Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র কেন জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করছে?

‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ (Horn of Africa) অঞ্চলে অবস্থিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র জিবুতি। মাত্র ২৩,২০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট জিবুতি আয়তনের দিক থেকে আফ্রিকার তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। মাত্র ৯ লক্ষ ২২ হাজার জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি জনসংখ্যার দিক থেকে আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ডের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। ইসলাম জিবুতির রাষ্ট্রধর্ম, এবং দেশটির প্রায় ৯৪% অধিবাসী মুসলিম। জাতিগতভাবে, জিবুতির অধিবাসীদের মধ্যে ৬০% সোমালি, ৩৫% আফার এবং ৫% অন্যান্য জাতিভুক্ত। রাষ্ট্রটির সরকারি ভাষা ফরাসি ও আরবি, এবং জাতীয় ভাষা সোমালি ও আফার। জিবুতি ফ্রান্সের একটি উপনিবেশ ছিল, এবং ১৯৭৭ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

ক্ষুদ্র এই আফ্রো–আরব রাষ্ট্রটি অন্যান্য দিক থেকে তৃতীয় বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলোর মতোই, কিন্তু একটি বিষয় রাষ্ট্রটিকে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেছে। সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রটিতে বিভিন্ন দেশের সামরিক উপস্থিতি। কার্যত, জিবুতিতে যতগুলো রাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রে ততগুলো রাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি নেই। বিশ্বের বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো লোহিত সাগরের তীরবর্তী এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য খুবই উৎসাহী। বর্তমানে জিবুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, জাপান, চীন ও সৌদি আরবের সামরিক ঘাঁটি বা সামরিক উপস্থিতি রয়েছে, এবং ভবিষ্যতে আরো কিছু রাষ্ট্রও জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে।

জিবুতি ফ্রান্সের একটি উপনিবেশ ছিল, এবং রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা লাভের পরও ফ্রান্স সেখানে তাদের বিস্তৃত সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। বর্তমানে জিবুতিতে অবস্থিত ফরাসি সামরিক ঘাঁটি কেবল ফরাসি সৈন্যরাই নয়, জার্মান ও স্পেনীয় সৈন্যরাও ব্যবহার করে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ (Global War on Terror) আরম্ভ হওয়ার বছর দুয়েক পরে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। আফ্রিকা মহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি জিবুতিতে অবস্থিত। ঘাঁটিটিতে মার্কিন স্পেশাল ফোর্স, জঙ্গিবিমান, হেলিকপ্টার ও ড্রোনবহর মোতায়েনকৃত রয়েছে, এবং এটি মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর ‘আফ্রিকা কমান্ড’–এর (আফ্রিকম) কেন্দ্র। এছাড়া ইতালিও জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। অর্থাৎ, ন্যাটো জোটের ৫টি সদস্য রাষ্ট্র জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখে চলেছে।

জিবুতি বন্দরের নিকটে একটি সামরিক মহড়ার সময় মার্কিন নৌবাহিনীর প্যাট্রোল বোট; Source: Medium

২০১১ সালে জাপানও জিবুতির জিবুতি–আম্বুলি আন্তর্জাতিক বিমাননবন্দরে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে, এবং এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহির্বিশ্বে জাপানের প্রথম সামরিক ঘাঁটি। ২০১৭ সালে চীন জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। অবশ্য চীনারা একে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে অভিহিত করে না, বরং একটি ‘সরবরাহ ঘাঁটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। চীনা নৌবাহিনী এই ঘাঁটি ব্যবহার করে থাকে, এবং চীনারা ঘাঁটির পাশাপাশি জিবুতিতে সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো (যেমন: নতুন বন্দর, রেলপথ, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতি) নির্মাণ করছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে সৌদি আরব জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের জন্য দেশটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এর বাইরে রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু নানা কারণে সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এতগুলো রাষ্ট্র কেন জিবুতির মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে? এক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন– জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পিছনে প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র কিছু কারণ রয়েছে, কিন্তু এর বাইরেও কিছু কারণ রয়েছে, যেগুলো সকলের ক্ষেত্রে একই।

প্রথমত, ভূকৌশলগতভাবে জিবুতির অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিবুতি লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত, এবং বিখ্যাত ‘বাব এল–মান্দেব’ প্রণালী জিবুতির সন্নিকটে অবস্থিত। এই প্রণালীটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৩০% এই প্রণালীর মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। বৈশ্বিক তেল ও পণ্যদ্রব্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রণালীটিকে একটি Chokepoint হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এই প্রণালীটির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে (অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতিতে) বড় ধরনের আঘাত হানা সক্ষম। বলাই বাহুল্য, এই প্রণালীর নিরাপত্তা বজায় রাখার (এবং প্রতিপক্ষ যাতে এই প্রণালীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে সেটি নিশ্চিত করার) উদ্দেশ্যে বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে উৎসাহী।

