Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইকোশিয়া: এক বিলিয়ন গাছ লাগিয়েছে যে সার্চ ইঞ্জিন

ধরুন, আপনাকে বলা হলো ১ সেকেন্ডে আপনি কী করতে পারবেন? ভাবতে ভাবতেই এক সেকেন্ড চলে যাবে। এক সেকেন্ডে কী-ই বা করা সম্ভব! উসাইন বোল্ট হলে এক সেকেন্ডে দশ মিটার দৌঁড়াতে পারবেন। এক সেকেন্ডে আপনি এক থেকে পাঁচ অবধি গুণতে পারবেন। তিন বা চার অবধি লিখতে পারবেন। এক সেকেন্ডে পরিবেশের উন্নয়নে কোনো অবদান রাখতে পারবেন? একদম সোজা বাংলায় উত্তরটা হবে- না! কিন্তু, যদি বলি সম্ভব, তাহলে?

সত্যিই সম্ভব। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক একটি সার্চ ইঞ্জিন ০.৭৫ সেকেন্ডে লাগিয়ে ফেলছে একটি চারাগাছ! সেই সার্চ ইঞ্জিনের নাম ‘ইকোশিয়া।’ পৃথিবীতে যেভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হারে কমছে গাছপালা, উজাড় হচ্ছে বন। মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে একের পর এক বিলীন হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রধান উৎস। সচেতনতার অভাব কিংবা আমাদের অনীহায় পৃথিবী হারাচ্ছে সবুজ শোভা। হারিয়ে যাওয়া সুবাস ফিরিয়ে আনতে ইকোশিয়া এমন এক স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলছে যা আপনার-আমার কল্পনার জগতটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে। দিনশেষে এনে দেবে চমৎকার এক উপলক্ষ্য, পৃথিবীকে সবুজ করে গড়ে তোলার।

স্বপ্নচাষার গল্প

২০০৭ এর দিকের ঘটনা। জার্মানির নুরেমবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়াশোনা শেষ করে ক্রিশ্চিয়ান ক্রোল সিদ্ধান্ত নেন বিশ্ব ভ্রমণের। তবে সেটি নিছক চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে নয়। তার লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসায় সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। একেক দেশের পরিবেশ, চিন্তা-ভাবনা একেক রকম, যার প্রভাব পড়ে তাদের ব্যবসায়ে।

ভারত, থাইল্যান্ড ঘুরে নেপালে যান ক্রোল। সেখানে ‘জ্যাভেল’ নামক একটি সার্চ ইঞ্জিন চালু করেন। সার্চ ইঞ্জিনটি স্থানীয় এনজিওর জন্য তহবিল গঠনে সহায়তা করত। জ্যাভেলকে বেশি দিন চালিয়ে নিতে পারেননি। নেপালের বিদ্যুৎস্বল্পতা কাজে ব্যাঘাত ঘটাত। তাই শিগগির বন্ধ করে দেন জ্যাভেলের কার্যক্রম। পাড়ি জমান আর্জেন্টিনায়।

ইকোশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ক্রিশ্চিয়ান ক্রোল; image source: ecosia. zendesk. com

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল ঘন বনাঞ্চলের দেশ। মহাবন অ্যামাজনের অনেকটা অংশ আছে ব্রাজিলজুড়ে। মানুষজন অবাধে কাটছে গাছ, উজাড় করছে বন। এর প্রেক্ষিতে সেসব দেশে পুনরায় বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কয়েকমাস আর্জেন্টিনায় থেকে এসব সমন্ধে ধারণা নেন ক্রোল। তার জ্ঞানের পরিধি আরও বাড়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট থমাস এল. ফ্রাইডম্যানের ‘হট, ফ্ল্যাট, ক্রাউডেড – হোয়াই উই নিড অ্যা গ্রীন রেভ্যুলেশন‘ বইটি পড়ে। জ্যাভেল বন্ধ করলেও সেখান থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করার ভাবনা চেপে বসে ক্রোলকে। ভাবতে ভাবতেই মাথায় আসে বনায়নের কথা। দেশে ফিরে খুলে ফেলেন ইকোশিয়া।

থমাস এল ফ্রাইডম্যানের বই ‘ট, ফ্ল্যাট, ক্রাউডেড – হোয়াই উই নিড অ্যা গ্রীন রেভ্যুলেশন‘; image Source:  goodreads

