Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন ইরিত্রিয়ায় তাদের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দিচ্ছে?

বার্তা সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’–এর তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, পারস্য উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত (সংক্ষেপে ‘আল–ইমারাত’ বা ‘ইমারাত’) ‘আফ্রিকার শৃঙ্গে’ (Horn of Africa) অবস্থিত রাষ্ট্র ইরিত্রিয়ার আসাব ঘাঁটি থেকে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। লোহিত সাগরের তীরবর্তী বন্দর আসাবে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটি ছিল বিদেশে ইমারাতের প্রথম সামরিক ঘাঁটি, এবং ভূকৌশলগত দিক থেকে এই ঘাঁটিটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাহলে ইমারাতিরা ঘাঁটিটি থেকে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছে কেন?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আসাব বন্দরটি ‘বাব এল মান্দেব’ প্রণালীর অতি সন্নিকটে অবস্থিত, এবং এই প্রণালীর মাধ্যমে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগর পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালের মাধ্যমে এই প্রণালীটি কার্যত ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করে। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য বহনকারী বহু জাহাজ এই প্রণালী দিয়ে যাতায়াত করে, এবং এজন্য এর সন্নিকটে অবস্থিত আসাব বন্দরটির ভূকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে ইমারাত আসাবের যে ঘাঁটিটি ব্যবহার করছে, ১৯৩০–এর দশকে ইরিত্রিয়ার ‘ঔপনিবেশিক প্রভু’ ইতালি এই ঘাঁটিটির ভিত্তি স্থাপন করছিল। ১৯৮০–এর দশকে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নও এখানে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল।

২০১৬ সালে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় যে, ইমারাত ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে ২০১৫ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, এবং চুক্তি অনুযায়ী ইরিত্রিয়া ইমারাতকে আসাব ঘাঁটিটি ৩০ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছে। ইরিত্রীয় ও ইমারাতি সরকার এই তথ্যটিকে মিথ্যা হিসেবে অভিহিত করে, কিন্তু পরবর্তীতে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় যে, ইমারাত সত্যি সত্যিই আসাবে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে।

মানচিত্রে ইমারাত, ইরিত্রিয়া, ইয়েমেন এবং আসাব বন্দর; Source: GlobalSecurity.org

অবশ্য আসাবের ভূকৌশলগত গুরুত্বই এখানে ইমারাতের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মূল কারণ নয়। এখানে ঘাঁটি স্থাপনের মূল কারণ ছিল ইয়েমেন ও আসাবের মধ্যবর্তী ভৌগোলিক নৈকট্য। আসাব থেকে ইয়েমেনের দূরত্ব মাত্র ৭০ কি.মি. বা প্রায় ৪০ মাইল। এজন্য চলমান ইয়েমেন যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের সুবিধার্থে ইমারাতের নিকট এই ঘাঁটিটির প্রয়োজন ছিল।

২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরব রাষ্ট্রগুলোর একটি জোট ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ইমারাত এই জোটে অংশগ্রহণ করে। জোটটির মূল উদ্দেশ্য ছিল, ইয়েমেনের সৌদি–সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা এবং ইরানি–সমর্থিত ‘আনসার আল্লাহ’ (যারা ‘হুতি আন্দোলন’ বা ‘হুতি’ নামে পরিচিত এবং যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য জাইদি শিয়া) সশস্ত্র দলকে দমন করা। এই অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে ইমারাত ইরিত্রিয়ার কাছ থেকে আসাব বন্দরটি ইজারা নেয়, এবং ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বন্দরটিকে একটি বৃহৎ সামরিক ঘাঁটিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করে।

আসাব বন্দরের উন্নয়নের জন্য ইমারাত লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করে। তারা বন্দরটিকে গভীর করার জন্য খননকার্য পরিচালনা করে, শহরটিতে অবস্থিত জীর্ণ বিমানঘাঁটিকে পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করে তোলে এবং সেখানে ৩,৫০০ মিটার দীর্ঘ একটি রানওয়ে নির্মাণ করে, যাতে সেখানে ভারী পরিবহন বিমান অবতরণ করতে পারে। তারা সেখানে সৈন্যদের বসবাসের জন্য ব্যারাক নির্মাণ করে, বিমান রাখার জন্য হ্যাঙ্গার নির্মাণ করে, এবং ৯ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট ঘাঁটিটির সুরক্ষার জন্য এর চারদিকে সুরক্ষাবেষ্টনী নির্মাণ করে।

২০১৬ সালে প্রকাশিত আসাবে অবস্থিত ইমারাতি সামরিক ঘাঁটির একটি আনুমানিক মানচিত্র; Source: TesfaNews

