ডিসেম্বরে চীনে প্রথম কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর করোনাভাইরাস পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশই। মহামারির ফলে আমাদের চেনা যে বিশ্ব, তার রং বদলেছে অনেকটা, বিশ্বায়নের যুগে মানুষজন বেছে নিয়েছে ঘরবন্দী জীবন। প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী আর শিল্পোন্নত দেশগুলো জনগণের জীবনের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত কার্যকর লকডাউনে গিয়েছে, জনগণকে সরবরাহ করেছে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ।
সিভিল সোসাইটি আর জনগণের চাপের মুখে জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে লকডাউন কার্যকর করেছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও, যেগুলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, মাথাপিছু আয় কম নাগরিকদের। কৃষি আর ইনফরমাল কর্মসংস্থানের উপর নির্ভরশীল এই দেশগুলো লকডাউন কার্যকর করলেও প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর মতো নাগরিকদের দৈনন্দিন চাহিদার দায়িত্ব নিতে পারেনি। ফলে জীবন আর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র মানুষেরা, যাদের গড় মাথাপিছু আয় দুই ডলারেরও কম।
বিশ্ব কি খাদ্য সংকটের মুখে?
মহামারি শুরু হওয়ার পরেই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র সবধরনের যাতায়াত আর বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ করে আইসোলেশনের দিকে গিয়েছে। ক্রমবর্ধমান আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যুতে পুরো বিশ্বের মনোযোগ রয়েছে মাস্ক, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর আর ভ্যাকসিনের উপর। এর মধ্যে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ থাকায় বন্ধ আছে আমদানি-রপ্তানি, যার প্রভাব পড়েছে খাদ্যের আমদানি-রপ্তানির উপরও।
এর মধ্যে ঘরবন্দী থাকায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে থাকায় যারা ইনফরমাল সেক্টরগুলোতে কাজ করে জীবিক নির্বাহ করতো, তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি ঠেকাতে কর্মী ছাটাই করছে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও, ফলে বাড়ছে বেকারত্ব।
ফলে জীবিকা অর্জনের উৎস বন্ধ হলেও, জীবনধারণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দরিদ্রদের আগের চেয়েও বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় এই সংকটে দিন কাটানোর সহায় পাচ্ছে সেসব দেশের নাগরিকেরা, তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক আর শহুরে দরিদ্ররা খরচ করছেন নিজেদের সঞ্চয়। এভাবেই কি এই সংকট কেটে যাবে?
না। প্রকৃত অর্থে, আমরা সবেমাত্র সংকটের শুরুতে প্রবেশ করেছি। দ্রুতই এই সংকট শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা নেই মহামারির দ্রুত শেষ হওয়ার। ফলে এই সংকটকে আমাদের নির্দিষ্ট কয়েকমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কয়েক বছরের লেন্সে দেখতে হবে। ভূ-রাজনীতি, সম্পদ আর নেতৃত্বের দখল নিয়ে ভবিষ্যতে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছাবে। কিন্তু, সবকিছুকে ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে আবির্ভূত হবে খাদ্য সংকট।
প্রথমত, খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ খাদ্যের উৎপাদক আর গ্রাহকের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা। মহামারিকালে অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক, দুই ধরনের যোগাযোগই বন্ধ থেকেছে। চাল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলো, যেমন- ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন বন্ধ রেখেছে চাল রপ্তানি, গম রপ্তানি বন্ধ রেখেছে মিশর। দ্রুত এই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে, এমন সম্ভাবনা নেই। আবার, বন্ধ আছে সমুদ্রবন্দরগুলোও, যেগুলোর মাধ্যমে আমদানি রপ্তানি হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ ভাগ পণ্য। ফলে খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার যে প্রাথমিক শর্ত, খাদ্য উৎপাদক আর গ্রাহকের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা, সেটি দূর করা সহজ হচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, খাদ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকলে, কিংবা একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হওয়া বন্ধ থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যদ্রব্যের দামে দেখা যায় ঊর্ধ্বগতি। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, খাদ্য প্রবাহে যে প্রতিবন্ধকতা আছে এই মহামারিতে, এর ফলে চালের দাম বাড়বে ২৫ শতাংশ, গমের দাম বাড়বে ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে দরিদ্রদের যেহেতু আয় নেই, বেকারত্ব বাড়ছে, ফলে খাদ্যের প্রাপ্যতা কমে যাবে মানুষের।