মানচিত্রে জিবুতি ও নিকটবর্তী অঞ্চল; Source: Medium

দ্বিতীয়ত, জিবুতি রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটিতে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জাতিগত সংঘাত বা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। এদিক থেকে আফ্রিকা ও নিকটবর্তী পশ্চিম এশিয়ার সাধারণভাবে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রগুলো থেকে জিবুতি বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ। অর্থাৎ, জিবুতির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশটির মাটিতে বিভিন্ন দেশকে সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছে।

তৃতীয়ত, জিবুতি আফ্রিকা মহাদেশের একটি অংশ এবং পশ্চিম এশিয়া/মধ্যপ্রাচ্যের সন্নিকটে অবস্থিত। বিশেষত জিবুতির নিকটবর্তী রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক দিক থেকে মারাত্মকভাবে অস্থিতিশীল। জিবুতির দক্ষিণ–পূর্বে সোমালিয়া অবস্থিত, যেটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ (failed state) হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি অর্জন করেছে এবং যেটি কার্যত তিন খণ্ডে বিভক্ত। সোমালি জলদস্যুরা লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর নিরাপত্তার জন্য বড় একটি হুমকি, এবং সোমালি মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘আল–শাবাব’ সোমালিয়ার পাশাপাশি আশেপাশের দেশগুলোর জন্যও একটি বড় ধরনের ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

জিবুতির উত্তর–পূর্বে মাত্র ২০ মাইল দূরত্বে ইয়েমেন অবস্থিত, যেটিকে মধ্যপ্রাচ্যের দরিদ্রতম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং যেটি এখন এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। ইয়েমেনও সোমালিয়ার মতো খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, এবং সেখানেও নানাবিধ মিলিট্যান্ট গ্রুপ সক্রিয়। জিবুতির দক্ষিণ–পূর্বে অবস্থিত ইথিওপিয়া, যেটি বর্তমানে নীলনদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মিসর ও সুদানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, এবং যেখানে সম্প্রতি একটি গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। অর্থাৎ, জিবুতির নিকটবর্তী রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল, এবং এই অস্থিতিশীলতা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য এতদঞ্চলের ওপর নজর রাখার জন্য বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো দেশটিতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে আগ্রহী।

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিসের (ডানে) সঙ্গে জিবুতির প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলী হাসান বাহদোন; Source: Quartz Africa

চতুর্থত, জিবুতি লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের তীরে অবস্থিত, এবং এজন্য আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে রসদপত্র সরবরাহের জন্য জিবুতি একটি ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের বিস্তৃত সামরিক উপস্থিতি রয়েছে, এবং এই সামরিক ঘাঁটিগুলোতে রসদপত্র সরবরাহ বজায় রাখার জন্য তারা জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। অনুরূপভাবে, লোহিত সাগরে জলদস্যু মোকাবিলা এবং সোমালিয়া ও ইয়েমেনে মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে দমনের ক্ষেত্রেও জিবুতি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে এবং ইয়েমেনে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থেই তারা জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে ইচ্ছুক।

পঞ্চমত, জিবুতির বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইথিওপিয়া স্থলবেষ্টিত, এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য প্রায় পুরোপুরিভাবে জিবুতির ওপর নির্ভরশীল। জিবুতির মধ্য দিয়ে ইথিওপিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০% সম্পাদিত হয়ে থাকে। এদিকে ইথিওপিয়া ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ অঞ্চলের এবং সামগ্রিকভাবে আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র। এজন্য জিবুতির ওপর সামরিক–রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারলে ইথিওপিয়ার ‘ট্রানজিট রুট’ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইথিওপিয়ার নীতির ওপরেও আংশিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব। স্বভাবতই আফ্রিকার একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের ওপর প্রচ্ছন্নভাবে প্রভাব বিস্তার জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য অন্যতম উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।

সর্বোপরি, জিবুতিতে অবস্থিত বিদেশি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে কতজন সৈন্য মোতায়েন করা যাবে, কোন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করা যাবে কিংবা সেগুলো থেকে কোন ধরনের অভিযান পরিচালনা করা যাবে– এসব বিষয়ে জিবুতি সরকারের কোনো নিয়ম–কানুন বা বাধানিষেধ নেই। এর ফলে জিবুতিতে যেসব রাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে, তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সেখান থেকে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। যেমন: জিবুতিতে অবস্থিত ঘাঁটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন ও সোমালিয়ায় বহুসংখ্যক ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে, যেগুলো অনেক ক্ষেত্রে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু জিবুতির সরকার এসব নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করেনি এবং জিবুতি থেকে পরিচালিত মার্কিন কর্মকাণ্ডের কোনোরকম বিরোধিতাও করেনি। এই ধরনের জবাবদিহিতার অভাবের কারণে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে বেশ আগ্রহী।