এই ঘাঁটিতে ইমারাতি, ইয়েমেনি ও সুদানি সৈন্যরা অবস্থান করত। উল্লেখ্য, সুদান ২০১৯ সাল পর্যন্ত সৌদি–নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসেবে ইয়েমেনে যুদ্ধ করছিল, এবং হাজার হাজার সুদানি সৈন্য এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আসাবে অবস্থিত ইমারাতি ঘাঁটি ছিল সুদানি সৈন্যদের ইয়েমেনে যাওয়ার ট্রানজিট পয়েন্ট। ‘সুইফট–১’ নামক একটি জাহাজকে বেশ কয়েকবার আসাব থেকে ইয়েমেনের এডেন বন্দরে যাওয়া আসা করতে দেখা গেছে এবং জাহাজটি থেকে এডেনে সুদানি সৈন্যদের অবতরণ করতে দেখা গেছে। ২০১৬ সালে হুতিরা এই জাহাজটির ওপর আক্রমণ চালালে একটি জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ইমারাতি কর্মকর্তারা দাবি করেন যে, জাহাজটি সৈন্য পরিবহন করছে না, বরং ইয়েমেনে ‘মানবিক সহায়তা’ পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ইমারাতি কর্মকর্তাদের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন।

সৈন্য মোতায়েনের পাশাপাশি ইমারাতিরা আসাবে অবস্থিত ঘাঁটিতে প্রচুর ভারী অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করেছিল, এবং সেখান থেকে এই অস্ত্রশস্ত্র ইয়েমেনে প্রেরণ করত। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মতে, ইমারাত এই ঘাঁটিটিতে বিপুল সংখ্যক ফরাসি–নির্মিত ‘Leclerc’ ব্যাটল ট্যাঙ্ক, দক্ষিণ আফ্রিকান–নির্মিত ‘জি-৬’ সেল্ফ–প্রোপেল্ড হাউইটজার এবং রুশ–নির্মিত ‘বিএমপি–৩’ অ্যাম্ফিবিয়াস ফাইটিং ভেহিকল মোতায়েন করেছিল। এই ভারী অস্ত্রশস্ত্রগুলো পরবর্তীতে ইয়েমেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।

এসবের পাশাপাশি ঘাঁটিটিতে বহুসংখ্যক অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ড্রোন ও অন্যান্য ধরনের বিমান মোতায়েন করা ছিল বলেও বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। ঘাঁটিটির রানওয়ের কাছে অবস্থিত নতুন টারমাকের কাছে অনেকগুলো নতুন ক্যানোপি নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং ঘাঁটিটিতে একটি বৃহৎ চীনা–নির্মিত ড্রোনবহর মোতায়েন করা হয়েছিল। ইয়েমেনের হুতি নেতাদের হত্যা করার জন্য ইমারাতিরা এই ঘাঁটি থেকেই ড্রোন হামলা পরিচালনা করত।

ইয়েমেন যুদ্ধে ইমারাতি সৈন্যরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে; Source: alaraby.co.uk

শুধু তাই নয়, মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার–ইস্ট পলিসি’র ফেলো মাইকেল নাইটসের মতে, ইমারাতিরা আসাব ঘাঁটিতে যে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করেছিল, সেটি ছিল সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ফিল্ড সার্জিক্যাল হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি। এখানে ইয়েমেন যুদ্ধে আহত সৈন্যদের চিকিৎসা প্রদান করা হত। তদুপরি, ঘাঁটিটিতে ইয়েমেনের যুদ্ধবন্দিদেরও অন্তরীণ করে রাখা হতো বলে ধারণা করা হয়।

ইমারাতিরা আসাব ঘাঁটিটিকে কেবল ইয়েমেন অভিযানের জন্যই ব্যবহার করত না। লিবিয়ার জাতিসংঘ–স্বীকৃত ত্রিপোলিভিত্তিক সরকার দাবি করেছে, আসাব ঘাঁটি থেকে ইমারাতিরা অবৈধভাবে লিবিয়ার অভ্যন্তরে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লিবিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে ইমারাত খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’কে সমর্থন দিচ্ছে, এবং তাদেরকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে।

সামগ্রিকভাবে, আসাব ঘাঁটি ইমারাতের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি ঘাঁটি। কিন্তু ২০১৯ সালের জুনে ‘প্ল্যানেট ল্যাবস আইএনসি’র কাছ থেকে প্রাপ্ত স্যাটেলাইট ছবির ভিত্তিতে জানা যায়, একদল শ্রমিক আসাব ঘাঁটিতে নির্মিত অবকাঠামোগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে, এবং আসাব বন্দরের উত্তরে প্রচুর সরঞ্জাম সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ধারণা করা হয়, ঘাঁটিতে মজুদকৃত সামরিক সরঞ্জাম জাহাজে উত্তোলনের জন্যই ওভাবে বন্দরের উত্তর দিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।