তৃতীয়ত, এই মহামারিতে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই সীমান্ত বন্ধ রেখেছে। যেমন- ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালির খামারগুলোতে কাজের জন্য যেতে পারছে না পূর্ব ইউরোপের শ্রমিকেরা। একই ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও। ফলে কৃষিকাজের জন্য যে কৃষিশ্রমিকের প্রয়োজন হয়, শস্য উৎপাদনে, তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটি বৈশ্বিকভাবে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত করবে, কমিয়ে আনবে আউটপুট, তৈরি করবে সংকট।
চতুর্থত, এই মহামারিতে কৃষিতে অতীব জরুরি প্রয়োজনীয় সার, বীজ, কীটনাশক কৃষকের কাছে সহজে পৌঁছাতে পারছে না, শ্রমিক সংকটে বাড়ছে কৃষিখরচ। আফ্রিকা আর এশিয়ায় এই মহামারির মধ্যেই কৃষি খামারগুলো শিকার হয়েছে পঙ্গপালের আক্রমণ, বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। এশিয়া মহাদেশ আবার মুখোমুখি হচ্ছে ভয়াবহ বন্যার, যা ফসল আর বীজ ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
পঞ্চমত, গত কয়েক দশকে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই ব্যাপক নগরায়ণ হয়েছে, শহরে বসবাস করতে শুরু করেছেন বয়সে তরুণ নাগরিকদের বড় এক অংশ। ফলে, কৃষিকাজের সাথে বর্তমান সময়ে যারা জড়িত, তাদের অধিকাংশই মধ্যবয়স্ক, জড়িত আছেন ষাটোর্ধ্ব কৃষকেরাও। প্রান্তিক পর্যায়ে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় মহামারিতে এরা সহজ শিকার হতে পারে কোভিডের, যা খাদ্য খাতকে দাঁড় করাতে পারে অস্থিতিশীলতার মুখে।
ষষ্ঠত, যেসব রাষ্ট্রে খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বিশ্লেষকরা দেখছেন, সেগুলোর অধিকাংশই নিম্ন আয়ের, রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা অত্যন্ত কম। ফলে, স্বাস্থ্যখাতও এসব দেশে দুর্বল। শহুরে দরিদ্ররা, যারা এই খাদ্য সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো উদ্যোগ নিতে পারবে না পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই, তারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং সেটা হলে চিকিৎসার জন্য তাদের সর্বস্ব ব্যয় করতে হবে। এই অবস্থা খাদ্য নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে।
সপ্তমত, ওয়াল্ড ফুড প্রোগ্রামের রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর ৭৩০ মিলিয়ন মানুষ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, যাদের দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারের নিচে। মহামারিকালে ইতোমধ্যে এই দরিদ্রদের সংখ্যা বেড়েছে ১৪৭ বিলিয়ন, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সাব-সাহারান অঞ্চল, নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে যাওয়া মানুষদের ৭৯ বিলিয়নই তাদের, ৪২ মিলিয়ন মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার। এই দুই অঞ্চলের দুর্বল সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা, উচ্চ দারিদ্র্য আর অদক্ষ জনশক্তি অঞ্চলগুলোতে ভবিষ্যতে অস্থিতিশীলতা আর অসহিষ্ণুতা তৈরি করবে, জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব আর কম উৎপাদন নিয়ে যাবে খাদ্য সংকটের দিকে।
অষ্টমত, পুরো বিশ্ব একই পাল্লায় চলছে, এর মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই, এই ধারণাগুলো এই মহামারিতে এসে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে আবারও। বর্ণ, জাতীয়তাবাদ আর ধর্মকে কেন্দ্র করে এই বৈষম্য আরো বাড়বে সামনের দিনগুলোতে। ফলে, ধনী আর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নাগরিকদের স্বার্থগুলোকে একচেটিয়াভাবে রক্ষার চেষ্টা করবে। এই বৈষম্যের প্রভাব পড়বে খাদ্য নিরাপত্তায়। তৈরি হবে খাদ্য সংকট।
এই মহামারির সাথে চলমান যেসব ব্যাপার আছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে কেন্দ্র করে, সেগুলোও খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীতে দ্রুত মরুকরণ হচ্ছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ায় বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আবার যত্রতত্র নগরায়ণের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বন্যা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসল। এই ব্যাপারগুলো নিকট অতীত ও ভবিষ্যতে ক্রিয়াশীল থাকবে এবং খাদ্য সংকটকে ঘনীভূত করবে।
সংকটের মোকাবেলা নাকি দুর্ভিক্ষ ?
