Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পশ্চিমবঙ্গের ‘সেরা বাঙালি’ পুরস্কারের যৌক্তিকতা কী?

বেশ কিছুকাল যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের একটি নামি সংবাদ সংস্থাকে দেখা যাচ্ছে দেশ-বিদেশ থেকে সেরা বাঙালিকে খুঁজে তাদের পুরস্কৃত করতে। প্রতি বছর বেশ ঘটা করে একটি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী বাঙালিদের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত করে তাদের সম্মানিত করা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যম সংস্থা এমন গ্ল্যামার-সর্বস্ব একটি অনুষ্ঠান করে দশ জন দিকপালকে সর্বসমক্ষে সম্মান জানাবে, ব্যবসায়িক দিক থেকে তার প্রতি কোনও ওজর-আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু ‘সেরা বাঙালি’ ব্যাপারটার প্রতি একটি অনীহা জন্মায়। মেধাগতভাবে বিশ্লেষণ করলে এই ধরনের অনুষ্ঠানের সার্থকতা কী?

একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে সেরা মানুষকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায়? ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এরকম কোনও পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে কী না আমাদের জানা নেই। ‘সেরা বিহারি’ বা ‘সেরা তামিল’ নামক কোনও পুরস্কারের নাম তো কানে আসেনি এখন পর্যন্ত। তবে কেন সেরা বাঙালি? আর কে-ই বা সেই সেরা বাঙালিকে খুঁজে বের করার গুরুদায়িত্ব দিল এই বিশেষ সংবাদ সংস্থাটিকে? কীসের নিরিখেই বা মনোনীত হচ্ছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘সেরা বাঙালি’রা?

ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী; Source: Twitter handle of Sourav Ganguly @SGanguly99

যে সমাজে ‘প্রতিযোগিতা’ ব্রাত্য, সেখানে ‘সেরা’কে কীভাবে খোঁজা হয়?

এই সেরা বাঙালির খোঁজ পশ্চিমবঙ্গের সমাজের একটি অসঙ্গতিকে প্রকট করে। ভারতের বঙ্গীয় সমাজ বরাবরই প্রতিযোগিতা বিমুখ। চলচ্চিত্র, খেলাধুলা, রাজনীতি নানা ক্ষেত্রেই বাঙালি একটি নিয়েই সন্তুষ্ট এবং বিকল্প খুঁজে বের করার বিশেষ তাগিদ সে কোনোদিনই বোধ করেনি।

রবীন্দ্রনাথ বা উত্তমকুমার বা সত্যজিৎ রায় বা সৌরভ গাঙ্গুলি বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- বাঙালি একজনকে খুঁজে তার মাথায় চিরকালের মতো শ্রেষ্ঠত্বের রাজমুকুটটি বসিয়ে দিয়েছে নির্দ্বিধায়। বিকল্প চিন্তাধারার কোনো অবকাশ তার মাথায় তেমন একটা আসছে না। এমনকি যে সংবাদ সংস্থাটির কথা বলা হচ্ছে সেটিও পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রায় একচ্ছত্র অধিপতি। তা যে সমাজে প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংস্কৃতিরই বিশেষ কদর নেই, সেখানে সেরা খুঁজে বের করার অনুশীলনটি বেশ ফাঁপা ঠেকে। সেরা মানে যে বাকিদের হারিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা পায়। বাঙালির ক্ষেত্রে সেই বাকিরা কারা বা কোথায়? শুধুমাত্র মনোনয়ন পেয়েই সেরা হওয়া যায়?

প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়; Source: Twitter @FilmHistoryPic

সেরা বাঙালিকে খোঁজার এই প্রয়াস আসলে এক ধরনের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রকট করা

দ্বিতীয়ত, এই ‘সেরা বাঙালি’র মধ্যে দিয়ে বাঙালির এক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদও প্রকট হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনীয়তা কী? যে সম্প্রদায় বা সংস্কৃতি সত্যি সত্যিই বিশ্বায়নের চরাচরে নাম করেছে, প্রভাব ফেলেছে- তাকে নিজেদের মধ্যে সেরা কে তা খুঁজে বের করার কী স্বার্থকতা? রবীন্দ্রনাথের নাম তো এই ব্রহ্মাণ্ডের সবাই শুনেছে, কিন্তু তাকে তো ঘটা করে সেরার তকমা দিতে হয়নি তার গুরুত্ব বোঝাতে? আজ যাদের এই অনুষ্ঠানটিতে ডেকে পুরস্কার দেওয়া হয়, তারা কেউই অখ্যাত নন- কম বেশি তাদের নাম জানে সবাই বা অনেকেই। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে যশস্বী এই মানুষগুলিকে ডেকে তাদের মধ্যে সেরাকে খুঁজে বের করার কী প্রয়োজন, তা মগজে ঢোকে না।

প্রয়াত অভিনেতা শশী কাপুরের সঙ্গে কিংবদন্তি বাঙালি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়; Source: Twitter @bethlovesbolly