ইমারাতি সেনাবাহিনীর একটি রুশ–নির্মিত ‘বিএমপি–৩’ অ্যাম্ফিবিয়াস ফাইটিং ভেহিকল। আসাব ঘাঁটিতে ইমারাতিরা এ ধরনের সরঞ্জাম মজুদ করেছিল; Source: Wikimedia Commons

পরবর্তীতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সংগৃহীত স্যাটেলাইট চিত্র থেকে জানা যায়, আসাব বন্দরে বহুসংখ্যক সাঁজোয়া যান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম জড়ো করে রাখা হয়েছে, এবং বন্দরটিতে একটি মালবাহী জাহাজও রয়েছে। পরবর্তীতে ৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রাপ্ত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, বন্দরটিতে সেসব সামরিক সরঞ্জাম বা জাহাজ কোনোটাই নেই। এর থেকে আন্দাজ করা যায় যে, ইমারাতিরা ঘাঁটি থেকে সমস্ত (বা অন্ততপক্ষে অধিকাংশ) সামরিক সরঞ্জাম জাহাজযোগে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

তদুপরি, ৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রাপ্ত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ঘাঁটিটির নবনির্মিত ক্যানোপিগুলো আর নেই। এছাড়া ফ্লাইট ট্র্যাকার ‘ফ্লাইটরাডার২৪’–এর প্রদত্ত তথ্যমতে, ইউক্রেনে নিবন্ধনকৃত একটি ‘আন্তোনভ আন–১২৪’ পরিবহন বিমান বেশ কয়েকবার আসাব থেকে ইমারাতের আল–আইন শহরে যাতায়াত করেছে। এই বিমানটি ইতিপূর্বে ইমারাতের সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, কিন্তু বর্তমানে ‘ম্যাক্সিমাস এয়ার’ নামক একটি ইউক্রেনীয়–ইমারাতি যৌথ কোম্পানি এই বিমানটি পরিচালনা করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বিমানটির বারবার আসাবে যাতায়াতও আসাব ঘাঁটি বন্ধ করার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এই ব্যাপারে ম্যাক্সিমাস এয়ার কোম্পানির আবুধাবি শাখা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

এর থেকে অনুমান করা যায় যে, ইমারাতিরা কার্যত পুরো আসাব ঘাঁটিটিকেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, এবং তারা ঘাঁটিটি বন্ধ করতে চলেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ইমারাতি বা ইরিত্রীয় কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রশ্ন হচ্ছে, এত অর্থ ব্যয় করে এবং এত রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা সামরিক ঘাঁটি ইমারাত কেন বন্ধ করে দিচ্ছে? এই প্রশ্নের শতভাগ সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, তবে বিশ্লেষকরা এ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ইয়েমেনে চলমান ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ইমারাতসহ সৌদি–নেতৃত্বাধীন জোট বহুলাংশে দায়ী; Source: Wikimedia Commons

প্রথমত, ইমারাত আসাবে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল প্রধানত ইয়েমেনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সুদানি সৈন্যদের প্রেরণের সুবিধার্থে। কিন্তু ইয়েমেনের যুদ্ধ ইমারাতের (বা সৌদি–নেতৃত্বাধীন জোটের) জন্য সহজ বলে প্রমাণিত হয়নি। প্রায় ছয় বছর যুদ্ধ পরিচালনার পরেও তারা ‘আনসার আল্লাহ’ গ্রুপটিকে দমন করতে পারেনি। যুদ্ধের ফলে আরব জোটের, বিশেষত ইয়েমেনে প্রেরিত সুদানি সৈন্যদলের, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তদুপরি, এই যুদ্ধের ফলে ইয়েমেনে একটি মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, এবং ইমারাত (ও সৌদি–নেতৃত্বাধীন জোট) বৈশ্বিক প্রচারমাধ্যমে নির্বিচারে বেসামরিক জনসাধারণের ওপর বিমান হামলা পরিচালনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইমারাতের একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি ফুটে উঠেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের গ্রীষ্মকালে ইমারাত ঘোষণা করে যে, তারা ইয়েমেন থেকে ধাপে ধাপে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে তারা ইয়েমেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন করে। জ্বালানি সংক্রান্ত বাণিজ্যিক পরামর্শদাতা সংস্থা ‘হরাইজন ক্লায়েন্ট অ্যাক্সেস’–এর নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যালেক্স অ্যালমেইডার মতে, ইয়েমেন যুদ্ধে ইমারাতিরা তাদের সহ্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। ইয়েমেনের জন্য এরচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ও সামরিক চাপ নিতে তারা অনাগ্রহী, এবং এজন্য তারা আকস্মিকভাবেই ইয়েমেন থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ইয়েমেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে ইমারাতের নিকট আসাব ঘাঁটির গুরুত্বও বহুলাংশে হ্রাস পড়েছে। বিদেশে এত বড় সামরিক ঘাঁটি চালু রাখা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এবং ইয়েমেন থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহারের পরিপ্রেক্ষিতে ইমারাতিরা আর এই বিরাট ঘাঁটি চালু রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। এজন্য তারা ঘাঁটিটি বন্ধ করে দিচ্ছে।

