বেঁচে থাকার জন্য জীবদেহের অনবরত যে কাজটি করে যেতে হয় সেটি হলো শ্বসন। কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নেয়া বন্ধ করে বসে থাকুন, দেখবেন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে। দ্রুতই টের পাবেন যে ফুসফুসে প্রতিনিয়ত অক্সিজেনের সরবরাহ চালু না থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। জীবদেহের মতো পৃথিবীরও একটি ফুসফুস আছে জানেন কি? জীবদেহের ফুসফুসের সাথে সেই ফুসফুসটির দুটি গুণগত পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, পৃথিবীর ফুসফুসটি অক্সিজেন গ্রহণ করে না, বরং প্রতিনিয়ত অক্সিজেন উৎপাদন করে চলে। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর ফুসফুস পৃথিবীর বেঁচে থাকার জন্য নয়, কাজ করে মানবজাতি তথা সমস্ত জীবজগতের বেঁচে থাকার জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে, অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ফুসফুসের অসুখ করেছে, দিনে দিনে মরে যাচ্ছে এটি, ক্ষয়ে যাচ্ছে এর জীবনীশক্তি!
দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহ গ্রীষ্মপ্রধান রেইনফরেস্ট আমাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। ব্রাজিল, পেরু ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়াসহ একাধিক দেশে অবস্থিত ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই সুবিশাল জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অরণ্য একাই যোগান দিচ্ছে পৃথিবীর মোট অক্সিজেন চাহিদার ২০ ভাগ। জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত এই রেইনফরেস্টটিকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন পৃথিবীর স্বার্থেই।
অথচ, বিস্ময়কর হলেও সত্য যে বর্তমান সময়ে প্রতি মিনিটে আমাজন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি! সম্প্রতি স্যাটেলাইট চিত্র থেকে উঠে এসেছে এই ভয়াবহ তথ্য। ব্রাজিলের নতুন ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর সরকারের পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কোনোরূপ মাথাব্যথাই নেই। পরিবেশ ধ্বংস করেই অবকাঠামোগত ও শিল্পোন্নয়নের দিকে হাঁটছে দেশটি। তাতে করে পৃথিবীর ফুসফুসের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়েই আলোচনা করবো আজ।
২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে এবছর জুন মাস পর্যন্ত আমাজনের বুক থেকে অদৃশ্য হয়েছে ৪,৫৬৫ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি যার সিংহভাগই ব্রাজিলের অংশে। তথ্যটি শিউরে ওঠার মতই। সরকারি বুলডোজারের প্রবল পরাক্রমে আমাজনের দীর্ঘকাল ধরে শীতল ছায়ার কোলে আশ্রয় নেয়া ধরনী এখন প্রখর সূর্যের আলোয় শুকিয়ে মরছে। সাথে চোরাকারবারিদের গাছ কাটা তো আছেই। যেসব স্থানে জ্বালানির উপযোগী কিংবা বিক্রয়যোগ্য কাঠ নেই, সেসব স্থানে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সব। চিরসবুজ আমাজনের স্যাটেলাইট ছবি দেখলে তাই মন খারাপ হবে যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর। বন উজাড় করার স্যাটলাইট ছবি দেখলে মনে হবে যেন মাংসপেশী শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে যাওয়া এক দেহ!
বলসোনারোর পূর্ববর্তী প্রায় প্রতিটি সরকার এই দেশের এবং বিশ্বের অমূল্য সম্পদটিকে রক্ষা করতে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে, বন উজাড় করা ঠেকাতে নিয়েছে নানারূপ পদক্ষেপ। কিন্তু বলসোনারো ক্ষমতায় এসেই সবকিছু পাল্টে দিলেন। আমাজন সংরক্ষণে সবরকম সরকারি হস্তক্ষেপ শিথিল করে শুরু করলেন নির্বিচারে বন উজাড়। অবস্থা এমন যে, চোরাকারবারিরা আড়ালে আবডালে কিছু গাছ কেটে নিলে নিক, তাতে সরকারের বরং লাভ!
