Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুয়েজ খালে এভার গিভেনের ছয় দিন || শেষ পর্ব

(পর্ব ৫ এর পর) 

ক্যাপ্টেন কান্থাভেল ও তার ক্রুরা তখনো এভার গিভেনের ব্রিজে ছিলেন। তারা স্থান ত্যাগ করার জন্য মিসরীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষা করছিলেন। জাহাজ রাখা হয়েছিল সুয়েজ খালে প্রবেশের জন্য সামুদ্রিক যানবাহনের অপেক্ষা করার জায়গা গ্রেট বিটার লেকে। কান্থাভেল প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না দিলেও তার উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। বড় কোনো দুর্ঘটনার পর ক্যাপ্টেনদের কার্যক্রমের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। (এভার গিভেনের ক্রু সরবরাহ করা বার্নহার্ড শুলট শিপ ম্যানেজমেন্ট এক বিবৃতিতে জানায়, তাদের মাস্টারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা আছে, যিনি পুরোটা সময় জুড়ে পেশাদারিত্ব ও অধ্যবসায়ের সাথে কাজ করেছেন)।

১৩ এপ্রিল সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ মিসরীয় আদালত থেকে এভার গিভেনকে গ্রেফতার বা জব্দ করার অনুমতি পায়। এজেন্সিটি জানায় তারা জাহাজের মালিকপক্ষ শোয়েই কিসেন কাইশার কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ চাচ্ছে। মালিকপক্ষ অবশ্য এই প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করতে চায়নি।

এভার গিভেন আটকানোর কারণে বাণিজ্যে অনেক ক্ষতি হওয়ায় এর মালিকপক্ষের কাছে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ; Image Source: Maxar Technologies/AP

খাল কর্তৃপক্ষ দাবি করে আইনি অনুসন্ধানে দেখা গেছে জাহাজ মুক্ত করতে অভূতপূর্ব অপারেশনের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এর জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এগুলোর মধ্যে ২৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ভারের জন্য, স্যালভেজ বোনাস ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আরো ক্ষয়ক্ষতির জন্য ৩৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মাঝে ‘নৈতিক ক্ষতি’ও অন্তর্ভুক্ত আছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ মেটানো হচ্ছে, এভার গিভেন জাহাজ, এর কার্গো ও ক্রুরা কোথাও যেতে পারবে না।

২২ মে ইসমাইলিয়াতে খাল কর্তৃপক্ষ ও শোয়েই কিসেন কাইশার পক্ষের আইনজীবীরা জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে শুনানির জন্য হাজির হন। এখানে কয়েক পক্ষের স্বার্থ জড়িত ছিল। খাল কর্তৃপক্ষের দাবি করা প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা যদি আদায় করতে হয়, তাহলে এর দায় কেবল জাপানি কোম্পানির একার ওপরই পড়বে না, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সামুদ্রিক বীমা কংলোমারেট কোম্পানিদের ওপরও পড়বে। যেকোনো মীমাংসার ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেকেরই বক্তব্য থাকবে। গ্রেট বিটার লেকে তখনো ১৭ হাজারের বেশি কার্গো কন্টেইনার পড়ে ছিল। চলমান আইনি প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য নাইকি আর লেনোভোও আইনজীবীদের পাঠায় ইসলামিয়াতে।  

সেদিন সকালে আদালত পাড়ায় খবর ছড়িয়ে পড়ে এভার গিভেনের মালিকপক্ষ আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রভাবশালী আইনজীবী আশরাফ এল সোয়েফিকে নিয়োগ দিয়েছে খাল কর্তৃপক্ষের দাবির বিপক্ষে লড়ার জন্য। শুনানি শুরু হয় বেলা ১১টায়। চার জন বিচারকের সামনে ডজনখানেক আইনজীবী ধাক্কাধাক্কি করে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকে একই ভঙ্গিতে তাদের বক্তব্য পেশ করেন। প্রথমে একজন আইনজীবী এসে নিজের নাম বলে তার মক্কেলের মামলা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। এতে তার কথার সুর চড়া কণ্ঠের হয়ে থাকে এবং তিনি হাত নাড়িয়ে চিৎকার করে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তখন সকলে একসাথে কথা বলা শুরু করেন যতক্ষণ না পরবর্তী উকিল তার বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান। এরপর একই প্রক্রিয়া পুনরায় চলতে থাকে।

জাহাজ উদ্ধারের জন্য কাজ করছেন কর্মীরা; Image Source: Suez Canal Authority/EPA-EFA/Shutterstock

সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের আইনজীবী দাবি করেন এভার গিভেনকে উদ্ধার করার কাজ প্রায় একাই সামাল দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাই তাদের এক বিলিয়ন ডলার চাওয়া খুব বেশি কিছু নয়। তিনি আরবিতে বলেন, উদ্ধার কার্যক্রম না হলে আমরা এক বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে পারতাম।

দ্রুতই এল সোয়েফির পালা। কুঁজো অবস্থায় কম্পমান হাত নিয়ে হাঁটা সোয়েফি বাকি আইনজীবীদের তুলনায় বয়স্ক ছিলেন। অন্যরা তার তুলনায় লম্বা হলেও সোয়েফির আলাদা মর্যাদা ও গাম্ভীর্য ছিল।