ইয়েমেনে মোতায়েনকৃত একজন সৌদি ও একজন ইমারাতি সৈন্য; Source: Australian Outlook

দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের শেষভাগে ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ অঞ্চলে অবস্থিত রাষ্ট্র ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার ও তিগ্রাই অঞ্চলের আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, এবং তিগ্রাই কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের নভেম্বরে অভিযোগ করে যে, ইরিত্রিয়ার আসাব ঘাঁটি থেকে ইমারাতি ড্রোন তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছে। অবশ্য তারা তাদের এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি, এবং ইমারাতি সরকারও এই দাবিটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।

কিন্তু বিশ্লেষকদের ধারণা, এই ঘটনাটি ইমারাতি সরকারকে আসাব ঘাঁটিটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য অতিরিক্ত উৎসাহ প্রদান করেছে। ইয়েমেনের জটিল যুদ্ধ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর নতুন একটি জটিল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কোনো আগ্রহ ইমারাতের নেই, এবং এজন্য আসাব ঘাঁটিটি বন্ধ করে দেয়া বা এর কার্যক্রম সীমিত করা তাদের জন্য আপাতদৃষ্টিতে বেশি লাভজনক।

তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক বেসরকারি ইন্টেলিজেন্স ফার্ম ‘স্ট্র্যাটফোর’–এর বিশ্লেষক রায়ান বোহলের মতে, ইমারাতিরা তুলনামূলকভাবে ভূরাজনীতির নতুন খেলোয়াড়, এবং নিজেদের অঞ্চলের বাইরে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখাকে তারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে। ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে তারা ‘হার্ড পাওয়ার’ (Hard Power) ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, এবং এজন্য বর্তমানে তারা তাদের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা (strategic ambitions) নিয়ন্ত্রণ করছে ও বহির্বিশ্বে তাদের সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করছে। আসাব ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়া এই প্রক্রিয়ারই অংশ।

সর্বোপরি, ২০১৯ সালে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যবর্তী উত্তেজনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরানিরা ইমারাতের জলসীমার কাছেই জাহাজের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করছে। এই পরিস্থিতিতে ইমারাতের জন্য নিকটবর্তী হুমকি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকা বেশি জরুরি। এজন্য তারা বহির্বিশ্বে তাদের সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করছে, এবং নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আসাব ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়া এই প্রচেষ্টারই অংশববিশেষ।

মানচিত্রে বহির্বিশ্বে ইমারাতি সামরিক ঘাঁটিসমূহ; Source: Debka

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস ইমারাতের সামরিকায়নের মাত্রা দেখে ইমারাতকে ‘ক্ষুদ্র স্পার্টা’ (Little Sparta) হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু ইমারাতিরা ইয়েমেনে তাদের সামরিক সম্প্রসারণের সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করতে পেরেছে। এর ফলে তারা ইয়েমেন থেকে তো সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেই, তদুপরি, আসাব ঘাঁটিটিও বন্ধ করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

কিন্তু এটি ভুলে গেলে চলবে না, বাব এল মান্দেব প্রণালীর ভূকৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম, ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ অঞ্চলে (বিশেষত ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়ায়) ইমারাতের বিস্তৃত স্বার্থ রয়েছে, লিবিয়ার যুদ্ধ এখনো চলমান এবং ইমারাত ইয়েমেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও সেখানে তাদের আঞ্চলিক প্রক্সিদের (বিশেষত এডেনভিত্তিক ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’) এখনো পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে যাচ্ছে। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, ইমারাতের সামরিক সম্প্রসারণ সাময়িকভাবে রুদ্ধ হলেও তাদের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখনো হ্রাস পায়নি।

এই পরিস্থিতিতে তারা কি সত্যিই আসাব ঘাঁটিটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেবে? এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত স্যাটেলাইট চিত্র থেকে জানা গেছে, ইমারাতি অ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলো এখনো আসাব ঘাঁটিতে অবস্থান করছে। এটি সম্ভব যে, ইমারাত আসাব ঘাঁটি পুরোপুরি বন্ধ না করে সীমিত মাত্রায় ঘাঁটিটির কার্যক্রম চালু রাখবে। কিন্তু আবার এটিও সম্ভব যে, তারা বিদ্যমান বাদবাকি ইউনিটগুলোকেও সরিয়ে নেবে এবং আসাব ঘাঁটিটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই।

Related Articles