ব্রাজিল সরকার বলছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন অধিক জ্বালানি। তাই বন উজাড় করা ছাড়া পথ খোলা নেই। তাছাড়া, মানুষের সাথে বাড়ছে গৃহপালিত পশুর সংখ্যা এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের জন্য চারণভূমির প্রয়োজনীয়তা। কৃষিকাজের জন্য পর্যাপ্ত জমি তৈরি করাও এই বন উজাড়ের বড় কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে দেশটির সরকার।
এদিকে, ব্রাজিলের পরিবেশবাদীরা এই ভয়াবহ বন উজাড়করণ নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার হলেও তাদের আওয়াজ পৌঁছুচ্ছে না বিশ্ব দরবারে। বলসোরানো সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আমাজন জঙ্গল ‘অতিরিক্ত বড়’ এবং অধিক জায়গা দখল করে আছে! তাই এই বন থেকে কিছু জায়গা মুক্ত করার জন্য প্রথমেই পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক আইন সংশোধনের দিকে নজর দেয় তারা। এছাড়াও, দেশটির পরিবেশবাদীদের উপরও রয়েছে প্রচ্ছন্ন চাপ যাতে করে তারা মিডিয়ায় এসব ব্যাপারে প্রচার চালাতে না পারেন।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে; একদিকে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে তো অন্যদিকে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে খরা, অনাবৃষ্টি। জলবায়ু পরিবর্তনের এসব ভয়াবহ প্রভাবের মূল উৎস যে গ্রীনহাউজ ইফেক্ট, তা সকলেরই জানা। সাম্প্রতিককালে বিশ্বনেতারা ঘন ঘন আলোচনায় বসছেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে। বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমাতে অদ্যাবধি কত চুক্তি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অথচ আমাজন ধ্বংস হয়ে গেলে যে এসব চুক্তি নিরর্থক প্রতীয়মান হবে, সে ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে কেউ?
পৃথিবীতে প্রতিবছর যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ ঘটে, তা থেকে আমাজন বন একাই ২.২ বিলিয়ন টন শুষে নিয়ে পৃথিবীর জলবায়ুর ভারসাম্য ধরে রাখতে একাই যুদ্ধ করে চলেছে। অথচ এই আমাজন বন থেকে প্রতি মিনিটে হারিয়ে যাচ্ছে ফুটবল মাঠের সমান বন। বৈশ্বিক তাপমাত্রার এতো দ্রুত উর্ধ্বমুখী গমনের এটিই যে বড় কারণ। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, আমাজনের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর নিঃসৃত কার্বনের পুরোটা একাই শুষে নিচ্ছে আমাজন।
নির্বিচারে আমাজন উজাড়ের ফলে কেবল যে বৈশ্বিক জলবায়ু প্রভাবিত হচ্ছে তা নয়। প্রাণীজগতের ১০ ভাগের ১ ভাগই বসবাস করে আমাজনে। আমাজন হারিয়ে গেলে যে বৈশ্বিক প্রাণীবৈচিত্র্য বিপন্ন হবে, বিলুপ্ত হবে অসংখ্য প্রজাতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুবিশাল এই অরণ্যানীর মাঝে হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর ভাগ্যও অনিশ্চিত। অনেকের ধারণা, তাদের পরিণতি আমেরিকার সেই হতভাগ্য রেড ইন্ডিয়ানদের মতোই হতে চলেছে!