মহামারি শুরুর আগেই ১৩৫ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলো, মহামারিতে যোগ হয়েছে আরও ১৩০ মিলিয়ন। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতেও দেখা যাবে ৫ শতাংশ পতন, যার ফলাফল হয়ে আসবে আরো বেকারত্ব আর মজুরি হ্রাস। ফলাফল হিসেবে তৈরি হবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের মতে বৈশ্বিকভাবে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে তিন ডজন দেশ। এই অবস্থাকে অনেকে তুলনা করছেন ২০০৮ সালের মহামন্দার সাথে, সাব-সাহারা আর দক্ষিণ এশিয়া যেন পড়ে যাচ্ছে ম্যালথাসিয়ান ট্র্যাপের খপ্পরে।
বৈশ্বিক রাজনীতি আর স্বাস্থ্যগত প্রেক্ষাপটে এই সংকটে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে সুযোগ আছে এই সংকটকে প্রশমিত করার।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং কর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী সরবারহ করে চালু করা যায় সমুদ্রবন্দরগুলো, কমিয়ে দেওয়া যায় খাদ্যের আমদানি রপ্তানির উপর কর আর প্রশাসনিক বাধাগুলো। যুক্তরাষ্ট্রে এবার রেকর্ড পরিমাণ গম উৎপাদিত হচ্ছে, রাশিয়া, চীনও উৎপাদনে পেয়েছে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি। উৎপাদিত খাদ্য প্রয়োজনের সাপেক্ষে খাদ্য সংকট থাকা অঞ্চলগুলোতে সরবারাহ করা যায়। সংকটে থাকা দেশগুলোর সরকার আর আঞ্চলিক জোটগুলো ভূমিকা নিতে পারে খাদ্য প্রবাহ নিশ্চিতে, যেহেতু এই অবস্থায় বৈশ্বিক বন্ধুত্বের চেয়ে আঞ্চলিক মিত্র রাষ্ট্রগুলো নিতে পারে অধিক কার্যকর ভূমিকা।
কমাতে হবে খাদ্যের অপচয়। আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীতে উৎপাদিত মোট খাদ্যের শতকরা ৩০ ভাগ নষ্ট হয়, যা দিয়ে পৃথিবীর ১০ শতাংশ মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। কমাতে হবে মাংসের প্রতি নির্ভরতা, কারণ মানুষের ২% ক্যালরির এই উৎস উৎপাদনের পেছনে ব্যয় হয় মোট কৃষিজমির ৬০ শতাংশ।
মহামারির সময়ে আমাদের জীবনধারণের উপায় বদলে গেছে, মূল্যবোধ বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে বিশ্বরাজনীতি। এই মহামারিতে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা, যারা বসবাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর তাদের কাছে এই রোগের মহামারি আবির্ভূত হয়েছে ক্ষুধা এবং সংকটের মহামারি হিসেবে, কারণ এই মানুষগুলোর দৈনিক উৎপাদনের ৬০-৮০ ভাগই খরচ হয় খাদ্যের যোগানে। রাষ্ট্রগুলোকে এই সংকটাপন্ন শ্রেণীর সমস্যাগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে হবে, আমাদের সবাইকে হতে হবে আরো মানবিক।
অতীতের সংকটগুলোতে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবিক আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলাফল দেখা যায় দুই থেকে পাঁচ বছরের মাত্রায়। ফলে এই সংকালীন সময়ের স্বল্পস্থায়ী উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ, দুর্ভিক্ষ আর ম্যালথাসিয়ান ট্রাপের ক্রমাবর্তন থেকে সাব-সাহারা অঞ্চল আর এশিয়াকে বাঁচাতে।
This article is written in Bangla about food crisis during pandemic and post-pandemic time .
All the necessary links are hyperlinked inside .
Feature Image : Innovation News Network