স্নেহার যখন প্রথম মাসিক ঋতুচক্র শুরু হলো, তার বয়স ১৫ বছর। প্রথমবার রক্তপাতের সময় তার কোনো ধারণাই ছিল না, কী হচ্ছে তার সাথে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান তিনি। ভাবেন, সাংঘাতিক কোনো অসুখ হয়ে বসল নাকি! এসব ভেবে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। মাকে এ কথা জানাবার মতো সাহস ছিল না তার। তাই সবকিছু তিনি বলেন মাসিকে। মাসি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, "ঘাবড়াবার কিছু হয়নি। তুমি এখন পরিণত নারী হয়ে উঠেছ। কেঁদো না, এখন এগুলো স্বাভাবিক।"
এরপর আরো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। স্নেহার বয়স এখন ২২ বছর। দিল্লির অদূরে হাপুর জেলার কাঠিখেরা গ্রামের মেয়ে স্নেহা এখন পুরো বিশ্বের কাছেই পরিচিত মুখ। কারণ যে মেয়েটি নিজে একদিন ঋতুচক্রের ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলেন, সেই তিনিই পরবর্তীতে গ্রামের একটি ছোট কারখানায় কাজ শুরু করেন যেখানে স্বল্পমূল্যের স্যানিটারি প্যাড তৈরি হয়, এবং আরো পরে অস্কারজয়ী ডকুমেন্টারি 'পিরিয়ড. এন্ড অফ এ সেনটেন্স.' এর প্রধান চরিত্র হিসেবে লস অ্যাঞ্জেলেসের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেন।
নেটফ্লিক্স অরিজিনাল ডকুমেন্টারিটির ধারণা প্রথম আসে উত্তর হলিউডের একদল শিক্ষার্থীর মাথায়, যারা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে একটি প্যাড বানানোর যন্ত্র পাঠায় স্নেহার গ্রামে। সেই যন্ত্রের সাথে সাথে আরো হাজির হন ইরানি-আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়কা জেহতাবচিও।
কাঠিখেরা গ্রামটি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে মাত্র ১১৫ কিলোমিটার (৭১ মাইল) দূরে। কিন্তু সেই গ্রামে উপস্থিত হলে মনে হবে, সেটির অবস্থান যেন আধুনিক সভ্যতা থেকে শত-সহস্র মাইল দূরে, শিক্ষার আলো এখনো যেখানে পৌঁছায়নি। এমন একটি গ্রামেরই রাস্তাঘাটে, মাঠে, খামারে, স্কুলের শ্রেণীকক্ষে, প্যাড তৈরির কারখানায় চিত্রধারণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটির।
ভারতের অন্য আর সব জায়গার মতো, মেয়েদের মাসিক ঋতুচক্র এই গ্রামেও একটি নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ, যা নিয়ে কথা বলতে চান না কেউই। ঋতুচক্র চলাকালীন এই গ্রামের নারীদেরকেও অপবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং তাদেরকে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান তো দূরে থাক, এমনকি মন্দিরে গিয়ে পূজাও করতে দেয়া হয় না। কারণ তাদেরকে বলা হয়, অপবিত্র শরীরে ঈশ্বরের কাছে যতই প্রার্থনা করা হোক না কেন, তা মঞ্জুর হবে না।
এরকম সামাজিক কাঠামোয় বেড়ে ওঠার দরুন, খুব স্বাভাবিকভাবেই স্নেহাও তার নিজের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার আগে কোনোদিন এ ব্যাপারে কোনো কথা শোনেননি। এটি ছিল এমনই একটি প্রসঙ্গ যা নিয়ে কখনো কেউ আলোচনা করত না। এমনকি কিশোরীরা নিজেদের মধ্যেও না।
কিন্তু দৃশ্যপট বদলাতে থাকে অ্যাকশন ইন্ডিয়া নামক একটি দাতব্য সংস্থার হাত ধরে, যারা প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তারাই প্রথম কাঠিখেরা গ্রামে স্যানিটারি প্যাড তৈরির একটি কারখানা স্থাপন করে।
স্নেহার প্রতিবেশী সুমন কাজ করতেন অ্যাকশন ইন্ডিয়ার হয়ে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে সুমন স্নেহার কাছে এসে প্রস্তাব দেন কারখানায় কাজ করার। কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনো স্নেহার স্বপ্ন কোনো একদিন দিল্লি পুলিশে যোগ দেয়ার। কিন্তু গ্রামে সেসব তো দূরে থাক, অন্য কোনো চাকরির সুযোগই নেই। তাই সুমনের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরই নেচে ওঠে তার মন।
কিন্তু শুধু নিজের সম্মতিই তো যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন পরিবারের অনুমতিও। তাই প্রথমে নিজের মাকে এ ব্যাপারে বলেন স্নেহা। কিন্তু তার মায়ের হাতেও কোনো ক্ষমতা ছিল না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তো থাকে কেবল পুরুষদের হাতেই। তাই স্নেহাকে তার মা বললেন, "বাবার কাছ থেকে পারলে অনুমতি নিয়ে এসো।"
কিন্তু বাবাকে স্যানিটারি প্যাড তৈরির কথা বলতে খুবই লজ্জা পাচ্ছিলেন স্নেহা। তাই তিনি বুদ্ধি করে বাবাকে বলেন, কারখানায় বাচ্চাদের ডায়পার তৈরি করা হবে। ডায়পারের কথা শুনে বাবা রাজি হন। কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন স্নেহা। দুই মাস অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর একদিন স্নেহার মা তার বাবাকে বলেন, তিনি আসলে প্যাড তৈরি করছেন। তখন অবশ্য তার বাবা কোনো আপত্তি জানাননি। বলেছেন, "কাজ তো কাজই!"