এদিকে বিবিসি, গার্ডিয়ানের মতো আন্তর্জাতিক ও নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যমগুলোও এ বছরের প্রথভাগে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আমাজনের এই সংকটময় অবস্থার উপর। বলসোরানো সরকারের একাধিক কর্মকর্তাই এসব পত্রিকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন যে, সরকারি কর্মকর্তাদের উপর আমাজন বিষয়ক কোনোরকম কথা বলার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়াও, ব্রাজিল সরকার আমাজনে বন উজাড়ের যে তথ্য বিশ্বকে দিচ্ছে, তা-ও সম্পূর্ণ ভুল। এক্ষেত্রে স্যাটেলাইটই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য।
এদিকে, বন উজাড় সর্বোচ্চ গতিতে চলে সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে। এ বছরের শুরুর ৬ মাসেই আমাজন থেকে হারিয়ে গেছে ২ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মতো বন। অথচ এ ছয় মাস বৃষ্টির মৌসুম ছিল। পরিবেশবিদরা আশংকা করছেন, চলতি শুষ্ক মৌসুমে আমাজনের বড় ধরনের ক্ষতি হতে চলেছে। এরই মাঝে টানা ১০ দিনের বেশি সময় ধরে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে আমাজন। শুষ্ক মৌসুমে আমাজনে ছোটখাট দাবানল নতুন কিছু নয়। কিন্তু, বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাম্প্রতিক এ আগুন অস্বাভাবিক গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। আগুনের এ অস্বাভাবিকতার সাথে আবহাওয়ারও কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাননি আবহাওয়াবিদগণ। তাদের ভাষ্য, আমাজনের আবহাওয়ার অবস্থা স্বাভাবিক এবং অন্যান্য বছরের মতোই। তাহলে এ হৃদয়বিদারক সর্বগ্রাসী আগুনও আমাজন ধ্বংসের হীন পরিকল্পনারই অংশ?
মজার ব্যাপার হলো, ব্রাজিলের সাধারণ জনগণের একাংশ, বিশেষকরে কৃষক সমাজ বলসোরানো সরকারের এই আমাজন বিদ্বেষী নীতিতে বেজায় খুশি। অবশ্য তাদের যুক্তিও ফেলে দেবার মতো নয়। ভ্যান্ডারলি ওয়েগনার, ব্রাজিলের কৃষক ইউনিয়নের একজন প্রভাবশালী নেতার মতে, কৃষকদের উন্নয়নের জন্য আমাজনের কিছু অংশ পরিষ্কার করা সময়ের দাবী। তিনি আমাজনের প্রতি ইউরোপীয় দেশগুলো কিংবা আমেরিকার প্রতিক্রিয়াকে লোক দেখানো হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার দাবী, ইউরোপ-আমেরিকা নিজেদের বনাঞ্চল প্রায় পুরোটাই ধ্বংস করেছে নিজেদের উন্নয়নের জন্য। এখন তারাই আবার অন্য দেশের প্রসঙ্গে পরিবেশদরদী হয়ে উঠেছে!
পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করতে গিয়ে দিনকে দিন বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে মানুষে। যেখানে মানুষের হবার কথা প্রকৃতির বন্ধু, সেখানে সর্বগ্রাসী মানবজাতি প্রাণপ্রকৃতির জন্য সাক্ষাৎ যমে পরিণত হয়েছে। আমাজনের বাইরে এসে বৈশ্বিক তথ্য উপাত্ত দেখলে মানবজাতিকে দানবে অভিহিত করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আমাজনে যেখানে প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমান বন ধ্বংস হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে প্রতি সেকেন্ডেই সমপরিমাণ বন ধ্বংস হচ্ছে! প্রতিদিন পৃথিবীর বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি নিউ ইয়র্ক শহর; বাৎসরিক হিসাবে, একটি ইতালি রাষ্ট্র!
২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সাইফাই অ্যানিমেটেড সিনেমা ‘ওয়াল-ই’ প্রত্যেক সিনেপ্রেমীর মনে দাগ কেটেছিল। দাগ কেটেছিল পরিবেশবাদী বিজ্ঞানী আর প্রকৃতিপ্রেমীদের মনেও। বর্তমানকালে পরিবেশ প্রকৃতির প্রতি মানুষের নির্দয়তা ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তাই ওয়াল-ই সিনেমায় দেখানো পৃথিবীর পরিত্যাক্ত হওয়ার বাস্তবায়ন হতে আর দেরি নেই, এ অনুমান করাই সহজ। ভাবনার বিষয় হলো, ওয়াল-ই সিনেমার মতো পৃথিবীর বাইরে গিয়ে বেঁচে থাকবার মতো কোনো ব্যবস্থা মানুষ আজও করে উঠতে পারেনি!
Language: Bangla
Topic: Deforestation in Amazon rainforest
Reference: Hyperlinked inside the article
Featured Image: cbsnews.com