এল সোয়েফি ধীরে ধীরে বলেন, সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের বীরত্ব নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করতে পারবে না। কিন্তু তার প্রশংসার পরই ছিল আকস্মিক আক্রমণ। তিনি ব্যাখ্যা করেন শোয়েই কিসেন কাশাইয়ের পক্ষ থেকে এজেন্সির সাথে মীমাংসা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটাতে তারা ব্যর্থ হয়। খাল কর্তৃপক্ষের বাধার মুখে তিনি বলেন, তার কাছে এভার গিভেনের ভয়েজ ডেটা রেকর্ডারকে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

তিনি বলেন, এতে যা পাওয়া গেছে তা ‘বিশৃঙ্খলা’ ছাড়া কিছু নয়। “এগিয়ে যান, না যাবেন না। বাতাস জোরে বইছে, না বাতাস ঠিক আছে।” এল সোয়েফির বক্তব্য অনুযায়ী পাইলটরা একে অন্যের সাথে তর্কে লিপ্ত ছিল আর একে অন্যকে গালি দিচ্ছিল। তাদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তাদের একজন জাহাজ ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। প্রকাশ্যে কেউ তখনই প্রথমবার উত্থাপন করেন যে, এই দুর্ঘটনার পেছনে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও থাকতে পারে।

গর্বিত মিসরীয় এল সোয়েফি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে এই বিতর্কে জড়াতে হচ্ছে। তিনি বলেন, “আমি এগুলো বলতে চাচ্ছিলাম না। আমি খুবই লজ্জিত। এই জলপথ আমাদের সবার।”

আশরাফ এল সোয়েফি; Image Source: elswey.com

তিনি আদালত কক্ষের বাইরে আসেন, সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরে। তিনি ফেস মাস্ক খুলে ধৈর্য্যের সাথে এক হাতে ফোনে কথা বলতে বলতে অন্য হাত দিয়ে সিগারেট ধরান। ব্লুমবার্গ বিজনেসউইকের পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ইংরেজিতে বলেন, “আমার একটা নীতি আছে। আমার সব বক্তব্য আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়।” জাহাজের ভিডিও আর অডিওর পুরো কথোপকথন কি প্রকাশ করা হবে? তিনি জবাব দেন, “আমাকে দিয়ে হবে না।”

শেষপর্যন্ত বিচারকরা মামলাটিকে অন্য কোর্টে চালান করে দেয়। সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ তাদের ক্ষতিপূরণের দাবি কমিয়ে ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নিয়ে আসে। এই গল্প মিডিয়াতে চলে আসলে এভার গিভেনের বীমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঘোষণা দেয় তারা এই দ্বন্দ্ব নিরসনে একটা ‘নীতিগতভাবে চুক্তি’তে পৌঁছেছে, যা প্রকাশ্যে জানানো হবে না। চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেলেও মিসরের বাইরে সম্ভবত দীর্ঘস্থায়ী আইনি প্রক্রিয়া এখনো চলছে। শোয়েই কিসেন কাইশার পক্ষ থেকে লন্ডনের অ্যাডমিরালটি আদালতে যেকোনো মামলা থেকে এর ক্ষতিপূরণের কমানোর জন্য আবেদন করা হয়, যেখানে বড় অঙ্কের মেরিন মামলাগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এভার গিভেনকে পুনরায় ভেসে যেতে দেখছে উৎসুক জনতা; Image Source: Mahmoud Khaled/Getty Images

বাদী পক্ষের তালিকায় ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে ১৬টি পক্ষ ছিল। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল সুয়েজে আটকা পড়া অন্যান্য জাহাজের মালিকরা। এছাড়া মালিকপক্ষ, বীমাকারী প্রতিষ্ঠান, পুনর্বীমাকারী প্রতিষ্ঠানদের (যারা বীমাকারী প্রতিষ্ঠানদের অতিরিক্ত দেনা থাকলে আর্থিকভাবে সাহায্য করে) মধ্যে আর্থিক দায়বদ্ধতা নিয়ে মামলা চলছে। চক্রাকারে চলতে থাকা মামলাগুলো কয়েক বছর ধরে চলতে পারে।

গত জুলাই মাসে মুক্তি পাওয়ার আগে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে গ্রেট বিটার লেকে ক্যাপ্টেন কান্থাভেল ও তার ক্রুরা জাহাজ নিয়ে আটকা ছিলেন। ইউনিয়ন কোয়ালিশন আন্তর্জাতিক পরিবহন কর্মী ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী এই সময়টাতেও তারা তাদের পারিশ্রমিক বুঝে পাচ্ছিলেন। ক্রুদের নয় জনকে ভারতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।      

গত মে মাসে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের হেডকোয়ার্টারে ব্লুমবার্গের সাথে সাক্ষাৎকারে এলসাইদ তার অদ্ভুত ভূমিকার কথা মনে করছিলেন। নেভিতে থাকার সময় তিনি অপারেশন বদর নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, যেটা ছিল ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধ শুরু করার জন্য মিসরীয় বাহিনীকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে সুয়েজ পার হয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা করার একটা উদ্ভাবনী পরিকল্পনা। তার কার্যক্রম ঠিক সেরকম না হলেও খাল কর্তৃপক্ষ ছয় দিনের মধ্যে এভার গিভেনকে পুনরায় ভাসাতে পেরেছে। তিনি হাসতে হাসতে বলছিলেন, “এটাকেও অপারেশন বদরই বলা যায়।”  

Related Articles