সিআইএ, মোসাদ, এমআই-সিক্স কিংবা র- এসব নামের সাথে আপনি আগে থেকেই পরিচিত থাকতে পারেন, কারণ এগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে তুখোড় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নাম। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে এসব গোয়েন্দা সংস্থার নাম বার বার উঠে আসে বিশ্ব-মিডিয়ায়। পৃথিবীজুড়ে এসব সংস্থার চালানো বিভিন্ন অপারেশনের বর্ণনা পড়ে উত্তেজনায় আপনার গা শিউরে উঠতে পারে। আপনি অবাক হয়ে যেতে পারেন বিভিন্ন ঘটনার পেছনে এদের কলকাঠি নাড়ানোর কেচ্ছা শুনে।
আধুনিক সময়ে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই একটি কার্যকরী ও দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া চলা সম্ভব নয়। আপনার প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেখানে সবসময় আপনাকে কোণঠাসা করতে ব্যস্ত, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের ছক কষা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তখন গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে। কূটনীতিকদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার টেবিলে বসিয়ে দিলেই সব স্বার্থ উদ্ধার হয়ে যাবে– এমনটা ভাবলে আপনি বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। এছাড়া আপনার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ফাইল যাতে বাইরের রাষ্ট্রের কেউ কোনোভাবেই নিজেদের আয়ত্বে না আনতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতেও আপনার হাতে একটি তুখোড় গোয়েন্দা সংস্থা রাখতে হবে।
১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষ– প্রতিটি ঘটনার পরেই ভারতে জাতীয়তাবাদের জোয়ার উঠেছে। ভারতের মিডিয়া নিহত তরুণ জোয়ানদের আত্মত্যাগের বিষয়টিকে সামনে এনে জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডায় সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু প্রতিবারই দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষে তরুণ জোয়ানদের নিহত হওয়ার পেছনে যে গোয়েন্দা সংস্থার ও সামরিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা ফুটে উঠেছিল, সেটিকে আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে কিংবা সেটি নিয়ে উচ্চবাচ্য কম করা হয়েছে সবসময়।
১৯৬২ সালের আগে চীন এবং ভারতের মাঝে বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয়নি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত, অপরদিকে কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরে ১৯৪৯ সাল থেকে নতুন যাত্রা শুরু করে চীন। দুটি দেশই দুটি প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী, যদিও সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর পালাবদল ঘটেছে। ১৯৫০-এর দশকে দুটি দেশেরই প্রধান নেতারা নিজেদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রেখে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিব্বত নিয়ে মতপার্থক্যের সূচনা হলেও শেষ পর্যন্ত তা সামরিক সংঘাতের দিকে গড়ায়নি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর 'ফরওয়ার্ড পলিসি'র অধীনে বিতর্কিত অঞ্চলগুলোতে একের পর এক চেকপোস্ট নির্মাণ ও সেনা সমাগম ঘটনা ক্ষুদ্ধ করেছিল চীনাদের। ভারতকে একটি 'উচিত শিক্ষা' দেওয়ার নিমিত্তেই চীন ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর বর্তমান অরুণাচল ও আকসাই চীনে হামলা শুরু করে। চীনের পিপলস' লিবারেশন আর্মি পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েই আক্রমণ করে ভারতের চেকপোস্টগুলোতে। ভারতের সেসময় যুদ্ধ করার জন্য না ছিল পূর্বপ্রস্তুতি, দুর্গম পরিবেশে টানা লড়াই করার মতো রসদ, না ছিল অভিজ্ঞতা। সব মিলিয়ে ভারতকে অপমানজনকভাবে পরাজয় বরণ করতে হয় চীনের কাছে।
ভারতের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে তাদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেন্ডারসন ব্রুক্স ও ব্রিগেডিয়ার প্রেমিন্দ্র সিং ভগতকে দায়িত্ব দেয়া হয় একটি তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করার জন্য। ব্রুক্স-ভগত রিপোর্টে ভারতের পরাজয়ের যেসব কারণ জানা যায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যর্থতা।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ফরওয়ার্ড পলিসি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিপদজনক একটি নীতি। বিতর্কিত সীমানায় যেহেতু সেনাসমাগম ঘটানো হচ্ছিল, তাই চীনের প্রতিক্রিয়ার উপর যথাযথভাবে নজরদারি করার মতো দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা থাকা দরকার ছিল তার। বলে রাখা ভালো, তখনও ভারতের 'রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং' বা 'র' গঠন করা হয়নি। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি-এর উপরেই ভারত ও ভারতের বাইরে গোয়েন্দাগিরির দায়িত্ব অর্পিত ছিল।
সেই সময়ে আইবির ডিরেক্টর বিএম মল্লিক বার বার নেহরুকে অবগত করেছিলেন যে চীনারা তার 'ফরওয়ার্ড পলিসি'র প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। অর্থাৎ ভারত বিতর্কিত সীমানায় সৈন্য সমাবেশ ঘটানো কিংবা চেকপোস্ট নির্মাণ অব্যহত রাখলেও চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি সামরিক সংঘাতে জড়াবে না। এই অভয়বাণীই প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে তার ফরওয়ার্ড পলিসি অব্যাহত রাখতে আশা যোগায়।
কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, আইবি ডিরেক্টর বিএম মল্লিকের কথা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে বিক্ষুব্ধ চীনারা আকসাই চীন ও বর্তমান অরুণাচল, দুদিক থেকেই ভারতকে আক্রমণ করে বসে। ভারতকে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত করে, যার কিছুটা হলেও দায় কোনোভাবেই আইবি এড়িয়ে যেতে পারে না। চীনারা '৬২ সালের আগে থেকেই বিতর্কিত সীমানাগুলোতে নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়ে যাচ্ছিল, যেটিকে আগাম সংকেত হিসেবে পাঠ করতে ভারতের আইবি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এখানে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতাকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। চীন বার বার ভারতের আগ্রাসী কর্মকান্ডের জন্য সতর্ক বার্তা দিচ্ছিল, কিন্তু ভারত সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি। কূটনৈতিকভাবেও ভারত যুদ্ধের আগে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
১৯৯৯ সাল। প্রতিপক্ষ এবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। এর আগেও যুদ্ধ হয়েছে দুটি দেশের মাঝে। কিন্তু এবারের যুদ্ধ আগেরগুলো থেকে অনেক আলাদা। এবারের যুদ্ধ সমতল ভূমি থেকে অনেক উপরের পার্বত্য এলাকায়, যেখানে সেনাদের টিকে থাকতেই প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিকূল জায়গাগুলোর একটিতে দুটো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের লড়াই পুরো বিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়।
যদিও কারগিল যুদ্ধে ভারতের বিজয় আসে, কিন্তু ভারতের অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের অতর্কিত আক্রমণ অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। পাকিস্তান যেভাবে আক্রমণ চালিয়েছিল, তাতে প্রস্তুতির জন্যও কয়েক মাস সময় প্রয়োজন। কারণ দুর্গম পার্বত্য এলাকায় সামরিক সৈন্যের সমাগম ঘটানো কিংবা অস্ত্রশস্ত্রের বিশাল সম্ভার সরবরাহ করার কাজ হুট করে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এছাড়াও পাকিস্তানি সৈন্যরা ছদ্মবেশে সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে, যেটি র, আইবি কিংবা ভারতের সেনাবাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর নিজস্ব সোর্স থেকে আভাস পাওয়া গিয়েছিল, পাকিস্তানীরা সীমান্তে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই সোর্সের খবর যাচাই করার জন্য সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সীমান্ত এলাকায় নজরদারিও বাড়ানো হয়নি। যেটির মূল্য চুকাতে হয়েছে অনেক তরুণ জোয়ান এবং মিলিটারি অফিসারের মৃত্যুর মাধ্যমে।
কারগিল যুদ্ধের পর ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা পরীক্ষা করে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভবিষ্যতের জন্য নির্দেশনা প্রদান করার জন্য কারগিল রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়। ভারতের ইতিহাসে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর করা এটিই একমাত্র রিপোর্ট, যেটি জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। কমিটির রিপোর্টে পাকিস্তানের আক্রমণের পেছনে যথারীতি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উপর দোষ চাপানো হয়। তবে রিপোর্টে যে প্রস্তাবগুলো সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলো পরবর্তীতে গ্রহণ করা হয়। এতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন আসে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও বেশি জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয়, সংস্থাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি ভারতের সাথে চীনের যে সংঘর্ষ হয়েছে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায়, এই ঘটনাতেও অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা আঙুল তুলেছেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দিকে। ভারত-চীন এলএসি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) সীমান্তে ভারতের নজরদারি করার বহুমুখী উপায় রয়েছে। নিজস্ব ইনফর্মার আছে, মিলিটারি স্যাটেলাইট আছে, স্কাউটরা আছে, ইসরায়েলের দেয়া ড্রোন আছে। এত কিছুর পরও চীনের সৈন্যরা ভারতের সীমানায় প্রবেশ করে সরকারি হিসাব মতে ২০ জন ভারতীয় সৈনিককে পিটিয়ে মারলো, আরও অনেককে আহত করলো– এতে আশ্চর্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে, সংঘর্ষের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকেই চীনা সৈন্যদের চলাচলের খবর পাওয়া যাচ্ছিল, যেগুলোকে ভারতের সেনাবাহিনী ঠিকমতো গুরুত্ব দেয়নি। বরাবরের মতো এবারও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চীনের উপর সঠিকভাবে নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৯৯ সালের কারগিল সীমান্ত সংঘর্ষের পর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তায় যে বিশাল পরিবর্তনে ঢেউ লেগেছিল, তা ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে সুফল বয়ে এনেছে। ভারতের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন শুরু হয়েছে ১৯৬২'র ইন্দো-চীন যুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকে। সেই যুদ্ধের পর ভারত তার পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন এনেছে, কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে, আবার কোনোক্ষেত্রে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা মাথায় রেখে বাস্তবসম্মত থাকার চেষ্টা করেছে। চীনের সাথে আগে যেখানে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ছিল, এখন সেখানে দুটো দেশ একে অপরের চরম শত্রু। তবে ভারতের প্রতিটি জাতীয় সংকটের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
This Bengali article discusses about the failure of Indian intelligence agencies in different crisis moments in the history of India.
Reference:
1. China Is Taking Advantage of India’s Intelligence Failures
2. Repeated intelligence failures: Time to worry
3. Galwan Valley incident is a failure of India's intelligence system