জিবুতিতে অবস্থিত ফরাসি নৌঘাঁটিতে স্পেনীয় যুদ্ধজাহাজ ‘লা গালিসিয়া’; Source: Getty Images/BBC

এগুলো হচ্ছে জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উৎসাহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ। কিন্তু জিবুতি কেন এতগুলো রাষ্ট্রকে নিজস্ব ভূমিকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দিয়েছে? এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে জিবুতির কী স্বার্থ নিহিত রয়েছে?

প্রথমত, জিবুতি একটি দরিদ্র রাষ্ট্র। দেশটিতে বেকারত্বের হার অনেক বেশি, এবং প্রায়ই খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে জিবুতির ভূমিতে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করা এবং এর মধ্য দিয়ে ঘাঁটি স্থাপনকারী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে আদায় করে নেয়া হচ্ছে জিবুতির সরকারের লক্ষ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিবুতিতে তাদের সামরিক ঘাঁটির জন্য জিবুতির সরকারকে বার্ষিক ৬ কোটি ৩০ লক্ষ (বা ৬৩ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার প্রদান করে থাকে। ফ্রান্স ও জাপান প্রত্যেকেই জিবুতিতে তাদের সামরিক ঘাঁটির জন্য জিবুতির সরকারকে বার্ষিক ৩ কোটি (বা ৩০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার প্রদান করে থাকে। চীনের ক্ষেত্রে এই প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ ২ কোটি (বা ২০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার। এর পাশাপাশি জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিনিময়ে চীন জিবুতিকে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’–এ অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে এবং দেশটিতে নানাবিধ অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

এভাবে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে অর্জিত ‘ভাড়া’ জিবুতির একটি ‘অর্থনৈতিক লাইফলাইনে’ পরিণত হয়েছে। এক হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে জিবুতির বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের (Gross Domestic Product, ‘GDP’) ৫%–এর বেশি আসে বিদেশি সামরিক ঘাঁটিগুলোর বিনিময়ে প্রাপ্ত ভাড়া থেকে। অবশ্য এই স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক লাভের পরিবর্তে জিবুতি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে এবং স্থায়ীভাবে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কাও রয়েছে।

জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পাশাপাশি চীন দেশটিতে নানাবিধ সামরিক সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ করছে; Source: Getty Images/BBC

দ্বিতীয়ত, জিবুতি একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, এবং স্বাভাবিকভাবেই এর সামরিক বাহিনীও অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও দুর্বল। এর ফলে নিজস্ব শক্তিতে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা তাদের জন্য কঠিন। জিবুতি স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালেই সোমালিয়া দেশটিকে নিজেদের অঙ্গীভূত করে নিতে চেয়েছিল, এবং এখন পর্যন্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরিত্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে দেশটির বিরোধ রয়েছে। এমতাবস্থায় জিবুতিতে বিদেশি সামরিক উপস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোই নিজ স্বার্থে জিবুতির স্বাধীন অস্তিত্ব বজার রাখবে।

সর্বোপরি, পশ্চিমা বিশ্বের মান অনুযায়ী, জিবুতি কোনো ‘গণতান্ত্রিক’ বা ‘মুক্ত’ রাষ্ট্র নয়। জিবুতিকে একটি ‘স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। জিবুতির রাষ্ট্রপতি ইসমাইল ওমর গুয়েল্লেহ ১৯৯৯ সাল থেকে দেশটির শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে, এবং তার আমলে জিবুতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। তদুপরি, জিবুতির সংবিধানে রাষ্ট্রপতির মেয়াদের ওপর যে সীমাবদ্ধতা ছিল, সেটিও অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু জিবুতির সরকার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, এবং এজন্য নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো জিবুতির সরকারব্যবস্থার সমালোচনা করতে ইচ্ছুক নয়।

সামগ্রিকভাবে, জিবুতির সরকার রাষ্ট্রটির অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত স্বার্থে এবং নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থে দেশটির মাটিতে বিভিন্ন দেশকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ প্রদান করেছে। কিন্তু জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখা রাষ্ট্রগুলোর সকলের স্বার্থ এক নয়, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা একে অপরের পরিপন্থী (যেমন: যুক্তরাষ্ট্র ও চীন)। এর ফলে যদি এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গুরুতর কোনো সংঘর্ষ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রেও জিবুতির ভূমিতেও এই সংঘর্ষ বিস্তার লাভ করতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে জিবুতি নিজস্ব ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে।

Related Articles