বর্তমানে স্নেহাদের কারখানাটিতে কাজ করেন সাতজন নারী। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৩১ বছরের মধ্যে। সপ্তাহে ছয়দিন, সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করেন তারা, এবং মাসিক বেতন পান ২,৫০০ রুপি করে। প্রতিদিন সেখানে ৬০০টি করে প্যাড তৈরি হয়, যা 'ফ্লাই' ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি করা হয়।
কারখানার কাজ যে খুব নির্ঝঞ্ঝাটে সম্পন্ন হয়, তেমনটি বলা যাবে না মোটেই। সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটির সম্মুখীন হতে হয়, তা হলো বিদ্যুৎ সমস্যা। যখন তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। কখনো কখনো তো বিনা নোটিশে টানা দুদিনও বিদ্যুৎ থাকে না। এরকম পরিস্থিতিতে প্রতিদিনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব না হলে, কারখানার কর্মীদেরকে রাতের বেলা বিদ্যুৎ এলে আবার কাজ শুরু করতে হয়। যদিও রাতের বেলা কাজ করা একদমই নিরাপদ নয়, তারপরও তাদের সামনে অন্য কোনো রাস্তাও যে খোলা নেই।
আপাতদৃষ্টিতে গোটা কার্যক্রমটিকে খুবই ছোট মনে হতে পারে। মাত্র দুই রুমের একটি বাড়িকে কারখানা বানিয়ে, সাতজন কর্মী মিলে প্যাড তৈরি করে সমাজকে কতটুকুই বা বদলানো যায়! কিন্তু তারপরও এ কথা অনস্বীকার্য যে, খুব ছোট এই উদ্যোগটিই স্নেহার গ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। প্যাড তৈরির কারখানাটি চালু হওয়ার আগে গ্রামের অধিকাংশ নারীই ঋতুচক্রের সময় পুরনো শাড়ি বা বিছানার চাদর থেকে কাপড় ছিঁড়ে ব্যবহার করতেন। অনেকে তো আবার সামনে যা পেতেন, সেটিকেই কাজে লাগাতে শুরু করতেন।
এর পেছনে প্রধান কারণ ঋতুচক্র চলাকালীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। আরো একটি কারণ হলো বাজারে যেসব সাধারণ স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়, সেগুলোর চড়া দাম, যা গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু স্নেহারা গ্রামের মানুষকে একাধারে যেমন ঋতুচক্র সম্পর্কে সচেতন করেছেন, তেমনই প্রতি প্যাকেট প্যাডের মূল্যও ধরেছেন মাত্র ৩০ রুপি। ফলে এখন গ্রামের ৭০% নারীই ঋতুচক্রের সময় প্যাড ব্যবহার করছেন।
ধীরে ধীরে ঋতুচক্র বিষয়ে গ্রামের মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণাগুলোও দূর হতে শুরু করেছে। কয়েক বছর আগেও এ দৃশ্য কল্পনা করা যেত না যে গ্রামের নারীরা প্রকাশ্যে নিজেদের মাঝে ঋতুচক্র নিয়ে আলোচনা করছেন। কিন্তু এখন হরহামেশাই এ দৃশ্য নজরে পড়ছে, কারণ গ্রামের নারীরা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছেন ঋতুচক্র লজ্জা বা অপমানের কোনো বিষয় নয়, বরং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব।
শুরুর দিকে স্নেহাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তাকে ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করতে হতো, নিজের পড়াশোনা করতে হতো, আবার সারাদিন কারখানার চাকরিও করতে হতো। বিশেষ করে পরীক্ষার দিনগুলোতে তার জন্য সবদিক সামলানো খুবই কষ্টকর হয়ে যেত। তখন তার বদলে তার মা কাজে যেতেন।
তবে এখন নিজের এমন জীবনকে মোটামুটি গুছিয়ে এনেছেন স্নেহা। তার বাবা রাজেন্দ্র সিং তানওয়ারও এখন বেজায় খুশি মেয়েকে নিয়ে। তিনি বলেন, "যদি সে তার কাজের মাধ্যমে সমাজের, বিশেষ করে নারীদের, উন্নতি করতে পারে, তাহলে আমি তার জন্য গর্বিত।"
এ তো কেবল স্নেহার গল্প। স্নেহা তার পরিবারকে মানিয়ে নিতে পেরেছেন। সে সৌভাগ্য সকলের হয়নি। শুরু থেকেই গ্রামের অনেকের মধ্যেই কারখানার কর্মকান্ড নিয়ে সন্দেহ ছিল। এরপর যখন কারখানার কর্মকান্ডের দৃশ্যধারণের জন্য ফিল্ম ক্রু এসে হাজির হলো গ্রামে, তখন সন্দেহের পারদ মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। এমন একটা অবস্থায় নিজের সংসারেও রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হলো কারখানায় কর্মরত কয়েকজন নারীর। তেমনই একজন ৩১ বছর বয়সী সুষমা দেবী।