ইকোশিয়া কী 

গুগলের মতো এটিও একটি সার্চ ইঞ্জিন। আপনার প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসা, জানা-অজানা কৌতূহল মেটাবে গুগলের মতো করে। ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর কোপেনহেগেনে জলবায়ু সম্মেলনে যার পথচলা শুরু। এরপর কেটেছে এগারো বছর। স্বপ্নের পরিধি ডালপালা মেলেছে, ছোট্ট চারাগাছেরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিকে কয়েকবছর বিভিন্ন সভা, সেমিনারে গাছের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলে গেছে টিম ইকোশিয়া। সেসব জায়গায় গাছ উপহার দিয়ে আসত। ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে নিতে থাকেন ক্রোল। ইয়াহু, বিং-এর মতো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। শুরু হয় এক চ্যালেঞ্জিং যাত্রা। আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য টিম শুম্যাকারকে সাথে নিয়ে নেমে পড়েন বনায়নে।

মাটি ফুঁড়ে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধায় বেড়ে উঠছে চারাগাছ; image source: pennypost. org. uk

এক অনবদ্য লড়াই 

“গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান” এই শ্লোগানের সঙ্গে আমরা ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। গাছ মানুষের বন্ধু, প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। প্রাথমিকে পড়ানো হয়- গাছ আমাদের ফুল, ফল, ছায়া দেয়। বড় হতে হতে প্রাথমিকের শিশুরা বুঝে ফেলে গাছ ফুল, ফল, ছায়ার ঊর্ধ্বে। গাছ আমাদের রক্ষাকবচ। ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিতে বনাঞ্চলের বিকল্প শুধুই বন। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে, পানিচক্র ঠিক রাখতে, দাবদাহের হাত থেকে রক্ষা করতে, প্রাণীকূলের জীবন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে গাছের বিকল্প নেই।

দিন দিন বিশ্বে মানুষ যত বাড়ছে, তত কমছে গাছ। গত বছর অ্যামাজনে লাগানো আগুনের কথা কেউ ভোলেনি এখনও। ব্রাজিল সরকারকে অনেকে দুষেছে এর পেছনে কলকাঠি নাড়ানোর হোতা হিসেবে। অথচ অন্য দিকে কেউ লড়ে যাচ্ছেন বন রক্ষায়।    

বুরকিনা ফাসোর ধূ ধূ প্রান্তর পরিণত হয় ঘন সবুজে; image source:  Screenshot 

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কখনো কখনো তার চেয়েও বড়। ক্রিশ্চিয়ান ক্রোল রঙ বদলানো পৃথিবীর ঝাঁ চকচকে আতিশয্যে ভেসে যায়নি, তার চিন্তায় ছিল গাছ, বন এবং অক্সিজেন। তাই ইকোশিয়া শুরুর পর যেসব অঞ্চলে বৃক্ষনিধনের হার বেশি, হোক তা মানবসৃষ্ট অথবা প্রাকৃতিক, সেসব অঞ্চলকে পুনরায় কীভাবে আগের রূপ ফিরিয়ে দেওয়া যায় তা ছিল ভাবনাজুড়ে। ব্রাজিলের জুরুয়েনা জাতীয় উদ্যান ও অ্যামাজনের এক ছোট্ট অংশে গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে যে যাত্রার শুভারম্ভ, একে একে ১৫টি দেশে ২০টি বৃক্ষরোপণ প্রজেক্টের সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে টিম ইকোশিয়া। ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, স্পেন, হাইতি, উগান্ডা, বুরকিনা ফাসো, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, ঘানা, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সেনেগাল ও মাদাগাস্কারে মোট ১ বিলিয়নের বেশি গাছ লাগিয়েছে তারা (লেখার এই পর্যায়ে আসা পর্যন্ত সংখ্যাটি ছিল ১০০,৪০০,৮০০… চলমান)। অ্যালেক্সায় ৩৯১ তম অবস্থানে থাকা ওয়েবসাইটটি কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালের এপ্রিলে বিজনেস কর্পোরেশন বা সংক্ষেপে বি-কর্পোরেশন সনদ লাভ করে। পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা অলাভজনক সংস্থাকে দেওয়া হয় এটি।

যেভাবে কাজ করে ইকোশিয়া

আমরা প্রতিনিয়ত কত কিছু সার্চ করি গুগলে। যেকোনো বিষয়ে জানতে সবার আগে ঢুঁ মারি বিশ্বখ্যাত এই সার্চ ইঞ্জিনে। ইকোশিয়াও গুগলের মতো তা এতক্ষণে জেনেছেন। ইকোশিয়ার মূল শক্তি এর ব্যবহারকারীরা। সার্চপ্রতি ইকোশিয়ার আয় ০.৫ সেন্ট (ইউরোর হিসেবে)। প্রতিটি গাছ লাগাতে কর্তৃপক্ষের গড় খরচ ০.২২ ইউরো। একজন ব্যবহারকারী ৪৫ বার সার্চ করলে টাকাটা উঠে আসে। ৪৫ বার সার্চ করার পর লাগানো হবে একটি গাছ। এরপর বাড়তে থাকবে সংখ্যা।

