Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টিভি কমেডি সিরিজের প্রেসিডেন্ট থেকে বাস্তবের প্রেসিডেন্ট!

এক সাধাসিধে, ত্রিশোর্ধ্ব, হাই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। ইউক্রেনের সরকার নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নন তিনি। সরকারি দুর্নীতিকে প্রবল আক্রমণ করা তার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় গোটা দেশব্যাপী। আর এর ফলে তিনি দেশের মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেন যে, তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকেই ভোট দেয়, আর তিনি হয়ে যান দেশটির নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।

এমনটাই ছিল ২০১৫ সালের ১৬ অক্টোবর শুরু হওয়া ইউক্রেনের টিভি পলিটিক্যাল কমেডি সিরিজ “সারভেন্ট অব দ্য পিপল” এর কাহিনী। সেখানে প্রেসিডেন্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কমেডিয়ান অভিনেতা ভলোদিমের জিলেনস্কি। তবে এই মুহূর্তে আর তাকে স্রেফ কমেডিয়ান অভিনেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া বোধহয় একদমই উচিৎ হচ্ছে না। কারণ এখন সৃষ্টি হয়েছে তার আরো বড় একটি পরিচয়। তিনি এখন আর শুধু টিভি সিরিজের কল্পিত প্রেসিডেন্টই নন, ইউক্রেনের মানুষ বাস্তবিকই ভোট দিয়ে তাকে পরিণত করেছে সে দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট!

সার্ভেন্ট অব দ্য পিপলের ইউক্রেনিয়ান পোস্টার; Image Source: Netflix

হ্যাঁ পাঠক, ভুল কিছু পড়ছেন না। ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল ইউক্রিনফর্মের এক্সিট পোল (বুথ ফেরত সমীক্ষা) থেকে জানা গেছে, দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে ৭৩.২ শতাংশ ভোট পেয়ে ভূমিধ্বস জয় হয়েছে ৪১ বছর বয়সী রাজনৈতিক নবিস জিলেনস্কির। বিপরীতে গত পাঁচ বছর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা পেত্রো পরোশেঙ্কোর পক্ষে ভোট পড়েছে মাত্র ২৫.৩ শতাংশ।

কোনো রকম রাজনৈতিক পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকা, এবং নির্বাচনের আগেও পরিষ্কারভাবে কোনো ইশতেহারের মাধ্যমে নিজের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানান না দেয়া জিলেনস্কির এভাবে আকস্মিক উত্থান বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের আগে জিলেনস্কি কেবল একটি দুর্নীতি-বিরোধী বার্তা দেশবাসীর উদ্দেশে দিয়েছিলেন, আর সেটিই দারিদ্র্যপীড়িত ও সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের জন্য যথেষ্ট ছিল তাকে ভোটদানের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে। এছাড়া জিলেনস্কির অতীত তারকাখ্যাতিও তাকে লড়াইয়ে এগিয়ে রেখেছিল।

তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, নিজ দেশ নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত ইউক্রেনবাসী চেয়েছিল একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের। দীর্ঘদিন ধরে রাগে ফুঁসছিল তারা, যার বহিঃপ্রকাশ এবার ঘটেছে রাজনৈতিক অনভিজ্ঞ এক কমেডিয়ানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার মাধ্যমে।

ভোট দিচ্ছেন জিলেনস্কি; Image Source: CNN

প্রায় ৩০ বছর ধরে ইউক্রেনের মানুষ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রো-রাশিয়ান কিংবা প্রো-ওয়েস্টার্ন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এলিট প্রার্থীদেরকে নির্বাচিত করে আসছিল। কিন্তু তাতেও দেশের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, বরং ইউক্রেন বরাবরই ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি হয়েই ছিল।

তবে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে ওঠে ২০১৩ সালে, অর্থাৎ পরোশেঙ্কো ক্ষমতায় আসার এক বছর আগে। ওই সময় থেকে দেশটির জিডিপি নিম্নগামী হতে শুরু করে। নিচে দেয়া বিশ্বব্যাংকের চার্টে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও, সামগ্রিকভাবে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতো পশ্চাৎপদই রয়ে গেছে। ফলে লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনিয়ান বাধ্য হয়েছে নিজ দেশ ছেড়ে, সুন্দর জীবনের আশায়, অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যেতে।

২০০০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ইউক্রেনের জিডিপি; Image Source: World Bank

ইউক্রেনে দুর্নীতি সব সময়ই একটি বড় সমস্যা ছিল। এবং ২০১৪ সালে পরোশেঙ্কো ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি ভালো হওয়ার বদলে আরো খারাপের দিকে যায়। সরকারের ভিতরই দুর্নীতির প্রবণতা এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা ইউক্রেনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। ফলে দেশটির অর্থনৈতিক জাগরণের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।

সম্প্রতি এক জরিপের ফলাফল থেকে জানা গিয়েছে যে, টানা দ্বিতীয় বছরের মতো সরকারের প্রতি আস্থাহীনতায় বিশ্বব্যাপী প্রথম স্থান অধিকার করেছে ইউক্রেন। দেশটির মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ তাদের সরকারকে বিশ্বাস করে। এর প্রধান কারণ মূলত ২০১৩ সালে দেয়া “রেভোলিউশন অব ডিগনিটি”র প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা না করা, যেখানে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল দেশটিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা আনয়ন এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির ব্যাপারে।

ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পরোশেঙ্কো; Image Source: Getty Images

পাঁচ বছর পর, ইউক্রেনে বেকারত্ব কিংবা আংশিক বেকারত্বের ফলে এখন প্রায় ৩.২ মিলিয়ন ইউক্রেনিয়ান (প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন) বিদেশে চাকরি নিয়ে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। এছাড়া অনেকেই প্রতিবছর সাময়িক চাকরি নিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে।

দারিদ্র্যের হার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে অসাম্যও। জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রমের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ইউক্রেনের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, যা দেশটিকে পরিণত করেছে ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটিতে। অথচ দেশটিতে ধনীদের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি কিন্তু থেমে নেই। ২০১৮ সালে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ অনুযায়ী, দেশটির সবচেয়ে ধনী ১০০ জন ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ মাত্র এক বছরেই ৪৩ শতাংশ বেড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

এদিকে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়ার কৃষ্ণ সাগর পেনিনসুলা দখল করে নেয়ার পর থেকে, ইউক্রেনিয়ান সেনারা পূর্ব দনবাস অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে লড়াই করে আসছে, যারা সরাসরি মস্কো থেকে মিলিটারি সহায়তা পেয়ে থাকে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এই বিরোধে প্রায় ১৩ হাজার প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৩,৩২১ জন সাধারণ মানুষও রয়েছে।

মস্কোর সাথে বিরোধ চরমে পৌঁছায় গত নভেম্বরে, যখন রাশিয়া তিনটি ইউক্রেনিয়ান নেভি জাহাজ জব্দ করে, এবং বন্দি করে ২৪ জন নাবিককে। পরোশেঙ্কোর সরকার এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। একাধারে তারা মার্শাল ল’ জারি করে, পাশাপাশি রাশিয়ায় আসন্ন আক্রমণের হুমকিও দেয়।

ক্রিমিয়া প্রসঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়ার বিরোধ তুঙ্গে; Image Source: UA Post

ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিলেনস্কিকে এসব সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু এসব সমস্যা মোকাবেলায় তিনি কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, সে ব্যাপারে এখনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। কেননা নির্বাচনী প্রচারণাকালে এসব বিষয়ে তিনি একদমই মুখ খোলেননি। এমনকি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ যাতে প্রকাশ না পায়, সেজন্য তিনি যেকোনো সাক্ষাৎকার কিংবা সংবাদ সম্মেলন এড়িয়ে গেছেন, প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটেও কিছু খোলাসা করেননি।

এখন পর্যন্ত জিলেনস্কির পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কেবল এটুকুই জানা গিয়েছে যে, তিনি একজন প্রো-ওয়েস্টার্ন, ইউক্রেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে প্রবেশের সমর্থক, এবং নিজ দেশের জন্য ন্যাটোর সদস্যপদ চান না। অবশ্য এসব পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে তাকে পরোশেঙ্কোর থেকে খুব একটা আলাদা করা যাচ্ছে না। বরং জিলেনস্কির ব্যাপারে অনেক ইউক্রেনিয়ানের মনেই এখনো বড় দুটি চিন্তা রয়েই গেছে।

প্রথমত, অবশ্যই জিলেনস্কির অনভিজ্ঞতা। তবে ইউক্রেনিয়ানরা যে রাজনৈতিক প্রতিনিধি নির্বাচনে অভিজ্ঞতাকে খুব একটা আমলে নেয় না, সে দৃষ্টান্ত তারা ইতিপূর্বেও স্থাপন করেছে। ২০১৪ সালে যেমন কিয়েভের নাগরিকরা তাদের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করে সাবেক হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ভিতালি ক্লিৎশকোকে।

জিলেনস্কির ব্যাপারে এখনো সন্দিহান অনেক ইউক্রেনিয়ান; Image Source: Reuters

আর দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের অন্যতম ধনকুবের ইয়র কলোময়স্কির সাথে জিলেনস্কির সুসম্পর্ক। জানিয়ে রাখা ভালো, জিলেনস্কির সিরিজটি প্রচারিত হতো কলোময়স্কির মালিকানাধীন একটি টিভি চ্যানেলেই, এবং ঐ চ্যানেল ও প্রোডাকশনের লোকজনই প্রথম জিলেনস্কির পক্ষে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিল। এদিকে কলোময়স্কি অনেক আগে থেকেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পরোশেঙ্কোর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই অনেকেরই ধারণা, কলোময়স্কি হয়তো জিলেনস্কির খ্যাতিকে কাজে লাগিয়েই পরোশেঙ্কোকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলেন, এবং ভবিষ্যতে জিলেনস্কির সরকারে পেছন থেকে কলকাঠিও তিনিই নাড়বেন।

তবে সে যা-ই হোক, আশার কথা এটিই যে, ইউক্রেনের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে। আর সেই অধিকারের বলেই তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দিয়ে একজন কমেডিয়ানকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। এখন সেই কমেডিয়ান তার উপর রাখা সাধারণ মানুষের বিপুল আস্থার কতটুকু প্রতিদান দিতে পারবেন, আগামী দিনগুলোতে সেটিই হবে দেখার বিষয়। 

ইউক্রেন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য; Image Source: Getty Images

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about Volodymyr Zelensky, who has been elected as the new president of Ukraine. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © CNN

Related Articles