দুই বাচ্চার মা সুষমা। তাকে তার স্বামী কিছুতেই কাজে যেতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি নিজে অনেকবার চেষ্টা করেও যখন বোঝাতে পারলেন না, তখন স্নেহার মা এসে কথা বলেন তার স্বামীর সাথে। স্নেহার মায়ের কথাতেই কিছুটা মন গলে তার। কিন্তু এ কথাও সাফ জানিয়ে দেন যে, "কারখানায় কাজ করবে ভালো কথা, কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগে ঘরের সব কাজ সেরে রেখে যাওয়া চাই।"
স্বামীর মন রাখতে সুষমা তাই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় কাচা, ষাঁড়গুলোকে খাবার দেয়া, জ্বালানীর জন্য গোবরের লাঠি তৈরি করা, গোসল করা, সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার তৈরি করা - এই সকল কাজ শেষ করে তবেই তিনি কারখানার উদ্দেশে পা বাড়াতে পারেন। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায়ও ফুসরত মেলে না তার। বাসায় ফিরেই রাতের খাবার রান্না শুরু করতে হয়।
অবশ্য এত পরিশ্রম করেও স্বামীর মন জয় করতে পারেননি সুষমা। প্রায়ই তার উপর রেগে যান তার স্বামী। বলেন, "ঘরে এত কাজ থাকতে তোমাকে বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে কেন?" প্রতিবেশীরাও সুষমার কাজকে ভালো চোখে দেখে না। তিনি এত কম বেতন পাচ্ছেন কেন, এ নিয়েও খোঁটা দেয় তারা।
একসময় সুষমার দুই প্রতিবেশী নারীও তার সাথে কারখানায় কাজ করতেন। কিন্তু কয়েকমাস পর তারা কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবে সুষমার কোনো ইচ্ছাই নেই এমন কিছু করার। "আমাকে আমার স্বামী যতই মারধোর করুক, তবু আমি এই চাকরি ছাড়ব না। আমি আমার কাজটাকে উপভোগ করছি।"
নেটফ্লিক্সের জন্য নির্মিত ডকুমেন্টারিটিতে সুষমাকে বলতে শোনা যায়, তিনি তার উপার্জনের কিছু অর্থ খরচ করবেন ছোট ভাইয়ের জন্য নতুন কাপড় কিনতে। কিন্তু এখন এ নিয়ে তার লজ্জার শেষ নেই। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, "আমি যদি জানতাম এটা অস্কারে যাবে, তাহলে অবশ্যই আরো বুদ্ধিদীপ্ত কিছু বলতাম!"
সুষমা, স্নেহা ও তাদের অন্যান্য সহকর্মীদের জন্য ডকুমেন্টারিটি অস্কারে মনোনীত হওয়াই ছিল বিশাল একটি ব্যাপার। আর এখন তো সেটি শর্ট সাবজেক্ট ক্যাটাগরিতে সেরা ডকুমেন্টারির পুরস্কারও জিতে গেছে। তাই কাঠিখেরা গ্রামবাসীর মনে এখন বাঁধভাঙা আনন্দ। তবে বিষয়টি আরো বেশি মাহাত্ম্যপূর্ণ স্নেহা ও সুমনের কাছে। কারণ তারা যে অস্কার জয়ের মুহূর্তটা সরাসরি লস অ্যাঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটার থেকে উপভোগ করেছেন।
এর আগে কখনো দেশের বাইরে যায়নি কাঠিখেরা গ্রামের কেউ। অস্কার পুরস্কারের কথাও এর আগে জানত না গ্রামের ৯৯% মানুষই। স্নেহা টুকটাক অস্কারের কথা শুনেছিলেন বটে, কিন্তু কোনোদিন নিজের চোখে টিভিতে বা অনলাইনে এ অনুষ্ঠান দেখা হয়নি তার। অথচ সেই তিনিই কি না অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের আমন্ত্রণে ২১ ফেব্রুয়ারি পা রাখেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়, এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি হেঁটে যান অস্কারের লাল গালিচার উপর দিয়েও। স্নেহার কাছে এই সবকিছুই যেন স্বপ্ন। এমন একটি স্বপ্ন, যা তিনি দু'চোখ মেলেই দেখতে পাচ্ছেন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
This article is in Bengali language. It is about Sneha, the protagonist of Oscars winning documentary "Period. End of sentence." Necessary references have been hyperlinked inside.
Featured Image © BBC