আহবান জানান। উক্ত সফরে ট্রাম্প ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিনের সাথে বৈঠক করেন। এছাড়া তিনি প্যালেস্টাইনিয়ান ন্যাশনাল অথোরিটির প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। উক্ত সফরের অংশ হিসেবে ২৫ মে ট্রাম্প বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কাউন্সিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক ও ইউরোপীয় কমিশনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কারের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর ব্রাসেলসে ‘উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট’ (ন্যাটো) এর সদরদপ্তরে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ট্রাম্প ন্যাটো সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রসমূহকে সংস্থার প্রতিরক্ষা ব্যয় নির্বাহের জন্য দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এর দুই শতাংশ অর্থ বরাদ্দের জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। এছাড়াও উক্ত সফরে ২৬ মে ইতালির তাওরমিনা শহরে অনুষ্ঠিত শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘গ্রুপ অব সেভেন’ (জি সেভেন) সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সেই সম্মেলনে সন্ত্রাসবাস, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য এবং রাশিয়া ইস্যুতে সাতটি দেশের নেতারা আলোচনা করেন।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা মাথায় রেখে কার্বন নিঃসরণের হার হ্রাস করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০১৭ সালের পহেলা জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি এই চুক্তিকে ‘মার্কিন সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ২০১৭ সালের ৫ জুন সৌদি আরব ও তার কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্র ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করা, তুরস্কের সাথে সামরিক সম্পর্ক হ্রাস করা, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন প্রদান বন্ধ করা, সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’র সম্প্রচার বন্ধ করা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করাসহ আরও কয়েকটি দাবি মানতে বাধ্য করতে কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এমন বিবাদমান পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রাথমিক পর্যায়ে সৌদি আরব ও তার কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্রের পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও তার প্রশাসন কাতারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে সবসময়ই তৎপর ছিল।
সেই বছরের ১৬ জুন ডোনাল্ড ট্রাম্প কিউবার উপরে ভ্রমণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও আরো কঠোর করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন হাভানায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তার সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিল। জার্মানির হামবুর্গ শহরে অনুষ্ঠিত সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ‘গ্রুপ অব টুয়েন্টি’ (জি টুয়েন্টি) সম্মেলনের অংশগ্রহণের পাশাপাশি ২০১৭ সালের ৭ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বহুল প্রত্যাশিত বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই বছরের ৮ আগস্ট প্রশান্ত মহাসাগরের অবস্থিত মার্কিন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল গুয়ামে উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকির জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। একই বছরের ২১ আগস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা উপস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে শৈশবে বাবা-মায়ের সঙ্গে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো অনিবন্ধিত অভিবাসীদের সহায়ক কর্মসূচি ‘Deferred Action for Childhood Arrivals’ (DACA) চালু করা হয়েছিল, যা ‘ড্রিমার্স’ নামে পরিচিত হাজার হাজার অভিবাসীকে শর্তসাপেক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার অনুমতি প্রদান করে। ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই কর্মসূচি ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে, ট্রাম্পের এই ঘোষণা দেশটির আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ প্রদান করেন। উক্ত ভাষণে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা এর মিত্রদের রক্ষা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ‘উত্তর কোরিয়াকে পুরোপুরি ধ্বংস’ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। একই বছরের ১২ অক্টোবর ‘জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা’ (ইউনেস্কো) এর বিরুদ্ধে ‘ইসরায়েলের বিপক্ষে পক্ষপাতমূলক আচরণ’ এর অভিযোগ তুলে সংস্থাটি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
২০১৫ সালে বিশ্বের ছয়টি পরাশক্তির সাথে ইরান পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে সম্মত হয়, যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে Joint Comprehensive Plan of Action to Congress (JCPOA) নামে পরিচিত। এই চুক্তির শর্তানুসারে, ইরান পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করতে সম্মত হয়েছিল, এবং চুক্তির শর্তসমূহ প্রতিপালনের জন্য ইরানের উপর বিভিন্ন সময়ে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে চুক্তি শর্তসমূহ মান্য না করার অভিযোগ তুলে মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের প্রতি ইরানের উপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা জারির আহবান জানান।
২০১৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইন সফরে ছিলেন। এই সময় দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা’ (অ্যাপেক) সম্মেলনে অংশ নেন। উক্ত সফরে তিনি ফিলিপাইনের ম্যানিলা’য় অনুষ্ঠিত ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থা’ (আসিয়ান) এর সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও আসিয়ান সম্মেলনের ফাঁকে ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের প্রতিনিধিদের সাথে একটি বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে এই চার দেশের নেতৃবৃন্দ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান’ নিয়েও কথা বলেন।
২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ–সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার তিন বছরেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল।
Language: Bangla
Topic: Donald Trump and his 'America First' policy
References:
1. Read Donald Trump's 'America First' Foreign Policy Speech - Time
3. Inaugural Address - whitehouse.gov
4. Presidential memorandum regarding withdrawal united states trans pacific - whitehouse.gov
5. Remarks president trump - nato unveiling article 5 and berlin wall - whitehouse.gov
6. Statement president Trump paris climate accord - whitehouse.gov
7. Remarks president Trump 72nd session united nations general assembly - whitehouse.gov
Feature Image: Tasos Katopodis/Getty Images