একজন ব্যবহারকারী কতটি গাছ লাগাতে সাহায্য করেছে তা সার্চবারের কোণায় গাছের আইকনের নিচে উল্লেখ থাকবে। ইকোশিয়া তাদের মোট লভ্যাংশের ৮০ শতাংশ ব্যয় করে গাছ লাগানোয়। ইকোশিয়ার হেড অফিসের ৩০ জন কর্মকতার অধীনে বিশ্বজুড়ে কাজ করে প্রায় দশ হাজার মানুষ। যেসব অঞ্চলে গাছ লাগানো হয় সেখানকার জনপ্রতিনিধি বা প্রভাবশালীদের হাতে থাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার। ২০০৯-এ শুরু করার পর এখন পর্যন্ত বৃক্ষরোপণে ব্যয় করেছে ১,২৮,৫৮,৭৭০ ইউরো। ইকোশিয়ার স্বপ্নবাজ দলটির লক্ষ্য ছিল কমপক্ষে এক বিলিয়ন গাছ লাগানো। ১৫টি দেশে ২০টি প্রকল্পের আওতায় ৯ হাজারেরও বেশি জায়গায় সেই মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেছে তারা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। এক বিলিয়ন গাছ লাগিয়ে ফেলেছে সার্চ ইঞ্জিনটি। বছরের শুরুতে অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল তারা, যখন ইকোশিয়াকে বিশ্বের ৪৭টি দেশে প্রধান সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। ক্রোম আর ফায়ারফক্সের মাধ্যমে একে অতি সহজে প্রধান ব্রাউজারে রূপান্তর করা যাবে।

ছাই থেকে সবুজে রূপান্তর হবে চারদিক, এমনটাই বিশ্বাস ক্রিশ্চিয়ান ক্রোলের; image source: trendland. com

ধরণীর রং সবুজ

আশি শতাংশ লভ্যাংশ যারা বিলিয়ে দেয় তারা কতখানি মানবিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে তারা দিয়েছিল একদিনের পুরো লভ্যাংশ। ২০২০ এর জানুয়ারির ২০ তারিখে ইকোশিয়া কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়- ২৩ জানুয়ারির সমস্ত ক্লিকের অর্থ দিয়ে লাগানো হবে গাছ। স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ দাবানলে থমকে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে দেবার লক্ষ্যে দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত নিউ সাউথ ওয়েলস এরিয়ায় শতাধিক প্রজাতির গাছ লাগানো হয়। করোনার ভয়ানক প্রকোপে সবকিছুর মতো ইকোশিয়ার সামাজিক বনায়নও থেমে আছে। একেবারে থেমে আছে তা বলার জো নেই। কয়েকটি দেশে খুব দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে সম্পন্ন করেছে গোটা বছরের গাছ লাগানোর টার্গেট। বাকি দেশগুলোতে ৩-৬ মাসের মধ্যে কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা তাদের।

একদিনের সমস্ত ক্লিকের অর্থ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গাছ লাগানোর নোটিশ; image source: ecosia. org

প্রযুক্তির উৎকর্ষে আমরা আধুনিক হচ্ছি, মিলছে ভোগবিলাসের চূড়ান্ত সুবিধা। তবে সবকিছুই বৃথা, যদি মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস না নিতে পারি! ইচ্ছে থাকলেও সময়ের অভাবে গাছ লাগানো হয়ে ওঠে না আমাদের। ইকোশিয়া সেই সুযোগ করে দিচ্ছে যেন! আপনার কাজ আপনি করছেন, করতে করতে করে ফেলছেন অপূর্ণ কাজটা- বৃক্ষরোপণ! কেবল বৃক্ষরোপণ বা বনায়নে সীমাবদ্ধ থাকছে না তা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তৈরি হচ্ছে বাসযোগ্য সতেজ এক ব্রহ্মান্ড। সবুজ পৃথিবীর সাক্ষী হতে হাতের মুঠোয় থাকা প্রযুক্তিকে নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ক্রোলের হাত ধরে যে বিপ্লবের শুরু হয়েছে এক দশক আগে, তাতে আজ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ মিলিয়ন, গাছের সংখ্যা প্রায় এক বিলিয়ন, এবং প্রতি মুহূর্তেই তা বাড়ছে! প্রতি ০.৭৫ সেকেন্ডে একটি করে গাছ লাগাচ্ছে ইকোশিয়া কর্তৃপক্ষ!

This is a Bengali article discussing about Ecosia search engine.

Feature Image: blog.ecosia.org

Related Articles