আসলে এই সেরার শিরোপা বাঙালির অস্তিত্বরক্ষার আকুতি। ব্যক্তিত্বের যশকে ভাঙিয়ে একটি সম্প্রদায়ের সার্বিক নাম কেনার এক তাগিদ। বাঙালি বলে ব্যক্তির পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে এক জাতীয়তাবাদী আইডেন্টিটির নির্মাণ। প্রশ্ন হচ্ছে, যে সম্প্রদায় তার মেধার জন্যে সুপরিচিত; দেশ-বিদেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে আপন কৃতিত্বের জোরে, তার কি এই আইডেন্টিটি নির্মাণের আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে? ভারতের গুজরাটি সম্প্রদায়ের মানুষের পরিচয় তো আজ তাদের ব্যবসায়িক প্রজ্ঞার জোরে দুনিয়াজুড়ে আলোচিত। তাদের জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের নির্মাণ তো তৈরি হয়েছে সেই প্রজ্ঞার জোরেই। সেখানে ‘সেরা গুজরাটি’ পুরস্কার প্রদান করে তো বিশ্বের কাছে নিজেদের অস্তিত্বের কথার জানান দিতে হয়নি তাদেরকে। তবে কেন বাঙালিকে তা করতে হবে?

ভাষা বা অস্মিতা নিয়ে তো ভারতীয় বাঙালিদের গর্ব দেখা যায় না; তবে সেরা নিয়ে এত হৈচৈ কেন?

অনেকে বলবেন এর মধ্যে রয়েছে বাঙালির সাংস্কৃতিক অনন্যতা যা অন্যান্যদের মধ্যে নেই। সেই কথা বলা হলে বলতে হয় যে বাঙালির খণ্ডজাতীয়তাবাদের উপলব্ধি অন্যান্য অনেক প্রাদেশিক সম্প্রদায়ের মানুষের থেকেই কম। ভাষাগত গর্ব বা অস্মিতা বা জাত্যাভিমান ভারতের অনেক প্রদেশের মানুষের মধ্যেই প্রবল এবং দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সেই প্রদেশের মানুষের মধ্যে তা এক অদৃশ্য যোগসূত্র তৈরি করে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে সেই বাঙালি জাত্যাভিমান যে বিশেষ দেখা যায় তা নয়; ভাষা নিয়েও তাদের গর্ব যে প্রবল তা বলা চলে না। তবে সেই সাংস্কৃতিক অনন্যতার কথা বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়? ঘটা করে ‘সেরা বাঙালি’-র পুরস্কার কেন, যেখানে বাংলা ভাষাতে কথা বলতেই সংশয় বোধ করেন আজ ভারতের এক বিরাট অংশের বাঙালি? আত্মপ্রতারণা ছাড়া একে আর কী বলা যেতে পারে?

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়; Source: Twitter handle of Mamata Banerjee @MamataOfficial

পাশাপাশি, একথাও মনে আসে যে যাদের এই পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে, তাদের মুখ তো এই ধরনের পুরস্কার মঞ্চে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। তবে কী সেরাদের সংখ্যায় টান পড়েছে? তা না পড়লেও অবাক হতে হয়। ‘সেরা’ কথাটির তাৎপর্য অনেক। গণমাধ্যমে নাম উঠলেই একজন ব্যক্তিত্ব সত্যি সেরার উপযুক্ত হতে পারেন কি না, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গে বা তার বাইরে এমন অনেক বাঙালি রয়েছেন যারা সামাজিকভাবে বা ভৌগোলিক অর্থে হয়তো প্রান্তিক, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নীরবতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন জগতের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব। গ্ল্যামার বা মিডিয়ার ঢক্কানিনাদের থেকে বহু যোজন দূরে থাকা এই মানুষগুলোকে কি সেরার তকমার জন্য ভাবা হয়? বোধহয় হয় না। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই মুখ। কখনও পুরস্কারের মঞ্চে বা কখনও দর্শকাসনে। তবে কি বলা যায় বাঙালির এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রয়াস আসলে এক অপার ক্ষুদ্রতার আরাধনা? মাঝে সাঝে দু একজন নতুন মুখ দেখা গেলেও ভিড় করে থাকে সেই চেনা মুখেরই সারি?

এলিটতন্ত্রের পায়ে বাতাস করা ছাড়া এর কী যৌক্তিকতা রয়েছে?

আসলে এই সমস্ত অনুষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমাজের স্বভাবসিদ্ধ এলিটতন্ত্রকে ফের একবার বৈধতা প্রদান করে। সমাজের উপরদিকে থাকা কৃতী কিছু মানুষকে সংবর্ধনা জানিয়ে এই এলিটধর্মী অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা অজান্তেই তৈরি করেন এক ধরনের সামাজিক অসাম্যের পরিকাঠামো। এতে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের যে কী কল্যাণ হয়, তা বোঝা দুষ্কর। যদি সত্যি কৃতী বাঙালি খুঁজে বের করতে হয়, সমাজের অন্তরে-প্রান্তরে থাকা মানুষদেরও আনা হোক, আর না হলে বলে দেওয়া হোক যে এই ‘সেরা বাঙালি’ অনুষ্ঠান আসলে দর্শক টানার একটি ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা মাত্র। বঙ্গীয় স্বার্থের হিতে তার বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই।

Featured Image Source: Expedia

Related Articles